ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২১ ১৯:৩০ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা কথা বলার চেষ্টা করেছি ইরানের বিদ্যুৎ শিল্প নিয়ে। একথা অনস্বীকার্য যে বিশ্বব্যাপী আজ গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো বিদ্যুৎ সমস্যা।

বিভিন্ন সমাজে জীবন মানের উন্নয়ন ও স্থায়ী উৎকর্ষের পেছনে বিদ্যুতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাই বিদ্যুত চাহিদা নিশ্চিত করা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য একটি মৌলিক বিষয়।

ইরানে নির্মাণ সামগ্রির জন্য প্রয়োজনীয় অত্যাবশ্যক উপাদান সিমেন্ট শিল্পও বেশ সমৃদ্ধ। কোনো একটি ভবনের ভিত্তি মজবুত করার জন্য যেমন সিমেন্ট গুরুত্বপূর্ণ তেমনি ইরানসহ বেশিরভাগ দেশেরই অর্থনীতির ভিত মজবুত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম বা উপাদান হলো সিমেন্ট শিল্প। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সিমেন্টের উৎপাদনের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। সিমেন্টকে তাই "অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বিকাশের মৌলিক উপাদান" বলে অভিহিত করা হয়। এ কারণে শিল্পোন্নত দেশসহ পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই সিমেন্টকে একটি কৌশলগত পণ্য হিসেবে গণ্য করা হয়। আমরা আজকের আসরে এই সিমেন্ট শিল্প এবং ইরানে সিমেন্ট শিল্পের নানাদিক নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করবো।

উনিশ শ আশির দশকের পর বেশ কয়েকজন অর্থনীতিবিদ অর্থনৈতিক সূচক কাজে লাগিয়ে বিশ্বের দেশগুলোর অর্থনৈতিক কল্যাণ ও উন্নয়ন পরিমাপ করার চেষ্টা চালিয়েছেন। ম্যাক গ্র্যানাহান ওই অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বিকাশ পরিমাপ করার জন্য খুবই ভারসাম্যপূর্ণ সূচকের মডেল প্রদর্শন করেন।মানবীয় উন্নয়ন, জীবনের আশা আকাঙ্ক্ষা, প্রশিক্ষণ ইত্যাদির মতো সূচকগুলোর পাশাপাশি সিমেন্ট উৎপাদনের পরিমাণকেও বিভিন্ন দেশের উন্নয়ন ও বিকাশের তুলনামূলক পরিমাপের সূচক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। বর্তমানে বিশ্বে সিমেন্ট ভবন নির্মাণসহ সামগ্রিক অর্থে নির্মাণ কাজের মৌলিকতম একটি উপাদান হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। উন্নয়ন ও নির্মাণ পরিকল্পনার পূর্ব প্রস্তুতির প্রয়োজনীয় উপাদান হলো সিমেন্ট। কারো কারো দৃষ্টিতে স্টিলের আগেও সিমেন্টের গুরুত্ব বেশি।

সিমেন্ট হল গুড়া জাতীয় এক ধরনের পদার্থ যাদেরকে পানি বা অন্য কোন তরলের সাথে মিশ্রিত করলে কাদার মত নরম পদার্থ পাওয়া যায়। ওই কর্দমাক্ত পদার্থ কিছু সময়ের মধ্যে জমে গিয়ে একদম দৃঢ় ও শক্ত পদার্থে পরিণত হয়ে যায়। সিমেন্ট বাড়ী-ঘর, রাস্তা, সেতু ইত্যাদি যাবতীয় নির্মাণ কাজের প্রধান উপাদান। সিলিকন অক্সাইড, অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড এবং আয়রন অক্সাইডযুক্ত ক্যালসিয়াম অক্সাইডের গলিত মিশ্রণ থেকে এই সিমেন্ট পাওয়া যায়। নির্দিষ্ট পরিমাণে শেল বা মাটির সাথে চুনাপাথর কিংবা চক মিশ্রণ করে সিমেন্ট তৈরি করা হয়। এই মিশ্রণটি  চৌদ্দ শ পঞ্চাশ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় পোড়ানো হয়। উত্তাপের কারণে উপাদানগুলি আংশিকভাবে বল-এর আকারে পরিণত হয়, যেটা ক্লিঙ্কার নামে পরিচিত।

