ফেব্রুয়ারি ০২, ২০২১ ১৫:১০ Asia/Dhaka

ইরানের ইসলামী বিপ্লব আধুনিক যুগে বস্তুবাদী শক্তির ওপর ইসলামের আধ্যাত্মিক শক্তির বিজয়ের এক উজ্জ্বলতম নিদর্শন।

ইরানের ইসলামপন্থী জনগণ মূলত খালি হাতেই  পশ্চিম এশিয়ায় তৎকালীন মার্কিন সরকারের সবচেয়ে বড় মিত্র হিসেবে বিবেচিত স্বৈরতান্ত্রিক শাহ সরকারকে উৎখাত করতে সক্ষম হয়। শাহের সশস্ত্র বাহিনী ছিল পশ্চিম এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ সশস্ত্র বাহিনী এবং তার কুখ্যাত গোয়েন্দা বাহিনী সাভাক ছিল ইহুদিবাদী ইসরাইলের গোয়েন্দা বাহিনী বা জার্মান নাৎসী বাহিনীর মতই নৃশংস প্রকৃতির। বছরের পর বছর ধরে শাহের পেটোয়া বাহিনী ও গোয়েন্দা বাহিনী ইরানের ইসলামী বিপ্লবের সম্ভাবনাময় অনেক নেতা ও কর্মীকে জেলে বন্দি রেখেছে, নির্বাসন দিয়েছে এবং অনেক নেতা কর্মীকে শহীদও করেছে।  কিন্তু তা সত্ত্বেও শাহাদাতের চেতনায় উজ্জীবিত ইরানের ইসলামী বিপ্লবী জনগণের দুর্বার জাগরণকে ঠেকাতে সক্ষম হয়নি। লক্ষাধিক বিপ্লবীর শাহাদাতের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে ইরানের ইসলামী বিপ্লবের বিজয়। আর এই সাফল্যকে অনেকেই অলৌকিক সাফল্যের মত মহাবিস্ময়কর বলে মনে করেন।
ইমাম খোমেনীর যোগ্য আধ্যাত্মিক  ও দূরদর্শী নেতৃত্ব এই মহাবিস্ময়কর বা অলৌকিক সাফল্যের মাধ্যম বা ওয়াসিলা হলেও এর পেছনে মূল শক্তি হিসেবে কাজ করেছে মহান আল্লাহর সহায়তা।  প্রকৃত মুহাম্মাদি ইসলামের অনুরাগী ও অসাধারণ ইমানি শক্তির অধিকারী হওয়ার কারণেই ইরানের ইসলামী বিপ্লবীরা ইমাম খোমেনীর মত সুযোগ্য নেতার নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লবকে সফল করে আধুনিক বস্তুবাদী মতাদর্শগুলোর মোকাবেলায় ইসলামকে আবারও চ্যালেঞ্জিং শক্তি হিসেবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়। এ বিপ্লবের সাফল্য ছিল তৎকালীন বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তি ও এখনও বিশ্বের সবচেয়ে বড় মোড়ল হওয়ার দাবিদার মার্কিন সাম্রাজ্যাবাদের ওপর বড় ধরনের চপেটাঘাত। 
এ প্রসঙ্গে মরহুম ইমাম খোমেনী (র) তাঁর ওসিয়তনামায় লিখেছেন: 

'এরচেয়ে সুখবর আর গৌরবের বিষয় কী হতে পারে যে, বিশ্বের নির্যাতিত ও পশ্চাদপদ বিপুল বৈভবের উপর একচ্ছত্র অধিকার, সামরিক শক্তি, বিভিন্ন পুতুল সরকারের সমর্থন এবং প্রচারমাধ্যমগুলোর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা পেয়েও আমেরিকার সরকার তার সকল নির্জলা মিথ্যা দাবি নিয়ে বাহাদুর ইরানী জাতি এবং হযরত বাকিয়াতুল্লাহ তথা ইমাম মাহদির (আ.) (তাঁর পবিত্র আগমনে আমাদের জীবনসমূহ কুরবান হোক) দেশ ইরানের মোকাবেলায় এমনভাবে পর্যুদস্ত ও লাঞ্ছিত হয়েছে যে, এরপর কোন্ উপায় অবলম্বন করতে হবে সে জ্ঞান পর্যন্ত তার (আমেরিকার) লোপ পেয়ে গেছে। অতঃপর সে যার কাছেই যায় তার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়। এটা সম্ভব হত না মহাপ্রভু আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের গায়েবি মদদ ছাড়া। যিনি জাতিগুলোকে বিশেষভাবে ইরানী জাতিকে জাগ্রত করেছেন, তাদেরকে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের ঘোর অন্ধকার থেকে উদ্ধার করে ইসলামের পবিত্র নূরে করেছেন আলোকিত।

