আসমাউল হুসনা (পর্ব-২৯)
মহান আল্লাহর আসমাউল হুসনার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নাম আদিল। এর আভিধানিক অর্থ ভারসাম্য রক্ষাকারী তথা নানা বিষয়ে মধ্য-পন্থা অবলম্বনকারী এবং চরম-পন্থা ও প্রান্তিকতা পরিহারকারী।
মহান আল্লাহ এ নামের আলোকে পুরোপুরি ন্যায়বিচারপূর্ণ বিধি-বিধান দিয়ে থাকেন। মহান আল্লাহ সব বিষয়ে ন্যায়বিচার ও ভারসাম্য বজায় রাখেন। মহান আল্লাহর কাজে ও নীতিতে কোথায় বিন্দুমাত্র অবিচার নেই। যখন ও যেখানে যা করা দরকার এবং ঠিক যতটুকু করা দরকার তার চেয়ে বিন্দুমাত্র কম বা বেশি তৎপরতা নেই মহান আল্লাহর কাজে।
যে বিষয় বা কাজ যা যখন যেখানে যে মাত্রায় থাকা দরকার ও যে অবস্থান বা মর্যাদা নিয়ে থাকা দরকার তা-ই ন্যায়বিচার। মহান আল্লাহ সব কিছুকে তার প্রকৃত অবস্থানে রাখেন। মহান আল্লাহর ন্যায়বিচার ছাড়া সৃষ্টি জগতের ব্যবস্থাপনা ধ্বংস হয়ে যেত।
সুরা ইনফিতারের সপ্তম আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, খোদা তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তোমার শরীর ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে সুবিন্যস্ত করেছেন এবং সুষম বা ভারসাম্যপূর্ণ করেছেন।–
মানুষসহ মহান আল্লাহ'র সব সৃষ্টি ও অন্য সব কিছু সুপরিকল্পিত, সুবিন্যস্ত এবং ভারসাম্যপূর্ণ। তিনি প্রত্যেক সৃষ্টিকে প্রত্যাশিত পূর্ণতার দিকে পরিচালনা করেন। প্রত্যেক সৃষ্টির অব্যাহত জীবন ও টিকে থাকাটা ন্যায়বিচার-কেন্দ্রিক।
মহান আল্লাহ আদিল বা ন্যায়বিচার হওয়ার কারণে তিনি সবার জন্য সমানাধিকার নিশ্চিত করেন। তিনি প্রত্যেককে তার অবস্থা ও যোগ্যতা অনুযায়ী সব কিছু দিয়ে থাকেন। যেমন, যে ছাত্র বেশি পরিশ্রম করে ও যে ছাত্র অলস তারা উভয়ই একই ধরনের পুরস্কার বা তিরস্কার পাবে-এটা ন্যায়বিচার নয়। তাই দেখা যায় প্রত্যেক ছাত্র তার যোগ্যতা অনুযায়ী বেশি ও কম নম্বর পেয়ে থাকে পরীক্ষায়। তদ্রূপ ন্যায়নীতির আলোকে একই কারখানার সব শ্রমিকের বেতন সমান হওয়া উচিত নয়। বরং প্রত্যেক শ্রমিক যদি তার কাজের মান ও মাত্রার আলোকে পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন সেটাই হবে ন্যায়বিচার। দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকের বেতন সমান হতে পারে না।
মহান আল্লাহ আদিল বা ন্যায়বিচারক হওয়ার কারণে তিনি প্রত্যেক মানুষের সঙ্গে তার অবস্থার আলোকে আচরণ করে থাকেন। ইসলাম বিশেষজ্ঞদের মতে মহান আল্লাহর ন্যায়বিচারের তিনটি ধরন রয়েছে: সৃষ্টিগত ন্যায়বিচার, বিধানগত ন্যায়বিচার ও প্রতিদানগত ন্যায়বিচার। সৃষ্টিগত ন্যায়বিচার হল প্রত্যেক সৃষ্টি তার যোগ্যতা ও উপযুক্ততার আলোকে আল্লাহর নেয়ামত পেয়ে থাকে। বিধানগত ন্যায়বিচার হল নবী-রাসুলদের মাধ্যমে আল্লাহ মানুষের জন্য যেসব কর্তব্য বা দায়িত্ব নির্ধারণ করেছেন তা। আর প্রতিদানগত ন্যায়বিচার হল ক্বিয়ামতের দিন বা বিচার-দিবসে মহান আল্লাহ মানুষের মধ্যে ন্যায়বিচার করবেন এবং কারো অধিকার নষ্ট করা হবে না। অর্থাৎ সেদিন পাপী ও পুণ্যবানের প্রতিদান একই ধরনের হবে না। অবশ্য প্রতিদানগত ন্যায়বিচারের ভিত্তি হল মহান আল্লাহর দয়া, অনুগ্রহ ও করুণা। কারণ, দুনিয়াতে প্রত্যেক মানুষেরই কিছু ভুল, পাপ ও বিচ্যুতি থাকে। মহান আল্লাহ যদি কঠোর ন্যায়বিচারের মাধ্যমে এসবের প্রতিদান দেন তাহলে বেশিরভাগ মানুষেরই কঠিন ও ধ্বংসাত্মক শাস্তি থেকে মুক্তির কোনো উপায় থাকবে না। আর এ জন্যই সব নবী-রাসুল ও মহান আল্লাহর প্রিয়পাত্ররা তথা আউলিয়া আল্লাহর কাছে চেয়েছেন যে আল্লাহ যেন পরকালে ন্যায়বিচারের পরিবর্তে তাঁর দয়া ও করুণাই প্রদর্শন করেন!

