এপ্রিল ২৮, ২০২১ ১৮:০৮ Asia/Dhaka

ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে খায়বার অভিযান চালানোর পর ইরানি কমান্ডাররা হোর অঞ্চলে আরেকটি অভিযানের পরিকল্পনা করেন।

তাদের এ পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল খায়বার অভিযানের অর্জনগুলো ধরে রাখার পাশাপাশি হোর অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। একই অঞ্চলে চালানো খায়বার অভিযানের সময় নিজেদের ও শত্রু  সেনাদের দুর্বলতা ও শক্তিশালী দিকগুলো নিখুঁতভাবে পর্যালোচনা করে হোর অঞ্চলে ‘বদর’ নামে আরেকটি অভিযানের পরিকল্পনা করেন ইরানি কমান্ডাররা। হোর এবং দজলা নদীর পূর্ব তীরবর্তী অঞ্চলগুলো ইরানি যোদ্ধাদের নখদর্পণে ছিল বলে এই অঞ্চলকে ‘বদর’ অভিযানের জন্য বাছাই করা হয়।

এছাড়া, ইরাকি সেনারা তাদের দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অন্যান্য ফ্রন্টে সতর্ক অবস্থায় মোতায়েন ছিল এবং সেসব ফ্রন্ট রক্ষা করার কাজে বেশি মনযোগ দিয়েছিল। কিন্তু ইরান কিছুদিন আগেই হোর অঞ্চলে ‘খায়বার’ অভিযান চালিয়েছিল বলে বাগদাদ ভাবতেই পারেনি প্রতিকূল পরিবেশের এই অঞ্চলে ইরান এত দ্রুত আরেকবার অভিযান চালাতে পারবে। ইরাকি বাহিনীর রণপ্রস্তুতি সম্পর্কে পাওয়া গোয়েন্দা তথ্য থেকেও ইরানি কমান্ডাররা জানতে পারেন, হোর অঞ্চলের দিকে শত্রু  সেনাদের তেমন একটা মনযোগ নেই। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও এই অঞ্চলে অভিযান চালাতে ইরানি যোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছিল। আর সেটি হচ্ছে, জলাভূমিবেষ্টিত এই অঞ্চলে যুদ্ধ করার ক্ষেত্রে ইরাকি বাহিনীর অপারদর্শিতা। এছাড়া, এই অঞ্চলে অতি অল্প সংখ্যক ইরাকি সেনা মোতায়েন ছিল।

এদিকে সুচিন্তিত দর্শনের ওপর ভিত্তি করে ইরানি কমান্ডাররা এই অভিযানের নাম দিয়েছিলেন বদর। তারা ইসলামের প্রাথমিক যুগের বদর যুদ্ধে শত্রু  সেনাদের বিরুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর বিজয়ের মতো দ্রুততম সময়ের মধ্যে ইরাকি বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে ফেলার লক্ষ্যে এই অভিযানের নাম দেন বদর। কাজেই সার্বিকভাবে ইরাকের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে সেদেশের আগ্রাসী বাহিনীকে পর্যুদস্ত করার লক্ষ্যে বদর অভিযানের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়। অভিযানের মূল লক্ষ্য স্থির করা হয় হোর-আল-আজিম জলাভূমি পেরিয়ে দজলা নদীর পশ্চিম তীর দখল করা। এটি করতে পারলে ইরাকের আম্মারা-বসরা মহাসড়কের আল-উজাইর ও আল-কারানা’র মধ্যবর্তী অংশটুকু নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে।

এর আগে এই অঞ্চল দখল করাকে খায়বার অভিযানেরও অন্যতম লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু সে অভিযানে অপ্রত্যাশিত কিছু সমস্যার মুখোমুখি হওয়ার কারণে ইরানি যোদ্ধারা অভিযানের মাঝপথে ফিরে আসেন। এবার সেই অসমাপ্ত কাজ শেষ করার লক্ষ্যে বদর অভিযান চালানোর পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়।

খায়বার অভিযান বিস্তীর্ণ অঞ্চলে চালানো হলেও এবার বদর অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত হয় সীমিত কিছু এলাকায়। অভিযানে অংশগ্রহণ করতে যাওয়া যোদ্ধাদের মনোবল চাঙ্গা করার লক্ষ্যে ইরানের সেনাবাহিনী ও ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি’র কয়েকজন কমান্ডার তেহরানের অদূরে জামারানে ইমাম খোমেনী (রহ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান।

