জানুয়ারি ০২, ২০২১ ২৩:২২ Asia/Dhaka

ইরানের কুদস ফোর্সের সাবেক প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিচার হওয়া উচিত। এটি অত্যন্ত ঘৃণ্য কাজ করেছে ট্রাম্প। রেডিও তেহরানকে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে একথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড.এম শাহীদুজ্জামান।

তিনি বলেন, জেনারেল সোলাইমানিকে হত্যার বিষয়টি ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব ও মোসাদের সংযুক্ত প্রয়াস। এটি ছিল অত্যন্ত গভীর ষড়যন্ত্র। জেনারেল সোলাইমানিকে হত্যা করে আমেরিকা ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের নৈতিক পরাজয় হয়েছে এবং তাঁকে অত্যন্ত লজ্জাজনকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হচ্ছে। আর ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুরও বিদায়ের সময় এসে গেছে। অন্যদিকে ইরানের নৈতিক জয় হয়েছে এবং মধ্যপ্রাচ্যসহ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইরান অত্যন্ত শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে।

বিশিষ্ট এই অধ্যাপক আরও বলেন,জেনারেল সোলাইমানিকে হত্যা করা ডোনাল্ড ট্রাম্পের বড় পাপ ছিল।

সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ ও উপস্থাপনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ। পুরো সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো।

সফল সমর নায়ক শহীদ জেনারেল  কাসেম সোলাইমানি

রেডিও তেহরান: জনাব অধ্যাপক এম শাহীদুজ্জামান,  ইরানের কুদস ফোর্সের সাবেক প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল কাসেম সোলাইমানির শাহাদাতের প্রথম বার্ষিকী আগামী ৩ জানুয়ারি পালিত হতে যাচ্ছে। জেনারেল সোলাইমানিকে হত্যার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে সে সময় তিনি নিজেই দম্ভোক্তি করেছিলেন। একজন শীর্ষ পর্যায়ের সেনা কর্মকর্তাকে এভাবে হত্যার জন্য কোনো আইন কি অনুমতি দেয়?

অধ্যাপক শাহীদুজ্জামান: মোটেও না; এবং এটা সরাসরি সন্ত্রাস। একজন আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী এরকম কাজ করতে পারে। জেনারেল সোলাইমানির যে স্বীকৃতি- তিনি একজন দেশপ্রেমিক সার্থক সমরনায়ক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে  মিত্র দেশ ব্রিটেনের সংবাদমাধ্যম বিবিসিতে জেনারেল সোলাইমানিকে নিয়ে একটি দীর্ঘ প্রোগ্রাম করা হলো। প্রোগ্রামটি আমি নিজে দেখেছি। তারপ্রতি যে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হলো তা থেকে বোঝা যায় তিনি কতবড় সমরনায়ক ছিলেন। ডোনাল্ট ট্রাম্পের নির্দেশে জেনারেল সোলাইমানিকে হত্যা করা হলো এ ব্যাপারে আমিসহ অনেকেই মনে করি যে আন্তর্জাতিক আইনে এর বিচার হওয়া উচিত। কোনোভাবেই ট্রাম্প এ ব্যাপারে নির্দ্বিধায় পার পেয়ে যাবে সেটা এলাউ করা উচিত না।

আজকে চরম অপমানজনকভাবে ট্রাম্পকে বিদায় নিতে হচ্ছে। তার নিজ দল রিপাবলিকানরাই তাকে প্রত্যাখ্যান করছে। ট্রাম্পের এই হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি ইরানকে বারংবার তুলে ধরা উচিত যে কিভাবে একজন জাতীয় বীরকে নৃশংস এবং কাপুরুষোচিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। এটি অত্যন্ত ঘৃণ্য কাজ। এমনকি পশ্চিমা বিশ্বের অনেকে মনে করে যে এজন্য ট্রাম্পের বিচার হওয়া উচিত। এটি ইরানের প্রতি ঘোর অন্যায় করা হয়েছে।

রেডিও তেহরান: আমেরিকা কেন জেনারেল সোলাইমানি কেন হত্যা করল? হত্যাকাণ্ডের এক বছর পরে এসে আপনার কাছে কি মনে হয়?

