ইরানের পণ্যসামগ্রী: চীনামাটির বাসন শিল্প
গত আসরে আমরা কথা বলার চেষ্টা করেছি ইরানের ক্রোকারিজ তৈজসপত্র বিশেষ করে ইরানে চীনামাটির বাসন শিল্পের বিভিন্ন দিক নিয়ে। চীনা মাটির তৈজস আসলে নিকেলের প্রলেপযুক্ত সিরামিকের বিভিন্ন সেটকেই বোঝায়।
পানি শোষণ করার মাত্রা, তাপ সহ্য করার পরিমাণ, আলো নি:সরণের মতো স্বচ্ছতা ইত্যাদির প্রতি লক্ষ্য রেখে বিভিন্ন স্তরে এগুলোকে বিন্যস্ত করা হয়। ডিশ ওয়াশিং কিংবা মাইক্রোওভেনে দিলেও সমস্যা হবে না, পড়লে ভাঙবে না ইত্যাদির প্রতি লক্ষ্য রেখে আজকাল মৃৎপাত্রগুলো তৈরি করা হচ্ছে। চীনা মাটির তৈজসপত্র সাধারণত এক হাজার চৌদ্দ ডিগ্রি তাপমাত্রায় পোড়ানো হয় যার ফলে স্বাস্থ্য ও সুস্থতার দিক থেকে এগুলো যথাযথ মানের হয়। যে-কোনো রকমের খাবার দাবারই এইসব তৈজসে পরিবেশন করা হোক না কেন খাবারের কোনো প্রভাবই তৈজসে পড়বে না। সুতরাং চীনা মাটির পাত্র ঠাণ্ডা কিংবা গরম সব ধরনের খাবার পরিবেশনের জন্যই সমানভাবে উপযোগী।
আর্মেনিয়ার বিশিষ্ট ক্রোকারিজ সামগ্রী ব্যবসায়ী স্যামুয়েল গ্রেগরিয়ান ইরান থেকে প্রায় দশক ধরে চীনা মাটির তৈজসসহ কাঁচের তৈরি বিভিন্ন পণ্য নিজ দেশে আমদানি করছেন। ইরভানে তার একটা পাইকারি বিক্রয় কেন্দ্র আছে। সেখান থেকেই এইসব ক্রোকারিজ সামগ্রী বিক্রি করেন তিনি। ইরানি পণ্য সামগ্রীর এই বিক্রেতা মনে করেন: ইরান কেবল যে ভালো এক প্রতিবেশী তাই নয় বরং আর্মেনিয়ার জন্য ভালো এক বন্ধুও ইরান। এই চমৎকার বৈশিষ্ট্যের কারণে ইরানি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে নিশ্চিন্তে, সহজতরভাবে ব্যবসা করা যায়। গ্রেগরিয়ান আরও বলেন: বহু বছর ধরে শুধু ইরান থেকেই ক্রোকারিজ সামগ্রি আমদানি করছি। এর কারণ দুটো। এক ইরানে তৈরি তৈজসগুলোর গুণগত মান বেশ উন্নত। আর দ্বিতীয় কারণটি হলো ইরানি পণ্যের মূল্য তুলনামূলকভাবে কম।
তিনি আরও বলেন: তাছাড়া ইরানি কোম্পানিগুলো বিশেষ করে ব্যবসায়িক অংশীদারদের সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতা ও লেনদেন করাটা ঝামেলামুক্ত। বিশেষ করে ব্যবসায়িক কার্যক্রমে ভাষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আমরা ইরানিদের ভাষা বুঝি এবং তারাও আমাদের ভাষা বোঝে। জর্জিয়ান সীমান্তের নিকটবর্তী আর্মেনিয়ান শহর স্টেপনাভানে একটি দোকান আছে আর্মেন হারাটোনিয়ানের। কদিন পরপরই সে গ্রেগরিয়ানের দোকানে যায় কেনাকাটা করতে। তার দোকান থেকে গ্রেগরিয়ানের দোকানের দূরত্ব প্রায় দেড় শ কিলোমিটার। শুধুমাত্র ইরানের তৈরি তৈজসপত্র কেনার জন্যই হারাটোনিয়ান এতোটা পথ পাড়ি দেয়। তার ভাষ্যমতে: আমার কাস্টমারদের বেশিরভাগই ইরানের তৈরি চীনা মাটির তৈজস পছন্দ করে।