সাক্ষাতে ইসলামি বিপ্লবের রূপকার ইমাম খোমেনী (রহ.) বলেন, “…তোমাদেরকে দেখলে আমার অন্তর প্রশান্ত হয়। তোমরা ইসলাম ও ইরানের ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল করেছ। তোমরা নিশ্চিন্ত মনে অভিযান চালাতে যাও। জেনে রেখো, সকল শক্তি ও ক্ষমতার উৎস আল্লাহ তায়ালার নেক দৃষ্টি তোমাদের দিকে রয়েছে। অন্য সব শক্তি কাগুজে বাঘের সমতুল্য; কেবল আল্লাহর শক্তিই চিরস্থায়ী। তিনি এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, যদি কেউ তাঁর আদেশ মেনে চলে তবে তিনি তাদেরকে বিজয় দান করবেন। তোমরা নিঃসন্দেহে এখন আল্লাহর আদেশ মেনে চলার পাশাপাশি ইসলাম ও ইসলামি প্রজাতন্ত্রের সেবা করছ। কাজেই নিজেদের অন্তরে বিন্দুমাত্র সংশয় রেখো না। তোমরা হচ্ছো আল্লাহর সৈনিক যাদের বিজয় অবশ্যম্ভাবী।” ইমাম খোমেনী বদর অভিযান চালাতে যাওয়া কমান্ডারদের উদ্দেশ করে আরো বলেন, “শত্রু  সেনাদের কাছে ক্ষেপণাস্ত্র থাকলেও তাদের ঈমান নেই। কিন্তু তোমরা ঈমানদার এবং সকল শক্তির উৎস আল্লাহর সঙ্গে তোমাদের অন্তরের সম্পর্ক রয়েছে। ইরাকি বাহিনী এসব কথা বুঝবে না।”

বদর অভিযানের পরিকল্পনা তৈরি করেছিল ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি।  ১৯৮৫ সালের ১১ মার্চ এই অভিযান শুরু করা হয়। খতামুল আম্বিয়া ঘাঁটির নেতৃত্বে তিনটি সামরিক ঘাঁটি এই অভিযানে অংশগ্রহণ করে। এসব ঘাঁটিতে আইআরজিসি’র ৬৭টি এবং সেনাবাহিনীর ৩২টি ব্যাটেলিয়ন মোতায়েন ছিল। অভিযানে ইরানি যোদ্ধাদের বিভিন্ন ইউনিটের সদস্যদের আনা নেওয়ার কাজে পাঁচ হাজারের বেশি স্পিডবোট নামানো হয়। টানা ছয়দিন ধরে অভিযান চলে। অভিযানের প্রথম প্রহরেই শত্রু সেনাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেঙে ফেলা হয়। ইরানি যোদ্ধাদের অভিযানের ক্ষিপ্রতায় ইরাকি বাহিনী হতচকিত হয়ে পড়ে।  কারণ, তারা এর আগে ইরানের পক্ষ থেকে চালানো খায়বার অভিযানে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল তাতে তারা বুঝেই উঠতে পারেনি যে, ইরানি যোদ্ধারা এত ক্ষিপ্রগতিতে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেঙে ফেলতে পারবে।

অভিযানের শেষ দিনে ইরানের ৩১তম ডিভিশন দজলা নদী পার হয়ে এটির পশ্চিম তীরে চলে যায়। এই ডিভিশন ইরাকের আল-কারানা শহরের দিকে এগিয়ে যায় এবং পূর্বনির্ধারিত প্রায় ৭০ ভাগ লক্ষ্য অর্জন করে। কিন্তু এ সময় এই ডিভিশনের কমান্ডার মাহদি বাকেরি শাহাদাতবরণ করলে ইরানি যোদ্ধারা দজলা নদীর পূর্ব তীরে পশ্চাদপসরণ করেন।

বদর অভিযানে শত্রু সেনাদের ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার পাশাপাশি ইরাকের ৫০০ বর্গকিলোমিটারের বেশি ভূমি ইরানের দখলে আসে। এই ভূমির মধ্যে ছিল বেশ কয়েকটি গ্রাম এবং খন্দক মহাসড়কের ১৩ কিলোমিটার অংশ। আম্মারা-বসরা মহাসড়ক থেকে খন্দকের দূরত্ব ছিল মাত্র ৬ কিলোমিটার। 

প্রতিবারের মতো এবারও ইরানের কাছে যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত হয়ে এদেশের গ্রাম ও শহরগুলোর বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরাকের সাদ্দাম সরকার। এসব হামলায় নারী ও শিশুসহ ইরানের অনেক বেসামরিক নাগরিক হতাহত হয়। বদর অভিযানে ইরান কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করায় ইরাকের সাদ্দাম সরকার এতটা ক্ষুব্ধ হয় যে, বাগদাদ ইরানের রাজধানী তেহরানে হামলা চালাতে জঙ্গিবিমান পাঠিয়ে দেয়। সে সময় আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দিক দিয়ে ইরান দুর্বল ছিল বলে ইরাকি জঙ্গিবিমান ঊর্ধ্বাকাশ দিয়ে উড়ে এসে তেহরানে বোমা হামলা চালিয়ে আবার বাগদাদে ফিরে যেত। এভাবে যুদ্ধের ময়দানে পেরে উঠতে না পেরে বেসামরিক অবস্থানে হামলা চালিয়ে ইরানকে পরাভূত করার নীতি গ্রহণ করে ইরাক। সেইসঙ্গে ইরানের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত তেল রপ্তানি বাধাগ্রস্ত করতে পারস্য উপসাগরে ইরানের তেল ট্যাংকারগুলোর ওপরও হামলা অব্যাহত রাখে বাগদাদ। #

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ২৮

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।