অধ্যাপক এম শাহীদুজ্জামান: আমার কাছে কারণটা বেশ সুস্পষ্ট ছিল। জেনারেল সোলাইমানি অত্যন্ত সার্থকভাবে ইরাক সিরিয়া এমনকি সরাসরি ইসরাইলে যাওয়ার মতো যে সামরিক পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন তাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ইসরাইল বারবার অর্নিং দিয়ে জানায় যে জেনারেল সোলাইমানির যে সামরিক কৌশল রয়েছে এবং তার যে গেরিলা বাহিনী আছে এবং সিরিয়াতে ইরানের যে উপস্থিতি তাতে তারা সরসারি জেরুজালেমে গিয়ে আল আকসা মসজিদকে মুক্ত করতে পারবে। তাদের মধ্যে এমন একটা আশঙ্কা বিরাজ করছিল যে জীবিত সোলাইমানি ইসরাইলের অস্তিত্বের জন্য হুমকি। ইসরাইলি গোয়েন্দাবাহিনীর কাছে এমন একটা বিশ্বাস জন্মেছিল যে অধিকৃত জেরুজালেমকে তারা মুক্ত করতে সক্ষম। তাছাড়া ইরানের শান্তিপূর্ণ পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে যে চুক্তি হয়েছিল সেই চুক্তি থেকে মার্কিনিরা বেরিয়ে যাওয়ার ফলে ইরান যে যোগ্য প্রতি উত্তর দিচ্ছে সেই বাস্তবতাকে সামনে রেখে তাদের কাছে মনে হয়েছে জেনারেল সোলাইমানি হচ্ছে ইরানের সবচেয়ে বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন মেধাবী সমরবিদ। যিনি আধনিক বিশ্বে যে ধরনের যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে চালিয়ে যাচ্ছিল অর্থাৎ তার সহযোগিতায় সিরিয়াতে আসাদবাহিনী যেভাবে অকুপাইড ফোর্সেসদেরকে বিতাড়িত করছিল তাতে সোলাইমানিকে অত্যন্ত মেধাবী একজন সমরনায়ক হিসেবে তারা দেখতে পেয়েছে।

মহাবীর শহীদ কাসেম সোলাইমানি

সবচেয়ে অবাক বিষয় হচ্ছে জেনারেল সোলাইমানি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আইসিসকে বিধ্বস্ত করার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ রোল প্লে করেছে। আইসিসের পরাজয়টা মোসাদ, সৌদি আরব এবং আমেরিকা সমর্থন করে নি। কাজেই জেনারেল সোলাইমানিকে হত্যার বিষয়টি ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব ও মোসাদের সংযুক্ত প্রয়াস। এটি ছিল অত্যন্ত গভীর ষড়যন্ত্র। এখানে সুপরিকল্পিত একটি ধারণা প্রিভেইল করছিল বলেই সরাসরি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জেনারেল সোলাইমানিকে হত্যার হুকুম দেয় এবং মার্কিন বাহিনীর ড্রোন ব্যবহার করে বীর জেনারেলকে অতর্কিতভাবে হত্যা করা হয় ইরাকে।

রেডিও তেহরান: যে লক্ষ্য নিয়ে আমেরিকা এই বর্বর ও পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তা কতটা অর্জিত হয়েছে?

ডোনাল্ড ট্রাম্প

অধ্যাপক শাহীদুজ্জামান: দেখুন, এতে তো আমেরিকার অর্জিত হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ সবশেষে কিন্তু অন্যায়ের বিরুদ্ধে নৈতিকতারই জয় হয়। আমরা দেখলাম ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরাজয় হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে  ইরানের যে অবস্থান তাতে ইরানেরই জয় হয়েছে। আজকে ইরাকের সাথে ইরান সুদৃঢ় সম্পর্ক বজায় রেখেছে। সোলাইমানির দেখানো পথে ইরান এখনও চলছে। নৈতিক জয় ইরানেরই হয়েছে আর বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এখন বিধ্বস্ত এবং অত্যন্ত সমালোচিত। তারও প্রস্থানের সময় ঘনিয়ে আসছে। ইরান এখন একটা শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে।

রেডিও তেহরান: জেনারেল সোলাইমানি হত্যাকাণ্ডের মধ্যদিয়ে আমেরিকা বিরাট কৌশলগত ভুল করেছে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। আপনি কী একটু বলবেন কী সেইসব ভুল?

