ফেব্রুয়ারি ০৬, ২০২১ ০১:০০ Asia/Dhaka

ইরানের ইসলামী বিপ্লবের আরেকটি বড় সাফল্য হল মুসলিম বিশ্বের জন্য সর্বোচ্চ জরুরি বিষয় হিসেবে ইসলামী ঐক্যের গুরুত্ব তুলে ধরা।

বিগত প্রায় দুই শতকে যারা ইসলামী জাগরণের জন্য কাজ করেছেন তাঁদের কেউ কেউ বৃহত্তর ইসলামী ঐক্যের ওপর বিশেষ জোর দিয়ে আসলেও কেউই ইরানের ইসলামী বিপ্লবের রূপকার মরহুম ইমাম খোমেনীর মত ব্যাপক পরিসরে ইসলামী ঐক্যের বাস্তব ও কার্যকর কর্মসূচী নিয়ে অগ্রসর হতে পারেননি। যেমন, সাইয়্যেদ জামালউদ্দিন আসাদাবাদী -যাকে কেউ কেউ সাইয়্যেদ জামালউদ্দিন আফগানিও বলে থাকেন- তিনি মুসলিম জাতিগুলোকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করতেন। সাইয়্যেদ জামালের মৃত্যুর পর ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ভারতের এবং ইরান-ইরাক অঞ্চলের সুন্নি ও শিয়া মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা রেখেছেন ঠিক যেভাবে ক্রুসেডের কোনো কোনো যুদ্ধেও সব মুসলিম সম্প্রদায় ও মাজহাব ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেছিল। 
অবশ্য ইসলামের ইতিহাসের তিক্ত ও দুঃখজনক শিক্ষা হল এটা যে যখনই মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারেনি তখনই তারা ক্রুসেডের কোনো কোনো যুদ্ধসহ নানা হামলার মুখে ব্যাপক পরাজয় এবং হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছে। ইউরোপীয় শক্তিগুলোর হাতে স্পেনে মুসলমানদের পতন, মোঙ্গলদের হাতে  বাগদাদের পতন, সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেন ও তার মিত্রদের হাতে বৃহত্তর ওসমানি বা অটোম্যান সাম্রাজ্যের পতন,  রুশদের হাতে মধ্য এশিয়ায় এবং ভারতেও ব্রিটেনের হাতে মুসলিম শাসনের অবসান এর দৃষ্টান্ত। মোঙ্গল হামলায় বাগদাদের পতনের আগে মুসলিম মাজহাবগুলোর নানা গ্রুপ খুব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে দলাদলি ও হানাহানিতে লিপ্ত হত। শিয়া-সুন্নি বিরোধ ছাড়াও সুন্নি মাজহাবগুলোর মধ্যেও এ ধরনের ধ্বংসাত্মক দলাদলি ও হানাহানির অনেক ঘটনা ঘটেছে যা বাইরের শত্রুর মোকাবেলায় মুসলমানদের দুর্বল করেছিল ও পরিণতিতে বিজাতীয় ও বিধর্মী শত্রুদের হাতে সব মুসলিম সম্প্রদায়কেই লাঞ্ছিত হতে হয়েছে।
 ইতিহাসের এতসব তিক্ত অভিজ্ঞতার ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়েছেন যুগে যুগে বড় বড় আলেম বা ইমাম, চিন্তাবিদ ও সংস্কারকরা। মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুড বা ইখওয়ানুল মুসলিমিনের প্রতিষ্ঠাতা হাসানুল বান্নার মত দূরদর্শী চিন্তাবিদও শিয়া-সুন্নি দলাদলি থেকে দূরে থাকতে বলতেন এবং বলতেন যে এ দুই সম্প্রদায়ই মুসলমান ও তাদের মধ্যে ঐক্য বজায় রাখাটা জরুরি। পরবর্তীকালে মিশরের প্রখ্যাত আলেম ও আলআজহাবেরর সাবেক প্রধান শেইখ শালতুত শিয়া মুসলিম মাজহাবকে সুন্নিদের চার মাজহাবের মতই একটি মাজহাব বলে ফতোয়া দিয়েছেন এবং যে কোনো মুসলমান ১২ ইমামি ও জাইদি শিয়া মুসলমানদের রীতি-নীতি অনুসরণ করতে পারেন বলেও তিনি ফতোয়ায় উল্লেখ করেন! 
মুসলিম মাজহাবগুলোর ঐক্যকে সুদৃঢ় করতে ইমাম খোমেনী (রা) অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছেন। তিনিই সর্বপ্রথম মুসলমানদের প্রথম কিবলা উদ্ধারের জন্য বিশ্ব-কুদস দিবসের প্রচলন ঘটান এবং দুঃখ করে বলতেন, আরব দেশগুলোর জনগণ যদি এক বালতি করেও পানি ঢালতো তাহলে দখলদার ইসরাইল ভেসে যেত! ইমাম খোমেনী (র) শিয়া-সুন্নি মতভেদকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের বিরুদ্ধে উম্মাহকে বার বার সতর্ক করেছেন বিভিন্ন উপলক্ষ্য ও পর্বকে সামনে রেখে। তার মতে পবিত্র হজকে মুসলমানদের সব সমস্যার সমাধানে ব্যবহার করা সম্ভব এবং তা হজ্বেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। 
সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোই শিয়া-সুন্নি মতভেদকে অপব্যবহার করে তা থেকে ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করে আসছে বলে ইমাম খোমেনী (র) বার বার সতর্ক করে আসছেন। বিশেষ করে তিনি ব্রিটেনের অনুরাগী শিয়া ও মার্কিন সরকারের দোসর সুন্নিদের চক্রান্তের ব্যাপারে বিশ্ব-মুসলিমকে বার বার সতর্ক করেছেন। তিনি ইসলামী ঐক্যের ও সম্প্রীতির নিদর্শন দেখিয়ে বাংলাদেশের বিশিষ্ট সুন্নি আলেম হাফেজজি হুজুরের পেছনে নামাজ পড়েছেন এবং শিয়া মুসলমানদেরকে সুন্নি অধ্যুষিত অঞ্চলে সুন্নি ইমামদের পেছনে নামাজ আদায়ের আহ্বান জানিয়েছেন। 
ইমাম খোমেনীর পর ইরানের বর্তমান সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী সুন্নি মুসলমানদের কাছে সম্মানিত ব্যক্তিদের অবমাননা করাকে হারাম বলে ফতোয়া দিয়েছেন। 
প্রায় দুই শতাব্দি আগে মুসলমানের ছদ্মবেশধারী ব্রিটিশ গোয়েন্দা হ্যাম্পার তুরস্ক, ইরান-ইরাক ও ভারত সফর করে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকারকে এ পরামর্শ দেয় যে মুসলমানদেরকে দুর্বল করে রাখতে হলে শিয়া-সুন্নি বিরোধকে নানা ক্ষেত্রে টেনে আনা হচ্ছে সবচেয়ে সহজ ও মোক্ষম উপায়! এই ব্রিটিশ গোয়েন্দাই ওয়াহাবি ফের্কার প্রধান আবদুল ওয়াহ্‌হাবকে নানাভাবে সহায়তা করেন যাতে মুসলমানরা এক নতুন সংকটের শিকার হয়। এ ছাড়াও মুসলমানদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টির লক্ষ্যেই ব্রিটেন ও ইহুদিবাদীদের মদদে গড়ে তোলা হয় কাদিয়ানি ও বাহাই মতবাদ। 
সাম্রাজ্যবাদী কয়েকটি শক্তি ও তাদের অনুচর সরকারগুলো ইরানের ইসলামী বিপ্লবের বদনাম করার জন্য শিয়া মুসলিম মাজহাবের সঙ্গে সুন্নি মুসলিম মাজহাবের মতপার্থক্যকে অপব্যবহারের যে চেষ্টা করছে সে প্রসঙ্গে বিশিষ্ট সমাজ-বিজ্ঞানী ও ইসলামী চিন্তাবিদ ডক্টর রাশিদ বেনআইসসা বলেছেন, 