এহেন সন্ধিক্ষণে মযলুম মহান জাতিগুলো এবং প্রিয় ইরানী জাতির প্রতি আমার অসিয়ত, তাঁরা যেন নাস্তিক প্রাচ্য বা অত্যাচারী কাফের পাশ্চাত্যের কোন পথই অনুসরণ না করেন। একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রদত্ত সিরাতুল মুস্তাকীমে স্থির সংকল্প, দৃঢ়চিত্ত ও আনুগত্যের সাথে অবিচল থাকেন। খোদার নিয়ামতের শোকর আদায় করতে মুহূর্তের জন্য যেন উদাসীন না হন এবং পরাশক্তিগুলোর দোসরদের নাপাক হাতগুলোকে প্রশ্রয় না দেন- তারা বিদেশি হোক বা দেশি- যারা বিদেশি দুশমনদের চেয়েও জঘন্যতম এবং এরা যেন আপনাদের নিয়তের পবিত্রতা এবং দৃঢ় সংকল্পের মধ্যে কোনরকম নাড়া দিতে না পারে। আপনাদের জেনে রাখা উচিত যে, আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমগুলো যতই আপনাদের বিরুদ্ধাচরণ করবে ততই আপনাদের খোদায়ী শক্তি প্রস্ফুটিত হবে এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদেরকে (পরাশক্তিগুলো ও তাদের দোসরদেরকে) ইহজগত ও পরজগত উভয় জগতেই শাস্তি বিধান করবেন। নিশ্চয়ই তিনি সকল নিয়ামতের সর্বময় কর্তা, ‘তাঁর অধিকারেই সকল কিছুর কর্তৃত্ব’ (আল-কোরআন ২৩ : ৮৮)।'  
ইরানের ইসলামী বিপ্লব-পূর্ব পরিস্থিতির সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরে ইসলামী বিপ্লবের অলৌকিকতা ও অদৃশ্য খোদায়ি সাহায্যের বিষয়টি তুলে ধরে এ মহান বিপ্লবের বিশ্ববিশ্রুত কাণ্ডারি ইমাম খোমেনী (র) তাঁর ওসিয়তনামায় আরও লিখেছেন, 
 ইরানের বুক থেকে বিশ্বগ্রাসী আর স্বৈরাচারীদের প্রভাবকে খতম করে আল্লাহ তাআলার গায়েবি মদদের মাধ্যমে এই ইসলামী মহা-বিপ্লব বিজয় লাভ করেছে। বিশেষ করে বর্তমান শতাব্দীর প্রাক্কালে ইসলাম ও আলেম-সমাজের বিরুদ্ধে যখন ব্যাপক প্রচারণা চলছে, যখন বিভিন্ন জনসভা আর প্রচারমাধ্যমগুলোয় জাতীয়তাবাদের ধুয়া তুলে বাকপটু প্রচারকরা অসংখ্য বিভেদমূলক টিটকারি প্রচারে তৎপর, যখন চারদিকে অশ্লীল কবিতা ও লজ্জাহীনতায় ভরা রচনার ঢেউ উপচে পড়ার পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক ও বিচিত্র প্রকারের গণিকালয়, জুয়ার আড্ডা, শুঁড়িখানা, অবৈধ ক্লাব ও মাদকদ্রব্যের ছড়াছড়ি- এ সবগুলোই দেশের যুবসমাজ-যারা আমাদের দেশের প্রিয় ভবিষ্যত, অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি -তাদেরকে দুর্নীতি, ধ্বংস, শাহ ও শাহের অসভ্য পিতার বিশ্বাসঘাতকতামূলক কার্যকলাপের অনুকূলে ঠেলে দিচ্ছিল; যখন শক্তিধর বিদেশি দূতাবাসগুলোর পক্ষ থেকে আয়োজিত সভা-মজলিসগুলো জাতির উপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছিল, যখন সর্বাধিক জঘন্য অবস্থায় নিপতিত সকল স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে-যেগুলোর উপর দেশের ভাগ্য নির্ভরশীল-পাশ্চাত্যঘেঁষা বা প্রাচ্যঘেঁষা সম্পূর্ণরূপে ইসলাম ও ইসলামী সংস্কৃতি, এমনকি জাতীয়তাবাদের নামে সঠিক জাতীয়তাবাদবিরোধী শিক্ষক ও অধ্যাপকরা শয়তানি চর্চায় রত ছিল, আর যেসব নিষ্ঠাবান ও দরদি শিক্ষক-অধ্যাপক ইসলামের ন্যায় ও সত্য প্রচারে সচেষ্ট ছিলেন তাঁদেরকে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় আবদ্ধ করে রেখেছিল, ফলে সংখ্যাল্পতার দরুন এই সৎলোকদের পক্ষে কিছুই করা সম্ভব ছিল না।

তাছাড়া সে সময় যখন দেশের আলেম-সমাজকে শাহের স্বৈরাচারী সরকার কোন জাতীয় বা রাষ্ট্রীয় কাজে অংশগ্রহণ করতে দিত না এবং জোরপূর্বক তাদের অনেকের মতাদর্শকে বিকৃত করার অপপ্রয়াসে লিপ্ত ছিল, এরকম পরিস্থিতিতে ৩৬ মিলিয়ন ইরানী জনতার পক্ষে একই স্লোগান এবং পতাকাতলে সমবেত হয়ে, একই লক্ষ্যের ভিত্তিতে ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি দিয়ে, চোখধাঁধাঁনো ও মোজেযাপূর্ণ কুরবানির মাধ্যমে ক্ষমতাসীন সরকারকে উৎখাত এবং বিদেশি শক্তিগুলোকে তাড়িয়ে দিয়ে দেশের ভাগ্যকে নিজেদের হাতে তুলে নেয়া কোনক্রমেই সম্ভব হতো না মহান আল্লাহর গায়েবি সাহায্য ছাড়া। সন্দেহ নেই যে, ইরানের ইসলামী বিপ্লব এবং এর সূচনা, প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য অন্যান্য বিপ্লব থেকে সম্পূর্ণরূপে আলাদা, একেবারে স্বতন্ত্র। নিঃসন্দেহে এই দেশে এই বিপ্লব মহান আল্লাহ্ তাআলার এক ঐশী উপঢৌকন ও গায়েবি হাদিয়া যা এই লুণ্ঠিত, অত্যাচারিত জাতিকে তিনি দান করেছেন।#

পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/০২

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