মরমি কবি মনসুর হাল্লাজের রচনাবলী
গত কয়েক পর্বে মনসুর হাল্লাজের জীবনের প্রধান ঘটনাগুলো বর্ণনার পর আজ আমরা ইরানের এই বিখ্যাত আরেফ ও মরমি কবির রচনাবলী সম্পর্কে কথা বলব।
মনসুর হাল্লাজ অনেক বই লিখেছিলেন বলে জানা যায়। তার বিচার চলাকালে কেউ কেউ এ বইগুলোর কথা স্মরণ করেন। কিন্তু পরবর্তীকালে এই বইগুলোর প্রচার এবং বেচা-কেনা নিষিদ্ধ করা হয়।
আল ফেহরেস্ত নামক বিখ্যাত বইয়ের লেখক ইবনে নাদিম মনসুর হাল্লাজের নামে প্রচলিত ৪৯টি বইয়ের নাম উল্লেখ করেছেন। এসবের মধ্যে আশশাজারাল নুরিয়া, আল যাওয়াহিরুল আকবার, আত্তাসিন আল আজাল, তাফসিরে ক্বুল হু আল্লাহু আহাদ, হামল্ আননুর ওয়াল হায়াত ওয়াল আরওয়াহ, কিতাবুল আদল্ ও আত্তাওহিদ এবং দিওয়ানে আশয়ার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তবে তার ৪৯টি বইয়ের মধ্যে কেবল চারটি বই ও ৪৫২টি কবিতা টিকে আছে। মনসুর হাল্লাজের কবিতাগুলোর মধ্যে প্রায় ৩৪০টি ক্ষুদ্র কবিতা বা অণু-কবিতা তার ইরফানি বা আধ্যাত্মিক খোদাপ্রেমের অভিজ্ঞতা, উপদেশ ও মুনাজাত সম্পর্কিত।
মনসুর হাল্লাজের বইগুলো তার বন্দি অবস্থায়, বিচার চলাকালে ও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার সময় ধ্বংস করে দেয়া হয়। একজন প্রখ্যাত আলেম ও আরেফ হিসেবে তিনি যে ফিক্হি বা ইসলামী বিধি-বিধান সংক্রান্ত, কালামি তথা ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি ও দর্শন বা নীতিশাস্ত্র এবং ইরফান তথা আধ্যাত্মিক খোদা-পরিচিতি-ভিত্তিক যে মাজহাব গড়ে তুলেছিলেন তৎকালীন আব্বাসীয় মন্ত্রী হামিদ বিন আব্বাস তা ধ্বংস করে দেন। শুধু তাই নয় মনসুর হাল্লাজের ছাত্রদেরকেও নজরদারির আওতায় এনে তাদের শিক্ষকের লেখা বইগুলোর হস্তলিখিত সব কপি ধ্বংস করে দেন এই মন্ত্রী। তবুও ‘হাল্লাজের রচনাবলী’ বা ‘মাজমুয়ে আসারে হাল্লাজ’ নাম দিয়ে এই ইরানি মনীষীর কয়েকটি বই প্রকাশ করেছেন কাসেম মির আখোরি নামের একজন লেখক। তিনি হাল্লাজের মূল কয়েকটি বইয়ের অনুবাদ করেছেন আরবি থেকে ফার্সি ভাষায় এবং বইগুলোর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও করেছেন তার এই সংকলনে।

মনসুর হাল্লাজের যে ক’টি বই টিকে রয়েছে সেসবের মধ্যে ত্বাওয়াসিন হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। লন্ডন ও ইস্তাম্বুলের জাদুঘরে রক্ষিত এ বইয়ের দু’টি কপি বা সংস্করণের সম্পাদনা করে বইটি প্রকাশ করেছেন ফরাসি প্রাচ্যবিদ লুয়ি ম্যাসিনোন বা লুই ম্যাসিনিউন। বইটি প্রকাশ হয় খ্রিস্টিয় ১৯১৩ সনে। মনসুর হাল্লাজ যখন কারাগারে ছিলেন তখন আহমাদ বিন আতা আল অদমি’র বন্ধু ও ছাত্রদের মাধ্যমে বইটি বাইরে চলে আসে বলে ম্যাসিনিউন উল্লেখ করেছেন। কাসেম মির আখোরি ম্যাসিনিউনের সম্পাদিত ত্বাওয়াসিন বইটিরই ফার্সি অনুবাদ করেছেন।
ত্বাওয়াসিন বইটির রয়েছে দশটি খণ্ড। ত্বাওয়াসিন শব্দটি ত্বাসিন শব্দের বহুবচন। এটি পবিত্র কুরআনের সুরা ‘নাম্ল’-এরই অন্য এক নাম। কারণ, এ সুরাটি শুরু হয়েছে বিচ্ছিন্ন দুই আরবি অক্ষর ত্বোয়া ও সিন দিয়ে। কুরআনের তাফসিরকারকদের কেউ কেউ মনে করেন এখানে ত্বোয়া-সিন বলতে দয়ালু বা কোমল কিংবা সূক্ষ্মদর্শী ও মহান শ্রোতা হিসেবে মহান আল্লাহর শপথ নেয়াকে বোঝানো হয়েছে। ত্বাওয়াসিন বইতে মনসুর হাল্লাজ খোদাপ্রেমের আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা অত্যন্ত জটিল ও রহস্যময় ভাষায় বর্ণনা করেছেন।
