জুন ০৯, ২০২১ ১৮:০৫ Asia/Dhaka

মহান আল্লাহর আসমাউল হুসনার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নাম খাবির। খবর শব্দটি থেকে উদ্ভুত এ নামের অর্থ যিনি জানেন ও সব সময় সচেতন।

মহান আল্লাহ সব সৃষ্টির মনের গোপন কথা, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও এমনকি তাদের কল্পনার পর্দায় যা আসে আর যায় সে সম্পর্কেও সব জানেন বলে তিনি খাবির। সুরা মুলক-এর ১৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ নিজের লাত্বিফ ও খাবির নাম উল্লেখ করে  বলেছেন: যিনি মানুষসহ সব সৃষ্টি তথা সৃষ্টিকুলের স্রস্টা তিনি তাদের অবস্থাগুলো সম্পর্কে জানবেন না- এটা কি সম্ভব? তিনি সব বিষয়ে সূক্ষ্ম-জ্ঞানী ও সম্যক জ্ঞাত।

মহান আল্লাহ প্রতিটি মুহূর্তে প্রত্যেক সৃষ্টির অবস্থা ও তাদের পরিবর্তন সম্পর্কে জানেন। মহান আল্লাহ বাহ্যিক ও গোপন সব বিষয়ে সর্বজ্ঞ। সৃষ্টিকুলে সব খবর বা সংবাদ তিনি পুরোপুরি ও সব সময় জানেন। মহান আল্লাহর এ বৈশিষ্ট্য পুরোপুরি সত্ত্বাগত ও জ্ঞানগত।

আরবি ভাষায় খবর শব্দের দুটি অর্থ রয়েছে। একটি অর্থ তথ্য বা জ্ঞান এবং অন্য অর্থটি হল কোমলতা বা ঝরঝরে তথা শিথিল অবস্থা। যেমন, কৃষকরা জমিতে বীজ বপনের আগে শক্ত মাটিকে ঝরঝরে, ঢিলে বা আলগা আলগা করে নেন তারা খাবির। তবে বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ ও শব্দবিদরা এ দুই অর্থের মধ্যে সমন্বয় করে বলেন কৃষককে খাবির বলা হয় কারণ তিনি তার জমির সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে জানেন বা সচেতন। বেয়াড়া বা অনুর্বর মাটিকে বশে আনার ও কৃষিকাজের উপযোগী করার রহস্য বা সূত্রগুলো তার জানা রয়েছে। আর মহান আল্লাহ সৃষ্টি জগতের সব কিছুর বাহ্যিক ও গোপন সব বিষয়ে পরিপূর্ণ বা পূর্ণাঙ্গ ও সঠিক তথ্য বা খবর রাখেন। সৃষ্টিকুলের সব বিষয় রয়েছে তাঁর জ্ঞানের নিয়ন্ত্রণে। সুরা ফোরক্বানের ৫৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ নিজের খাবির নাম উল্লেখ করে বলেছেন:

তিনি নভোমন্ডল, ভূমন্ডল ও এতদুভয়ের অন্তর্বর্তী সবকিছু ছয়দিনে তথা ছয় যুগে সৃস্টি করেছেন, অতঃপর আরশে তথা জ্ঞানগত কর্তৃত্বের ক্ষমতায় সমাসীন হয়েছেন এবং বিশ্বজগত পরিচালনায় নিয়োজিত হয়েছেন। তিনি পরম দয়াময় তথা রাহমান। তোমরা তাঁর কাছেই চাও বা জিজ্ঞাসা কর যিনি সব কিছু অবগত তথা খাবির।

পবিত্র কুরআনে আল্লাহর নাম খাবির ৪৫ বারেরও বেশি এসেছে। এই খাবির নাম কখনও কখনও মহান আল্লাহর অন্য এক নাম আলিম নামের সঙ্গে তথা এই নামের পর এসেছে । সুরা হুজরাতের ১৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ নিজের আলিম ও খাবির নাম উল্লেখ করে বলেছেন, তোমাদের মধ্যে তারাই আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় যারা বেশি খোদাভীরু। আল্লাহ জ্ঞানী ও সম্যক অবগত।

