ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০২১ ২০:১০ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র এ পর্ব থেকে সূরা গাফির বা মু’মিনের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। মক্কায় অবতীর্ণ এ সূরার আয়াত সংখ্যা ৮৫। অন্যান্য মাক্কী সূরার মতো এই সূরায়ও মূলত তৌহিদ, নবুওয়্যাত ও আখিরাতের মতো ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসগত বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

এই সূরার তিন নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালার অন্যতম গুণবাচক নাম ‘গাফির’ বা 'পাপ ক্ষমাকারী' উল্লেখ করা হয়েছে বলে এই সূরার নাম রাখা হয়েছে গাফির। অবশ্য এ সূরার প্রায় ২০টি আয়াতে ফেরাউনের বংশের একজন মুমিন ব্যক্তির ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে বলে এটিকে সূরা মুমিনও বলা হয়। এই সূরার প্রথম তিন আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

حم (1) تَنْزِيلُ الْكِتَابِ مِنَ اللَّهِ الْعَزِيزِ الْعَلِيمِ (2) غَافِرِ الذَّنْبِ وَقَابِلِ التَّوْبِ شَدِيدِ الْعِقَابِ ذِي الطَّوْلِ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ إِلَيْهِ الْمَصِيرُ (3)

“হা-মীম।” (৪০:১)

“মহাপরাক্রমশালী সর্বজ্ঞানী আল্লাহর পক্ষ থেকে এই কিতাব নাযিলকৃত।” (৪০:২)

“তিনি পাপ ক্ষমাকারী, তাওবা কবুলকারী, কঠোর আযাবদাতা এবং অপরিমিত অনুগ্রহ বর্ষণকারী। তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং সকলের প্রত্যাবর্তন তার দিকেই।” (৪০:৩)

পবিত্র কুরআনের আরো ২৮টি সূরার মতো এই সূরাও হুরুফে মুকাত্তায়াত দিয়ে শুরু হয়েছে। আগের অনেক সূরার তাফসিরে আমরা বলেছি, পরবর্তী আয়াতের বিষয়বস্তু অনুযায়ী এসব হরফের মাধ্যমে মহান আল্লাহর বিশালত্ব বর্ণনা করা হয়। অর্থাৎ মহাপ্রজ্ঞাবান ও পরাক্রমশালী আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিল হওয়া এই মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের আয়াতগুলো এসব হরফেরই সমষ্টি। অথচ এসব হরফ একত্রিত করে কোনো মানুষের পক্ষে এরকম একটি আয়াত সৃষ্টি করা সম্ভব নয়।

সূরার দ্বিতীয় আয়াতে মহান আল্লাহর অসংখ্য গুণবাচক নামের মধ্য থেকে পাঁচটি নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলোতে যেমন রয়েছে সুসংবাদ তেমনি রয়েছে সতর্কবাণী। একদিকে গুনাহগার বান্দাকে এই আশা দেয়া হয়েছে যে, যদি কায়মনোবাক্যে তওবা করো তাহলে আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করে দেবেন। অন্যদিকে তাদেরকে এই হুঁশিয়ারিও দেয়া হয়েছে যে, যদি গুনাহ করতেই থাকো এবং আল্লাহর দেয়া সীমারেখা লঙ্ঘন করো তাহলে তোমাদের জন্য কঠিন শাস্তি অপেক্ষা করছে।

পরের আয়াতে বলা হয়েছে, যে আল্লাহ মানুষকে সকল নেয়ামত দান করেছেন তিনিই কেবল মাবুদ এবং ইবাদতের যোগ্য; তিনি ছাড়া উপাসনা পাওয়ার যোগ্য অন্য কোনো ইলাহ নেই। এ ছাড়া, মৃত্যুর পর যে তাঁর কাছে ফিরে গিয়ে সকল কাজের হিসাব দিতে হবে সেকথাও এই আয়াতে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে।

এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- কুরআন মহান আল্লাহর বাণী যা মানুষের বোধগম্য করে নাজিল করা হয়েছে।

২- এই কুরআনে আল্লাহর সীমাহীন জ্ঞানের  অংশবিশেষ তুলে ধরা হয়েছে। এর সামনে মানুষের যুক্তি-বুদ্ধি অচল।

৩- মানুষের উৎস ও চূড়ান্ত পরিণতি বর্ণনা করার জন্য কুরআন নাজিল হয়েছে।  মানুষ যাতে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায় খুঁজে পাওয়ার পর সেই পথে অগ্রসর হয় সেজন্যই এই মহাগ্রন্থ নাজিল করেছেন আল্লাহ তায়ালা।

সূরা গাফিরের ৪ থেকে ৬ নম্বর পর্যন্ত আয়াতে বলা হয়েছে:

مَا يُجَادِلُ فِي آَيَاتِ اللَّهِ إِلَّا الَّذِينَ كَفَرُوا فَلَا يَغْرُرْكَ تَقَلُّبُهُمْ فِي الْبِلَادِ (4) كَذَّبَتْ قَبْلَهُمْ قَوْمُ نُوحٍ وَالْأَحْزَابُ مِنْ بَعْدِهِمْ وَهَمَّتْ كُلُّ أُمَّةٍ بِرَسُولِهِمْ لِيَأْخُذُوهُ وَجَادَلُوا بِالْبَاطِلِ لِيُدْحِضُوا بِهِ الْحَقَّ فَأَخَذْتُهُمْ فَكَيْفَ كَانَ عِقَابِ (5) وَكَذَلِكَ حَقَّتْ كَلِمَةُ رَبِّكَ عَلَى الَّذِينَ كَفَرُوا أَنَّهُمْ أَصْحَابُ النَّارِ (6)