অধ্যাপক এম শাহিদুজ্জামান: দেখুন, জেনারেল সোলাইমানিকে হত্যা করার বিষয়টি আমেরিকার জন্য খুব বড় একটা উদ্দেশ্য ছিল। তারা ভেবেছিল জেনারেল সোলাইমানিকে  হত্যা করলে তার রিপ্লেসমেন্ট আসবে না। তারা এরকমটি ভেবেছিল। কিন্তু ইরান হঠকারি কোনো পথে যায় নি। ইরান সোলাইমানির যে পথ এবং চিন্তাধারা সেটাই বজায় রেখেছে। ইরানে আয়াতুল্লাহ’রা ক্ষমতায় আছেন। তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমর পরিচালনার পথ-সেটা সোলাইমানিরই পথ।

রেডিও তেহরান: তাহলে এটা স্পষ্ট যে আমেরিকা- জেনারেল সোলাইমানিকে হত্যার মধ্য দিয়ে একটি বিরাট কৌশলগত ভুল করেছিল..

অধ্যাপক শাহীদুজ্জামান: এক্সাক্টলি,নৈতিক দিক থেকে আমেরিকার কতখানি স্খলন হতে পারে তার শেষ পদক্ষেপ ছিল জেনারেল সোলাইমানিকে হত্যার বিষয়টি। ট্রাম্প প্রশাসন কতখানি অনৈতিক এবং পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক রীতি-নীতি কতখানি লঙ্ঘন করেছে তার প্রমাণ জেনারেল সোলাইমানিকে হত্যা। শুধু সোলাইমানিকে হত্যা নয়; গোলান হাইডসে সিরিয়ার যে বৈধ অধিকার সেটাকে অস্বীকার করে ইসরাইলকে বৈধতা দেয়া-যেটি ট্রাম্প করেছেন সেটি সম্পূর্ণ আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। এছাড়া একত্রিত জেরুজালেম করা এবং জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী করাও ছিল মারাত্মক ভুল।

এগুলোর পাশাপাশি জেনারেল সোলাইমানিকে হত্যা করাটা ছিল চূড়ান্ত পাপ। এরফলে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিনিদের আরও বেশি অগ্রহণযোগ্য করেছে, পরাজিত করেছে। অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের বৈধতা এবং উপস্থিতি জেনারেল সোলাইমানির নেতৃত্বে সৃষ্টি হয়েছিল সেটি আরও স্থায়িত্ব অর্জন করেছে। এরফলে আমেরিকার এবং ট্রাম্পের নৈতিক পরাজয় সবকিছু মিলিয়ে আমরা দেখতে পাই- আজকে আন্তর্জাতিক বিশ্ব জেনারেল সোলাইমানিকে মনে করে একজন বীর যোদ্ধা হিসাবে। একইসময় ট্রাম্পকে নিলর্জ্জের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব ছেড়ে চরম কাপুরুষের মতো বিদায় নিতে হচেছ। এখানেই আমরা দেখতে পাই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইরানের নৈতিক জয় হওয়ার বিষয়টি সুস্পষ্ট।

রেডিও তেহরান: তো জনাব অধ্যাপক এম শাহীদুজ্জামান ইরানের কুদস ফোর্সের সাবেক প্রধান জেনারেল সোলাইমানির প্রথম শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষে রেডিও তেহরানের সাথে কথা বলার জন্য, সময় দেয়ার জন্য আবারও অশেষ ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

অধ্যাপক শাহীদুজ্জামান: আমিও অত্যান্ত সম্মানিতবোধ করছি এখানে কয়েকটি কথা বলার সুযোগ পাওয়াতে। আপনাকেও ধন্যবাদ।#

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/২

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

 

 

 

ট্যাগ