‘মনসুর হাল্লাজের রচনাবলী’ শীর্ষক সংকলনে স্থান-পাওয়া আরেকটি বইয়ের নাম ‘বুস্তানুল মারেফাত’। এখানে লেখক খোদার আধ্যাত্মিক পরিচিতি ও নানা বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করেছেন। ‘মনসুর হাল্লাজের রচনাবলী’ শীর্ষক সংকলনের দ্বিতীয় খণ্ডে রয়েছে কিতাবে রেওয়ায়েত নামের একটি বই। এখানে মনসুর হাল্লাজের ২৭টি রেওয়ায়েত বা বিশেষ বর্ণনা রয়েছে। এইসব বর্ণনা তার হৃদয়ে জেগে-ওঠা আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণার প্রকাশ। পবিত্র কুরআনের রহস্যময় বাণীগুলোর অংশ বিশেষ ও আধ্যাত্মিক নানা ইশারা-ইঙ্গিত আর উপমা রয়েছে এইসব বর্ণনার মধ্যে। মনসুর হাল্লাজ হাদিসের প্রচলিত সনদের বিপরীতে এইসব রেওয়ায়েত তুলে ধরেছেন। তার মতে মহানবীর (সা) হাদিস মানে তাঁর উপদেশ বা বক্তব্য নয় এবং হাদিসের সনদ এমন সব ব্যক্তির সাক্ষ্যভিত্তিকও নয় যারা একে অপর থেকে মুখে মুখে হাদিস শুনে তা বর্ণনা করে এখন পরলোকে চলে গেছেন, বরং হাদিসের সনদের ধারাবাহিকতা হল সৃষ্টিকুল যাদেরকে জনগণ চিনতে পারেন ও যারা এখনও উপস্থিত রয়েছেন!

‘মনসুর হাল্লাজের রচনাবলী’ শীর্ষক সংকলনের তৃতীয় খণ্ডে রয়েছে পবিত্র কুরআনের তাফসির। আবু আবদুর রহমান সুল্লামি মনসুর হাল্লাজের মুখে শুনে হাক্বায়েকুত্তাফসির নামে একটি বই লিখেছিলেন। লুই ম্যাসিনিউন এ বইয়ের লিখিত কয়েকটি কপির ভিত্তিতে বইটি সম্পাদনা করেন এবং তা প্যারিস থেকে ছাপানো আকারে প্রকাশ হয় ১৯২২ সালে। এ তাফসির গ্রন্থে কুরআনের প্রত্যেক সুরা হতে একটি বা বিশেষ কয়েকটি আয়াতের তাফসির করেছেন মনসুর হাল্লাজ।
‘মনসুর হাল্লাজের রচনাবলী’ শীর্ষক সংকলনের চতূর্থ খণ্ডে রয়েছে ৩৪০টি ক্ষুদ্র বা অণু কবিতা। একই সংকলনের পঞ্চম খণ্ডে স্থান পেয়েছে সনদ ও উৎসসহ মনসুর হাল্লাজের আরও ১১২টি ক্ষুদ্র কবিতা। তার কবিতাগুলোর একটি ভিন্ন সংকলন দেখা যায়। এটি লুই ম্যাসিনিউন সংগ্রহ করেছেন। মনসুর হাল্লাজের ছাত্র বা শিষ্যরাই এসব কবিতা সংরক্ষণ করে রেখেছিল। ম্যাসিনিউন 'দিওয়ানে আশআরে হাল্লাজ' নামের এ সংকলন বা কাব্যগ্রন্থ ছাপাখানা থেকে প্রকাশ করেন ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে। বহু বিতর্ক, আলোচনা ও গবেষণার পর এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ হয় ১৯৫৫ সনে।
মনসুর হাল্লাজের কবিতাগুলো সহজ-সরল। এসব কবিতার বেশিরভাগই মহান আল্লাহর কাছে মিনতি প্রকাশ বা মুনাজাত ও আশ্রয়কামী প্রার্থনামূলক। তিনি তার কবিতায় খুব কমই সুফিবাচক শব্দ প্রয়োগ করেছেন। মনসুর হাল্লাজের কোনো কোনো কবিতায় ইসলামী যুক্তি, দর্শন ও বিধি-বিধান সংক্রান্ত ভাবধারা বা বক্তব্যও দেখা যায় যা ছিল সে যুগের কবিতার ধারা থেকে ভিন্ন বা ব্যতিক্রমধর্মী।
‘মনসুর হাল্লাজের রচনাবলী’ শীর্ষক সংকলনের সর্বশেষ বা সপ্তম খণ্ডে রয়েছে এই মহান আরেফ ও সাধকের কিছু বাণী বা বক্তব্য। এসবের মধ্যে সেইসব শব্দ বা ধারণাগুলোও আছে যা কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার কবিতা ও গদ্যে দেখা যায়। এসব বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়েছেন অনুবাদক মির আখোরি। #
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ১৭
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।