ইরানের পণ্যসামগ্রী: চীনামাটির বাসন
গত আসরে আমরা কথা বলার চেষ্টা করেছি ইরানের ফার্নিচার সামগ্রী নিয়ে। বিগত দশকগুলোতে বিশ্বব্যাপী ফার্নিচার শিল্প ইতোপূর্বে তেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ শিল্প হিসেবে বিবেচিত হতো না। কিন্তু এখন বিশ্বের ছোট কিংবা মাঝারি মানের শিল্পের মর্যাদা লাভ করেছে। এর পেছনে যথেষ্ট অবদান রয়েছে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারী সংস্থাগুলোর।
তারা বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর ফার্নিচার শিল্পে বিনিয়োগ করার ব্যাপারে উৎসাহিত করার ফলে ধীরে ধীরে ফার্নিচার শিল্প মর্যাদার আসনে পৌঁছেছে। ইরান থেকে এখন অবশ্য ক্লাসিক্যাল এবং অফিসিয়াল শ্রেণীর ফার্নিচার প্রচুর রপ্তানি করা হয় বিদেশে। বিদেশ বলতে ইরানের প্রতিবেশী দেশ ইরাক, আফগানিস্তানসহ মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর পাশাপাশি পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের আরব দেশগুলোতেও ইরানের ফার্নিচার রপ্তানি হয়। এর বাইরে স্পেন, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং অস্ট্রিয়াতেও রপ্তানি হয় ইরানের ফার্নিচার। বুঝতেই পারা যাচ্ছে ইরানের ফার্নিচারের গুণগত মান খুবই ভালো এবং উন্নত। যাই হোক ফার্নিচারের পর আজ আমরা কথা বলার চেষ্টা করবো আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প নিয়ে। এটি হলো তৈজসপত্র শিল্প। বিশেষ করে ইরানে চীনামাটির বাসন শিল্পের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করবো।
স্বাস্থ্য সম্মত খাবার দাবার মানব সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এ ক্ষেত্রে যথার্থ খাদ্যবস্তু ছাড়াও খাবার পরিবেশন বা ধারণের জন্য স্বাস্থ্যকর উপযুক্ত পাত্রেরও প্রয়োজন পড়ে। চীনামাটির বাসন-কোসন বা তৈজস তেমনি একটি পাত্র যা বিশ্বব্যাপী ব্যাপক সমাদৃতি পেয়েছে তার গুণগত মানের জন্য। এর কারণ হলো স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার দিক থেকে এগুলো বিশ্বমান বজায় রাখতে পেরেছে। চীনা মাটির তৈজসের ইতিহাস বেশ প্রাচীন। খ্রিষ্টপূর্ব কয়েক হাজার বছর আগে থেকে মৃৎ শিল্পের প্রচলন হয়ে এসেছে। খ্রিষ্টপূর্ব তিন শ ত্রিশ থেকে পাঁচ শ পঞ্চাশ সালে ইরানে হাখামানেশিয়দের শাসনামলের আগেও মৃৎশিল্পের চর্চা ছিল। মৃৎশিল্পের মধ্যে মাটির তৈজসের গায়ে নকশা করার বিষয়টিও উল্লেখযোগ্য। এই শিল্পটি ইরান থেকে চীনে গিয়েছিল।
অল্প সময়ের মধ্যেই চীনাদের মাঝে এই শিল্পটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এমনকি তাদের মৃৎ শিল্পীরা উপযুক্ত মাটি আবিষ্কার করে সক্ষম হয়েছে মৃৎপাত্রের জন্য সাদা রঙের খামির তৈরি করতে এবং তা দিয়ে সুদর্শন ও মোলায়েম তৈজস তৈরি করতে। খামির তৈরি করা থেকে শুরু করে পোড়ানো, রঙ লাগানো এবং নকশা করা পর্যন্ত সব কাজই তারা নিপুণভাবে করতে সক্ষম হলো। তাদের নির্মিত সুদর্শন ওই মৃৎশিল্প ধীরে ধীরে 'চীনা' পরিচয়ে পরিচিতি পেল। চীনা মৃৎশিল্পীরা এই ভূখণ্ডের সম্রাটদের জন্য যেসব মৃৎপাত্র তৈরি করতেন সেগুলোকে মজলিসের উপযোগী করে রঙিন ডিজাইন করতেন। শাহদের দরবারে অভ্যর্থনার দৃশ্য, পাখি শিকারের বীরত্বপূর্ণ দৃশ্য কিংবা রাজ পরিবারের কোনো গুরুত্বপূর্ণ সদস্যের ছবি আঁকতেন তারা।