তথাকথিত শিয়া-সুন্নি সমস্যা খুবই পরিকল্পিত বিষয়। প্রায় এক হাজার সুন্নি আলেমের অংশগ্রহণে ১৯৭২ সালে তেহরানে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এক বড় সম্মেলন। সম্মেলনটি হয়েছিল আট নয়'শ বছর আগের বিশিষ্ট শিয়া মুসলিম বিজ্ঞানী শেখ তুসির স্মরণে। আল্লামা মওদুদিসহ যারা আসতে পারেননি তাদের অনেকেই এই সম্মেলনে প্রবন্ধ পাঠিয়েছিলেন। সে সময়কার বড় কোনও বইয়ে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বের বিষয়ে কোনও কথা দেখা যেত না।
দশকের পর দশক ধরে ক্ষমতায়-থাকা ইরানের শাহ ছিলেন শিয়া। আর এ বিষয়টি সবাই জানত।
সেযুগে সব মুসলিম দেশেই ছিল কমিউনিস্ট পার্টি। এসব দল সংসদেও ছিল গ্রহণযোগ্য। তারা আল্লাহ বা ঈশ্বরেই বিশ্বাস করতো না...। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদেরকে স্বীকৃতি দেয়া হত।
৯০০ জন আলেমের অংশগ্রহণে ১৯৭৭ সনের ২৭ আগস্টে লন্ডনের কিংস্টন হোটেলে ২৫ দিন ধরে-চলা একটি ধর্মীয় সম্মেলনের যার যৌথ আয়োজক ছিল মার্কিনপন্থী শিয়া ইরান সরকার ও মার্কিনপন্থী সুন্নি সৌদি সরকার। মুসলিম বিশ্বের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করলেও তাদের আলোচনায় শিয়া-সুন্নি মতভেদের প্রসঙ্গটিই একবারের জন্যও আমি শুনিনি।
ডক্টর রাশিদ বেনআইসসা আরো বলেছেন, এর ঠিক এক বছর পর ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইরানে ঘটে যায় ইসলামী বিপ্লব। এ সময় সৌদি সরকার শুরু করে  শিয়া ও ইরান-বিরোধী প্রচারণা। শিয়া মাজহাব যেন একটি ‘অবৈধ’ মাজহাব এবং তা রিয়াদ-তেহরান সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, আর এই বাধা দূর করতে হবে! সৌদি জনসংখ্যার এক উল্লেখযোগ্য অংশও শিয়া মুসলমান।
এই প্রেক্ষাপটে ইমাম খোমেনীর নেতৃত্বে ইরান ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। এর মাধ্যমে আরব সরকারগুলোকে তাদের  দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়। আর এ জন্যই শুরু হয় আরব মুনাফিক সরকারগুলোর ইরান-বিরোধী সম্মিলিত কোরাস ও হৈ-চৈ। খোমেনীর ইসরাইল-বিরোধী অবস্থানই তাদের বিরক্ত ও অসন্তুষ্ট করে। এই সরকারগুলো সুন্নি ফিলিস্তিনিদের জন্য কিছুই করতে চায়নি ও এখনও তাদের জন্য কাজ করতে চায় না। বরং তাদের অধিকারকে ঠেকিয়ে রাখতে চায়।#

পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/০৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