মার্কিন আধিপত্যের পতন ও বহুপক্ষীয় বিশ্বব্যবস্থার উত্থান
পার্সটুডে: ইউরোপের দেশগুলো, বিশেষ করে জার্মানির সাম্প্রতিক অবস্থান পরিবর্তন স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, মার্কিন আধিপত্য দুর্বল হচ্ছে এবং বিশ্ব অনিবার্যভাবে একটি বহুধ্রুবীয় ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
পার্সটুডের প্রতিবেদনে বলা হয়, ইরানের দৈনিক 'এতেমাদ' এক বিশ্লেষণে লিখেছে, ইউরোপ, বিশেষ করে জার্মান কর্মকর্তাদের 'মার্কিন আধিপত্যের যুগের অবসান' সংক্রান্ত স্পষ্ট বক্তব্য প্রমাণ করে যে, যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যের ক্রমশ অবক্ষয় এবং বিশ্ব এক নতুন বহুপক্ষীয় ব্যবস্থার দিকে এগোচ্ছে। এই কাঠামোগত পরিবর্তনের শিকড় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের বৈধতা, কার্যকারিতা ও নৈতিকতার সংকটে। একই সঙ্গে স্বাধীন শক্তিগুলোর উত্থান এবং নতুন বৈশ্বিক সহযোগিতা কাঠামোর বিকাশ এই প্রক্রিয়াকে আরও দ্রুত করছে।
ঐতিহাসিক শিকড় ও বৈধতার সংকট
যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য কঠোর ও নরম শক্তির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল, যার পেছনে রয়েছে দেশটির বিশেষ ঐতিহাসিক বাস্তবতা। উদারপন্থী মতাদর্শিক বর্ণনার বিপরীতে, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার বড় অংশ এসেছে অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদ, দাসশ্রমের শোষণ, আদিবাসীদের পদ্ধতিগতভাবে নির্মূল এবং পরে বিশ্বজুড়ে হস্তক্ষেপমূলক ও বহির্মুখী উন্নয়ন মডেলের মাধ্যমে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ ও এশিয়ায় ক্ষমতার শূন্যতা কাজে লাগিয়ে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে উদার আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। তবে শুরু থেকেই এই আধিপত্যের ভেতরে একটি মৌলিক দ্বন্দ্ব ছিল—একদিকে নিয়মভিত্তিক ও বহুপাক্ষিক ব্যবস্থার দাবি, অন্যদিকে একতরফা সিদ্ধান্ত ও স্বার্থকেন্দ্রিক আচরণ। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর একমেরু বিশ্বের আবির্ভাবে এই দ্বন্দ্ব কমেনি, বরং আরও তীব্র হয়েছে। প্রতিরোধমূলক যুদ্ধ, একতরফা কঠোর নিষেধাজ্ঞা এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকে উপেক্ষা করার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ধীরে ধীরে বহু জাতি ও এমনকি নিজস্ব মিত্রদের কাছেও নৈতিক ও রাজনৈতিক বৈধতা হারাতে থাকে।
অর্থনৈতিক কারণ ও আধিপত্যের কার্যকারিতা হ্রাস
শীতল যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যের অন্যতম ভিত্তি ছিল ডলারের একচেটিয়া বৈশ্বিক রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ। এর মাধ্যমে ওয়াশিংটন আর্থিক নিষেধাজ্ঞা ও সুইফট ব্যবস্থার মাধ্যমে চাপ প্রয়োগের অসাধারণ ক্ষমতা অর্জন করেছিল।
কিন্তু গত দুই দশকে এই একচেটিয়াত্ব ভেঙে পড়তে শুরু করেছে। চীনের দ্রুত অর্থনৈতিক উত্থান, রাশিয়ার নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক প্রতিরোধ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে উদীয়মান শক্তি ও এমনকি কিছু মার্কিন মিত্রের ডলারের ওপর নির্ভরতা কমানোর প্রচেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রের চাপ প্রয়োগের ঐতিহ্যবাহী কৌশলকে দুর্বল করে দিয়েছে। বিকল্প আর্থিক কাঠামো, জাতীয় মুদ্রায় দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য এবং ব্রিকসের মতো জোটের স্বাধীন লেনদেন ব্যবস্থা তৈরির উদ্যোগ প্রমাণ করছে যে, বৈশ্বিক রাজনৈতিক অর্থনীতি আর পুরোপুরি সাবেক হেজেমনের নিয়ন্ত্রণে নেই।