ন্যায়বিচারের আরেকটি অর্থ হল অন্যদের অধিকার মেনে চলা। মহান আল্লাহ তার বান্দাহদের প্রতি বিন্দুমাত্র জুলুমও করেন না। কারণ, আল্লাহ জুলুমের মুখাপেক্ষী নন। মহান আল্লাহর পবিত্র সত্ত্বা সব ধরনের ত্রুটি ও ঘাটতি থেকে মুক্ত। মহান আল্লাহর মধ্যে কার্পণ্য, দারিদ্র ও অজ্ঞতার বিন্দুমাত্র অস্তিত্ব নেই। তাই আমরা বিশ্বের কোথাও যদি কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি ও অপূর্ণতা দেখি তার সঙ্গে আল্লাহর কোনো সম্পর্ক নেই। আর এ জন্যই মহান আল্লাহ সুরা ইউনুসের ৪৪ নম্বর আয়াতে বলেছেন, আল্লাহ মানুষের ওপর কোনো জুলুম করেন না, বরং মানুষ নিজেই নিজের ওপর জুলুম করে।
মহান আল্লাহ আদিল বা ন্যায়বিচারক। তাই তিনি নিজ প্রতিনিধিত্বের বা খলিফার মর্যাদা দেয়া মানুষকেও বলেছেন ন্যায়বিচার পালন করতে। সুরা নাহ্ল্-এর ৯০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ ও আত্মীয়-স্বজনকে দান করার আদেশ দেন এবং তিনি অশ্লীলতা, অসঙ্গত কাজ ও অবাধ্যতা করতে বারণ করেন। তিনি তোমাদের উপদেশ দেন যাতে তোমরা স্মরণ রাখ বা সতর্ক থাক।– এখানে ন্যায়বিচারের পাশাপাশি সদাচরণের ওপরও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
মানুষের জীবনে কখনও কখনও এমন অবস্থা আসে যে কেবল ন্যায়বিচারের মাধ্যমে সমস্যাগুলোর সমাধান করা যায় না। কখনও কখনও ত্যাগ-তিতিক্ষা ও ক্ষমার প্রয়োজন হয়। আর এটাই হচ্ছে ইহসান বা সদাচরণ! ইহসান হচ্ছে নিজের সুখ, কল্যাণ ও আরাম-আয়েশের চেয়ে অন্যদের বা জনগণের কল্যাণকে প্রাধান্য দেয়া। আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ) বলেছেন, ন্যায়বিচার হল মানুষকে তার প্রাপ্য অধিকার দেয়া এবং ইহ্সান হল মানুষের প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ করা।
মানুষ যদি নিজেকে মহান আল্লাহর ন্যায়বিচারকামিতার গুণে রঙিন করতে চায় তাহলে সে যেন অন্যদের সম্পদ, জীবন ও সম্মান বা সম্ভ্রমের ওপর জুলুম না জরে।
একজন ভালো কাজী বা বিচারক হতে হলে কারো সঙ্গে ব্যক্তিগত শত্রুতা বা কোনো গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের সঙ্গে শত্রুতা যেন তাকে ন্যায়বিচার থেকে দূরে না রাখে। প্রকৃত ন্যায়কামী সে যে সত্য ও ন্যায়বিচারকে সমুন্নত রাখতে গিয়ে নিজের এবং এমনকি বাবা-মাসহ নিজ আত্মীয়স্বজনের ক্ষতিকেও মেনে নেয়।
কারো বিষয়ে রায় দেয়ার সময় বিচারকের এটা দেখা উচিত নয় যে লোকটি সমাজে প্রভাব, প্রতিপত্তি ও ধন-সম্পদের অধিকারী বা এসবের অধিকারী নয় কিনা! আইনকে সবার জন্য সমানভাবে প্রয়োগ করতে হবে। এমনকি নিজের স্ত্রী ও সন্তানদের ক্ষেত্রেও কথায় ও কাজে ন্যায়বিচার বজায় রাখতে হবে। দুই বিবাদমান ব্যক্তির বিরোধ মীমাংসার সময় উভয়ের সঙ্গে কথায় ও আচরণে এবং দৃষ্টিপাতের ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার ও ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। দু'জনের লেখার মধ্যে কার হাতের লেখা বেশি সুন্দর সে রায় দেয়ার সময়ও ন্যায়ের চেতনা বজায় রাখতে হবে। তা না হলে পরকালে শাস্তি পেতে হবে।#
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/৩০
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।