কথা বলছিলাম চীনা মাটির শিল্প নিয়ে। চীনাদের তৈরি মৃৎশিল্প এবং ইরানিদের তৈরি মৃৎশিল্পের দুদেশে আদান প্রদানের মধ্য দিয়ে দেশ দুটির শিল্পের ওপরই পারস্পরিক প্রভাব পড়েছে। ইরানের ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে এমনকি সাফাভি শাসনামলেও মৃৎশিল্পের ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন ও অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। সাফাভি শাসনামলে মৃৎশিল্পের ক্ষেত্রে মিনিয়েচার শিল্পকর্মের কথা বিশিষ্ট ফরাসী পর্যটক শর্দানও তাঁর ভ্রমণ বিষয়ক বইতে উল্লেখ করতে ভোলেন নি। তিনি লিখেছেন: ইরানি মৃৎশিল্পগুলোকে ভুল করে চীনা মৃৎশিল্প পণ্যগুলোর সাথে গুলিয়ে ফেলার আশঙ্কা দেখা দেয়। দুই দেশের মৃৎশিল্প পণ্যের মধ্যে এতো মিল যে একটিকে আরেকটি থেকে আলাদা করাটা প্রায় অসম্ভব।
শারদিন আরও লিখেছেন: কখনও কখনও আপনার কাছে ইরানি মৃৎশিল্প পণ্যগুলোকে সৌন্দর্যের দিক থেকে, পোলিশিং এবং প্রলেপের দিক থেকে চীনের তৈরি একই পণ্যের তুলনায় উন্নত এবং ভাল বলে মনে হবে। বর্তমানে চীনা মাটির শিল্পের জগতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। একটা সময় ছিল যখন এই মৃৎপাত্রগুলো সুনির্দিষ্ট কিছু ক্রেতার জন্য খুবই দক্ষ, অভিজ্ঞ ও নিপুণ শিল্পীদের মাধ্যমে তৈরি হতো। যেহেতু হাতে তৈরি করা হতো সেহেতু পরিমাণে খুব কমই নির্মিত হতো। কিন্তু এখন আর সেই যুগ নেই। আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তিসহ অন্যান্য কারিগরি সুবিধার কল্যাণে বিশ্ব চীনা মাটি পণ্য সামগ্রীতে এসেছে চরম বৈচিত্র্য। প্রকারে, আঙ্গিকে, রঙে, ডিজাইনে, নকশায় ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রেই বৈচিত্র্য এসেছে। আবারও একটু বিরতি নিচ্ছি শ্রোতাবন্ধুরা! সঙ্গে থাকার অনুরোধ রইলো।
চীনা মাটির তৈজস আসলে নিকেলের প্রলেপযুক্ত সিরামিকের বিভিন্ন সেটকেই বোঝায়। পানি শোষণ করার মাত্রা, তাপ সহ্য করার পরিমাণ, আলো নি:সরণের মতো স্বচ্ছতা ইত্যাদির প্রতি লক্ষ্য বিভিন্ন স্তরে এগুলোকে বিন্যস্ত করা হয়। ডিশ ওয়াশিং কিংবা মাইক্রোওভেনে দিলেও সমস্যা হবে না, পড়লে ভাঙবে না ইত্যাদির প্রতি লক্ষ্য রেখে আজকাল মৃৎপাত্রগুলো তৈরি করা হচ্ছে। চীনা মাটির তৈজসপত্র সাধারণত এক হাজার চৌদ্দ ডিগ্রি তাপমাত্রায় পোড়ানো হয় যার ফলে স্বাস্থ্য ও সুস্থতার দিক থেকে এগুলো যথাযথ মানের হয়। যে-কোনো রকমের খাবার দাবারই এইসব তৈজসে পরিবেশন করা হোক না কেন খাবারের কোনো প্রভাবই তৈজসে পড়বে না। সুতরাং চীনা মাটির পাত্র ঠাণ্ডা কিংবা গরম সব ধরনের খাবার পরিবশেনের জন্যই সমানভাবে উপযোগী।#
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/ মো:আবু সাঈদ/ ০৭
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।