পবিত্র কুরআনের মুফাসসিরদের কেউ কেউ বলেন, মহান আল্লাহর খাবির নামটি আলিম নামের তুলনায় বেশি বিশেষায়িত অর্থ বহন করে। আর আলিম সাধারণ অর্থবোধক। আল্লাহর আলিম নামটি তাঁর নিরঙ্কুশ বা সামগ্রিক জ্ঞানের অর্থবোধক। আর খাবির বলতে বাস্তবতার ওপর মহান আল্লাহর নজর থাকা ও অবগত থাকা এবং গোপন রহস্যগুলো জানা ও বান্দাহদের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয় সম্পর্কেও জানাকে বোঝায়।  যেমন, সুরা তাহরিমের তিন নম্বর আয়াতে নিজের আলিম ও খাবির নাম ব্যবহার করে মহান আল্লাহ বলেছেন

যখন নবী তাঁর একজন স্ত্রীর কাছে একটি  গোপনীয় কথা গোপনে বললেন, অতঃপর ওই স্ত্রী যখন তা নবীর অন্য স্ত্রীর কাছে বলে দিল এবং আল্লাহ নবীকে তা জানিয়ে দিলেন, তখন নবী সে বিষয়ে ওই স্ত্রীকে কিছু বললেন এবং কিছু বললেন না। নবী যখন তা ওই  স্ত্রীকে বললেন, তখন সেই স্ত্রী বললেনঃ কে আপনাকে এ সম্পর্কে অবহিত করল? নবী বললেন, যিনি সর্বজ্ঞ, ওয়াকিফহাল, তিনি আমাকে অবহিত করেছেন। -

মহান আল্লাহর কাছে অস্তিত্ব জগতের কোনো কিছুই গোপন থাকে না। আর এ জন্যই তিনি হলেন আলিম বা সর্বজ্ঞ। যেমন, দুনিয়ার যত জায়গায় যত মানুষ নামাজ পড়ছেন তাদের মনের মধ্যে যা রয়েছে ও তারা যা যা ভাবছেন সে সম্পর্কেও আল্লাহ জানেন। তিনি জানেন কার মনের মধ্যে কখন কয়টি কুমন্ত্রণা ঢুকেছে। নামাজিদের একনিষ্ঠতা ও খোদাপ্রেম, খোদাভীতি আর বিনম্রতার মাত্রার আলোকে তিনি তাদের পুরস্কার দেবেন। অথচ বাহ্যিক দৃষ্টিতে সব নামাজি একইভাবে নামাজ পড়ছেন! তাদের নামাজের ভেতরের অবস্থা ও প্রাণের মধ্যে রয়েছে পার্থক্য। তাদের অবস্থার এই যে পার্থক্য তা কেবল মহান আল্লাহই জানেন বলে তিনি হলেন খাবির।

আল্লাহর খাবির নামটি তার বাসির নামের সঙ্গেও কয়েকবার এসেছে। যেমন, সুরা ফাত্বির-এর ৩১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ মহানবীকে (সা) বলছেন: নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর বান্দাহদের সম্পর্কে খাবির ও বাসির তথা সব জানেন ও দেখেন।-

অন্যত্র আল্লাহর খাবির  হওয়া বলতে সব বিষয়ের গোপন ও প্রকাশ্য অবস্থাসহ সব অবস্থা তাঁর জানাকে বোঝায় বলে আমরা জেনেছি। কিন্তু এখানে বাসির নামের সঙ্গে এ নাম আসায় এর অর্থ গোপন বিষয়ে মহান আল্লাহর জ্ঞান ও অবগতিকে বোঝানো হচ্ছে। গোপন বিষয় বাহ্যিক বিষয়ের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় বলে এখানে বাসির নামের আগে খাবির নাম এসেছে।