বিরতির পর আবারও স্বাগত আপনাদের ইরানি পণ্য সামগ্রী অনুষ্ঠানে। বলছিলাম ক্লিঙ্কারের কথা। ক্লিঙ্কার ঠান্ডা হয়ে গেলে তার সাথে কিছু জিপসাম যুক্ত করা হয় এবং পিষে সূক্ষ্ম গুঁড়োয় পরিণত করা হয়। এর ফলে যে পণ্যটি পাওয়া যায় সেটাই সিমেন্ট। সিমেন্ট হল হাইড্রোলিক বাইন্ডার যা বাড়ির কাঠামো তৈরি করতে ইট, বালি এবং পাথরের চিপগুলির সঙ্গে বাবহার করা হয়। সিমেন্ট বিল্ডিং উপকরণগুলিকে আবদ্ধ করে। পানি যুক্ত হলেই সিমেন্ট-এর প্রভাব কার্যকর হয় মানে সিমেন্ট দৃঢ়ভাবে আটকে ফেলে সংশ্লিষ্ট বস্তুকে। প্রাচীন বিল্ডিংয়ের ধ্বংসাবশেষ, ঐতিহাসিক প্রত্ন নিদর্শনাদি এবং প্রত্নতাত্ত্বিকদের আবিষ্কার ও গবেষণা থেকে দেখা যায় রোমানরা প্রথম সিমেন্ট তৈরির সূচনা করেন।

রোমানরাই প্রথম বেকড চুন এবং পোজোলনিক উপাদান একত্রিত করে সিমেন্ট তৈরির সূচনা করেছিল। তাদের ওই নতুন পণ্যটি আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে নির্মাণকাজ বিশেষ করে পাণিতে ব্রিজ তৈরি করা, বাঁধ নির্মাণ করা ইত্যাদির মতো নির্মাণ কাজের চাহিদা পূরণে ব্যাপক ভূমিকা রাখে এই সিমেন্ট। সমুদ্রে জেটি নির্মাণসহ ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে সিমেন্ট নিয়ে আসে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। বর্তমানে সমগ্র বিশ্বে অন্তত ত্রিশ প্রকারের সিমেন্ট উৎপাদন হচ্ছে। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্বে অন্তত চার শ কোটি টন সিমেন্ট উৎপাদিত হয়েছে। এই বিশাল উৎপাদনের অর্ধেকেরও বেশি ব্যবহৃত হয়েছে চীনে।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে বিশ্বে চীনই হলো সবচেয়ে বেশি সিমেন্ট উৎপাদনকারী দেশ এবং একইসঙ্গে সবচেয়ে বেশি সিমেন্ট ব্যবহারকারী দেশ। তবে উৎপাদনের পরিমাণের দিক থেকে ইরানের অবস্থানও উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে রয়েছে। অন্তত দশটি প্রথম সারির সিমেন্ট উৎপাদনকারী দেশের তালিকায় রয়েছে ইরানের নামও। ইতিহাসের সাক্ষ্য অনুসারে, বিল্ডিং নির্মাণ উপকরণ  নিয়ে গবেষণা ও আবিষ্কার এবং প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে ইরানীদেরও দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ইরানের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রাচীন নিদর্শনগুলি যেমন পার্সিয়ান উপসাগরীয় বাতিঘর বা উপকূলে নির্মিত বাঁধসহ অন্যান্য স্থাপনা ইত্যাদি চুন এবং মাটির উপকরণের সংমিশ্রণে তৈরি। এগুলোই প্রমাণ করে যে সিমেন্টের ক্ষেত্রে ইরানিদের বৈজ্ঞানিক অবদান অনস্বীকার্য। একটু আগেই বলছিলাম যে নির্মাণ সামগ্রীর বিভিন্ন উপাদানের ক্ষেত্রে ইরানিদের রয়েছে ব্যাপক অবদান।

ইরান দেশটি ভৌগোলিক দিক থেকে এমন একটি অঞ্চলে পড়েছে যে এখানে রয়েছে অসংখ্য পর্বতমালা। সেসব পর্বতমালার কোনো কোনোটির বুকে রয়েছে চুনের প্রাকৃতিক মজুদ। সুতরাং সিমেন্ট তৈরির মৌলিক উপাদানগুলো ইরানের অভ্যন্তরেই প্রচুর পরিমাণে রয়েছে। ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে ইরানে প্রথম সিমেন্ট কারখানা স্থাপিত হয়েছিল। এই সিমেন্ট কারখানার জন্য প্রয়োজনীয় নির্মাণ সামগ্রীর মজুদ নির্ধারণের জন্য প্রাথমিক গবেষণা ও সমীক্ষা করা হয়েছিল। পাঁচ বছর পর সিমেন্ট কারখানাটি উৎপাদনে যেতে সক্ষম হয়েছিল। তেহরানের অদূরে আনুমানিক সাত কিলোমিটার দক্ষিণে বিবি শাহরবানু নামক পাহাড়ের কাছে ইরানের প্রথম সিমেন্টের কারখানাটি গড়ে উঠেছিল। ইরানের রেই সিমেন্ট নামের একটি কোম্পানি প্রথমবারের মতো সিমেন্ট উৎপাদনে সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছিল।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/ মো:আবু সাঈদ/ ১৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।