বলছিলাম ইরানি তৈজসপত্রের প্রতি আর্মেনিয়ানদের আকর্ষণ সম্পর্কে। বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায় যে, সারা বিশ্বে বছরে চীনা মাটির পণ্য উৎপাদন হয় এক থেকে দেড় মিলিয়ন মানে দশ থেকে পণর লক্ষ টনের মতো। ইরান বিচিত্র ধরনের চীনা মাটির তৈজস উৎপাদন করে বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। চীন এক্ষেত্রে সবার শীর্ষে অবস্থান করছে। ইরানে চীনা মাটির তৈরি বিভিন্ন শিল্পের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে ইরান এক্ষেত্রে দুটি ভিন্ন ভিন্ন কাঠামোর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। কয়েক দশক আগেও ইরানে চীনা মাটির বাসন কোসন ইত্যাদি তৈরি করা হত স্থানীয় পদ্ধতিতে। সুতরাং উৎপাদনের পরিমাণ ছিল কম এবং সীমিত। তবে সেগুলোর শিল্পমূল্য ছিল অনেক বেশি। ইরানের প্রাচীন ইতিহাসের বিভিন্ন কালপর্বের পুরাতাত্ত্বিক মৃৎশিল্পের যেসব নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে সেসব নিদর্শনের বেশিরভাগই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সমৃদ্ধ যাদুঘরগুলোর শো-কেসগুলোকে অলংকৃত করছে।
ইরানে নতুন চীনা মাটির যে বিভিন্ন শিল্প সামগ্রী তৈরি হচ্ছে সেসব সামগ্রীর বয়স বেশি নয়, মাত্র চার থেকে পাঁচ দশকের মতো। ইসলামি বিপ্লব বিজয়ের আগে ইরানে হাতে গোণা মাত্র কয়েকটি কারখানা ছিল চীনা মাটির তৈরি বিভিন্ন শিল্পের। কিন্তু বিপ্লব বিজয়ের পর ইরানের দায়িত্বশীলদের প্রেরণাদায়ক নীতির কারণে এই শিল্পের জগতে চোখ ধাঁধানো উন্নয়ন ও অগ্রগতি আসে। পরিমাণগত দিক দিয়ে ইরানি চীনামাটির বাসন-কোসন শিল্পে শতকরা দেড় হাজার গুণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এই উন্নয়ন ও অগ্রগতি প্লেট বা মৃৎপাত্রের নকশা, প্যাটার্ন এবং ডিজাইনের সকল ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্যভাবে লক্ষণীয়।
বলছিলাম চীনা মাটির শিল্পে ইরানে বিপ্লবোত্তর অগ্রগতির কথা। ইরানে এখন বিশটিরও বেশি বৃহৎ ক্রোকারিজ কারখানা সক্রিয় রয়েছে। এইসব কারখানার শতকরা নব্বুই ভাগ পণ্যই দেশের অভ্যন্তরে সরবরাহ করা হয়। বাকি দশ ভাগ প্রেরণ করা হয় বিভিন্ন দেশের কাঙ্ক্ষিত বাজারে। ইরানের তৈরি চীনা মাটির তেজস ইরাক, তুরস্ক, জর্জিয়া, তুর্কমেনিস্তান, আজারবাইজান প্রজাতন্ত্র, আফগানিস্তান, রাশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাজাখিস্তান এবং আর্মেনিয়াসহ আরও বহু দেশে প্রেরণ করা হয়। ইরানে চীনা মাটির তৈরি শিল্পের প্রথম কারখানাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এক শ পঁয়ত্রিশ বছর আগে। সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে 'জাররিন' নামের এই কারখানাটি সবচেয়ে বড়ো এবং বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক কারখানাগুলোর একটি। এ কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইরানের চীনা মাটির পণ্য সামগ্রি রপ্তানি করতে সক্ষম হয়েছে ইরান। যেসব দেশে এসব পণ্য যায় তার মধ্যে রয়েছে জার্মানি, স্পেন, ইতালি, ফ্রান্স, ব্রিটেন, সুইডেন, হল্যান্ড, তুরস্ক, রাশিয়া, কানাডা, সৌদিআরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ভারতসহ বিশটিরও বেশি দেশ।#
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/ মো:আবু সাঈদ/ ১০
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।