খাবির বলতে সংবাদদাতাকেও বোঝায় বা সতর্ককারী কিংবা সচেতনকারীকেও বোঝায়। মহান আল্লাহ অদৃশ্য সব বিষয় যেমন, বেহেশত ও জাহান্নাম, ফেরেশতা, পরকালের কঠিন জবাবদিহিতা ও পাপ-পুন্যের হিসাব-নিকাশ, নবী-রাসুলদের কাহিনী ও অতীতের জাতিগুলোর কাহিনী যা মানুষের জানা নেই সেসব বিষয়ে কথা বলেন বলেও তিনি খাবির। মহান আল্লাহর দেয়া সংবাদ বা তথ্য নিখুঁত ও সত্য।

সুরা লোক্বমানের ১৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহর লাত্বিফ ও খাবির নামের উল্লেখ রয়েছে। এ আয়াতে হযরত লোক্বমান তার সন্তানকে উপদেশ দিচ্ছেন এভাবে:

হে বৎস, তোমার কাজ যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয় অতঃপর তা যদি থাকে প্রস্তর গর্ভে অথবা আকাশে অথবা ভূ-গর্ভে, তবে আল্লাহ তাও উপস্থিত করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ গোপন ভেদ জানেন, সবকিছুর খবর রাখেন। -

আমরা যদি মহান আল্লাহ খাবির নামটি মনে গেঁথে রাখি তাহলে কথা ও কাজে এবং আচার-আচরণে বেশি সতর্ক হব এবং আল্লাহর ক্রোধ ও সন্তুষ্টির বিষয়গুলোও তখন মনে থাকবে। নিজের ও অন্যদের বাহ্যিক ক্ষতির চেয়েও আল্লাহর সন্তুষ্টিকেই তখন আমরা বেশি গুরুত্ব দিব।

যে মানুষ নিজের গোপন অবস্থাগুলো এবং ভালো-মন্দ অবস্থা সম্পর্কে জানে সেও খাবির। তবে পার্থক্য হল মানুষ খবর জেনে ও পরীক্ষার মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে বলে তার জানার পরিধি ও তথ্যে ভুলের অবকাশ থাকে। কিন্তু আল্লাহ সব কিছু জানেন পরিপূর্ণভাবে ও নিখুঁতভাবে। মানুষ পরীক্ষা ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জানে। কিন্তু আল্লাহ কোনো বিষয়ে অতীতে অজ্ঞ ছিলেন ও পরে ওই বিষয়ে জেনেছেন এমন হওয়ার সুযোগ নেই। তিনি প্রথম থেকেই সৃষ্টির আদি ও অন্ত বিষয়ে জানেন। 

সুরা নিসার ১৩৫ নম্বর আয়াতেও মহান আল্লাহর খাবির নাম এসেছে। আল্লাহ বলছেন:  হে ঈমানদারগণ, তোমরা ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাক; আল্লাহর ওয়াস্তে ন্যায়সঙ্গত সাক্ষ্যদান কর, তাতে তোমাদের নিজের বা পিতা-মাতার অথবা নিকটবর্তী আত্নীয়-স্বজনের যদি ক্ষতিও হয় তবুও। কেউ যদি ধনী কিংবা দরিদ্র হয়, তবে আল্লাহ তাদের শুভাকাঙ্খী তোমাদের চাইতে বেশী। অতএব, তোমরা বিচার করতে গিয়ে রিপুর কামনা-বাসনার অনুসরণ করো না। আর যদি তোমরা ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বল কিংবা পাশ কাটিয়ে যাও, তবে আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজ কর্ম সম্পর্কেই অবগত। -

কোনো মুমিন মুসলমান মিথ্যা কথা বলতে পারে না বা মিথ্যা সংবাদ দিতে পারে না। সচেতন মুসলমানের উচিত সবচেয়ে সত্যবাদী ও সচেতন ব্যক্তির কাছ থেকে সংবাদ বা তথ্য নেয়া এবং তার সঙ্গেই পরামর্শ করা।#

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/০৯

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।