প্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক উত্থান ও ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তন
একমেরু বিশ্বব্যবস্থা দাঁড়িয়ে ছিল এই ধারণার ওপর যে, যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বী আর আবির্ভূত হবে না। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর বাস্তবতা এই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেছে। রাশিয়ার সামরিক ও জ্বালানি শক্তি হিসেবে পুনরুত্থান এবং বিশেষভাবে চীনের অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত ও সামরিক পরাশক্তিতে রূপ নেওয়া একমেরু যুগকে কার্যত ইতিহাসে পরিণত করেছে।
এই পরিবর্তন শুধু বৃহৎ শক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা (এসসিও) এবং ব্রিকস-এর মতো সংস্থাগুলো গঠন ও শক্তিশালী হচ্ছে। এসব সংস্থা জাতির স্বাধীনতা, অন্যের বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা এবং সমন্বিত উন্নয়নের নীতি মেনে চলে। এসব সংস্থা ধীরে ধীরে সেই দেশগুলোর জন্য আকর্ষণকেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে, যারা পশ্চিমের ওপর নির্ভরতা কমাতে চায়।
ঐতিহ্যবাহী মিত্রদের প্রতিক্রিয়া
'মার্কিন নেতৃত্বের যুগের অবসান' সম্পর্কে জার্মান কর্মকর্তাদের সাম্প্রতিক বক্তব্য ওয়াশিংটনের ঐতিহ্যবাহী মিত্রদের মধ্যে এক ধরনের কৌশলগত জাগরণের প্রতীক। দীর্ঘদিন ইউরোপের নিরাপত্তা নির্ভর করেছিল ন্যাটোর মার্কিন নেতৃত্বাধীন নিরাপত্তা ছাতার ওপর। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে 'আমেরিকা ফার্স্ট' নীতি, নিরাপত্তা অঙ্গীকারের অনিশ্চয়তা, সামরিক ব্যয় বাড়ানোর চাপ এবং ইউক্রেন ও বিশেষ করে ফিলিস্তিন ইস্যুতে মতপার্থক্য এই সম্পর্ককে দুর্বল করেছে।
ইউরোপ ধীরে ধীরে উপলব্ধি করছে যে, একটি শক্তির উপর নিরঙ্কুশ নিরাপত্তা নির্ভরতা, যার স্বার্থ সর্বদা তার মিত্রদের স্বার্থের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, নিজেই একটি কৌশলগত দুর্বলতা। এই সচেতনতা বৃহত্তর কৌশলগত স্বাধীনতা এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের বৈচিত্র্য অর্জনের অনুসন্ধানের চালিকা শক্তি।
নতুন বৈশ্বিক ব্যবস্থায় ইরানের অবস্থান
এই ভূ-রাজনৈতিক উত্তরণে, ইরানের মতো দেশগুলো যারা স্বাধীনতা, আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এবং বহু-মেরু বিশ্বের সাথে বহুমুখী সহযোগিতা বিকাশের নীতির উপর জোর দেয়, তারা একটি নতুন অবস্থান খুঁজে পাচ্ছে। সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা ও ব্রিকসে সক্রিয় কূটনীতি, প্রাচ্যের শক্তিগুলোর সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক এবং উত্তর–দক্ষিণ করিডরের মতো বাণিজ্য ও ট্রানজিট পথ গড়ে তোলার উদ্যোগ- সবই এই বৈশ্বিক কাঠামোগত পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
উপসংহার
বিশ্ব এক বড় ধরনের পুনর্গঠনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। মার্কিন আধিপত্যের পতন কোনো দ্রুত বা সরল প্রক্রিয়া নয়; এটি জটিল ও চ্যালেঞ্জপূর্ণ হবে এবং নানা অস্থিরতা সৃষ্টি করবে। তবে সামগ্রিক দিকনির্দেশনা স্পষ্ট- ক্ষমতার বহু কেন্দ্র, সহযোগিতার বৈচিত্র্য এবং পুরোনো একচেটিয়াত্বের দুর্বলতা।
'আমেরিকার যুগ'-এর অবসান মানে বিশৃঙ্খলা নয়; বরং এমন একটি বিশ্বব্যবস্থার সূচনা, যেখানে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, অর্থনৈতিক ন্যায্যতা ও প্রকৃত বহুপাক্ষিকতা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নির্ধারণে আরও বেশি গুরুত্ব পাবে। এই নতুন ব্যবস্থা একবিংশ শতাব্দীর বৈচিত্র্য ও জটিল বৈশ্বিক বাস্তবতাকেই প্রতিফলিত করবে।#
পার্সটুডে/এমএআর/১৮