“কাফিররা ছাড়া আর কেউ আল্লাহর আয়াতসমূহ নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হয় না। সুতরাং দেশে দেশে তাদের অবাধ বিচরণ যেন তোমাকে ধোঁকায় না ফেলে।” (৪০:৪)

“এদের পূর্বে নূহের জাতি এবং তাদের পরে অনেক দলও (তাদের নবীদের) অস্বীকার করেছিল। প্রত্যেক উম্মতই স্ব স্ব রাসূলকে পাকড়াও (ও নির্যাতন) করার সংকল্প করেছিল এবং তারা অসার বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিল সত্যকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু আমি তাদেরকে (নিজের ক্রোধের দ্বারা)  পাকড়াও করলাম। সুতরাং (দেখো) কেমন ছিল আমার আযাব!" (৪০:৫)

“আর এভাবে কাফিরদের ক্ষেত্রে তোমার রবের এই প্রতিশ্রুতি অলঙ্ঘনীয় সত্যে পরিণত হল যে, তারা জাহান্নামী।” (৪০:৬)

এই আয়াতগুলোতে বিশ্বনবী (সা.) এবং মুসলিম উম্মাহকে এই বলে সান্ত্বনা দেয়া হয়েছে যে, একদল কাফের যদি তোমাদের দ্বীনের মোকাবিলায় দাঁড়িয়ে যায় এবং পৃথিবীর বুক থেকে সত্যের আলো নিভিয়ে ফেলতে চায় তাহলে তোমরা হতাশ ও হীনবল হয়ো না। কারণ, ইতিহাসের দীর্ঘ পরিক্রমায় এ ধরনের অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে।  যুগে যুগে কাফেররা শুধু সত্য ধর্মের অনুসারীদের বিরুদ্ধে নয় সেইসঙ্গে আল্লাহর নবীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। তারা ঐশী ধর্মের নবীগণ ও তাঁদের অনুসারীদেরকে পৃথিবীর বুক থেকে চিরবিদায় করার লক্ষ্যে নানারকম ষড়যন্ত্র ও কর্মকৌশল প্রণয়ন করেছে।

বর্তমান যুগেও আমরা দেখতে পাই, আধিপত্যকামী ও জালিম শক্তিগুলো নানা ধরনের রাজনৈতিক ও সামরিক তৎপরতা চালিয়ে, বলপ্রয়োগ ও হুমকি প্রদর্শনের মাধ্যমে বিশ্বের জাতিগুলোকে নিজেদের পদতলে রেখে দিতে চায়। কিন্তু এ ধরনের অপতৎপরতার ব্যাপারে মুমিনদেরকে সতর্ক থাকতে হবে। তারা যেন শত্রুদের এ ধরনের ভীতি প্রদর্শনকারী তৎপরতায় শঙ্কিত না হয়। মুমিনরা যেন আধিপত্যকামী শক্তিগুলোর বাহ্যিক চাকচিক্য ও হুমকি-ধমকির ভয়ে তাদের কাছে আত্মসমর্পন না করে।

অবশ্য এ ধরনের দাম্ভিক ব্যক্তিকে যুগে যুগে নিজেদের শক্তিমত্তা প্রদর্শন করতে দেখা গেছে। কিন্তু তারা আল্লাহ তায়ালার কঠিন শাস্তির সামনে যে কতটা অসহায় তাও প্রমাণিত হয়েছে। নিঃসন্দেহে দিনের শেষে সত্যের বিজয় অবশ্যম্ভাবী। দাম্ভিক ব্যক্তিরা যত বেশি অপরাধ করবে এই দুনিয়া ও আখেরাতে তারা তত বেশী ঐশী শাস্তির সম্মুখীন হবে।

এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- সত্যের সঙ্গে যেকোনো ধরনের তর্কবিতর্ক বা যুদ্ধ/ কুফর থেকেই উৎসারিত হয়। আমরা যেন কখানো সত্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে না যাই সেজন্য সদা সতর্ক থাকতে হবে। ক্ষণস্থায়ী পার্থিব জীবনের সামান্য ভোগ উপকরণ যেন আমাদেরকে সত্যের বিরুদ্ধে তর্ক বা যুদ্ধে লিপ্ত করতে না পারে।

২-  আমরা যেন এই আশা না করি যে, পৃথিবীর সব মানুষ ঈমান গ্রহণ করবে। সেইসঙ্গে কাফেরদের চাকচিক্য ও বিত্তবৈভব এবং ক্ষমতা যেন আমাদেরকে হতাশ ও হীনবল করে না দেয়। কারণ, ওদের চাকচিক্য ক্ষণস্থায়ী আর ঈমানদারদের জন্য পারলৌকিক মহা পুরস্কার চিরস্থায়ী।

এই তিন আয়াতের আরো কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে:

৩- কাফির নেতারা সত্যকে দুর্বল করা এবং মুসলমানদের ভয় দেখানোর জন্য নানা ধরনের অপতৎপরতা চালায়।

৪- কাফির ও বাতিল শক্তি নবী-রাসূলগণকে প্রত্যাখ্যান ও তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে। ইসলামকে পৃথিবীর বুক থেকে উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে তারা নানা ধরনের অপতৎপরতা চালায়। যদিও তারা কোনো দিন তাদের এ লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে না।

৫- মহান আল্লাহর একটি অলঙ্ঘনীয় বিধান হচ্ছে অহংকারী ও স্বেচ্ছাচারী কাফেরদের শাস্তি প্রদান করা। অবশ্য এই শাস্তি দেয়া হবে সত্য ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে। #

পার্সটুডে/এমএমআই/এআর/২৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।