সন্তান গ্রহণের বা ধারণের প্রাথমিক পর্যায় থেকেই বাবা-মাকে হতে হবে খুব সতর্ক
আদর্শ মানুষ গড়ার কৌশল (পর্ব-১১)
গত পর্বের আলোচনায় আমরা শিশু-কিশোরদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেয়ার ক্ষেত্রে উৎসাহ দেয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে কথা বলেছিলাম।
শিশু-কিশোরদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেয়ার ক্ষেত্রে শাস্তি প্রদান অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও জটিল এক পদ্ধতি। এ পদ্ধতিকে যদি যথাযথভাবে ব্যবহার করা যায় তাহলে শিশু-কিশোরদের আচরণে পরিবর্তন আনা সম্ভব।
শিশু ও কিশোরদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেয়ার ক্ষেত্রে বেত্রাঘাত বা কান ধরিয়ে উঠ-বস করানো বা এ জাতীয় শাস্তি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা উচিত, নাকি সীমিত মাত্রায় এ ধরনের শাস্তির ব্যবহার থাকা উচিত – এ নিয়ে মনোবিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদদের মধ্যে কি কোনো ঐক্যমত্য রয়েছে? ফরাসি চিন্তাবিদ রুশোর মতে কঠোর শারীরিক শাস্তি শিশু ও কিশোরদের মধ্যে ত্রাসের সঞ্চার করে ও তাদের ব্যক্তিত্বকে নড়বড়ে করে দেয় এবং এর ফলে তাদের মধ্যে দেখা দেয় অসন্তুষ্টি ও অভিমানের মত আবেগ-অনুভূতিগত ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া।
এটা স্পষ্ট যে সব সময় কেবলই স্নেহ-ভালবাসা ও সুকোমল আচরণ দেখিয়ে শিশু-কিশোরদের আচরণে পরিবর্তন আনা যায় না। কখনও কখনও বাবা-মা এবং শিক্ষকদেরকে কিছুটা কঠোর হতে হয় এবং কখনও কখনও হতে হয় কোমল। কারণ শিশু-কিশোরদের সময় সব খুব আদর ও স্নেহে অভ্যস্ত করা হলে তারা হয়ে ওঠে আত্মকেন্দ্রিক এবং বড়দের সঙ্গে কথা-বার্তায় ও আচরণে হয়ে পড়ে উদ্ধত প্রকৃতির। এ অবস্থায় তারা বড়দের আদেশ ও উপদেশ খুব কমই শুনতে চায়। তাই বাবা-মা এবং শিক্ষকদের উচিত শিশু-কিশোরদের সঠিক পথে আনার জন্য শারীরিক শাস্তি না দিয়েই বা তীব্র তিরস্কার না করেই তাদের সঙ্গে কিছুটা কঠোর হওয়ার ভান করা ও প্রয়োজনমত উপহার বা উৎসাহ দেয়ারও উদ্যোগ নেয়া।
তাদেরকে সঠিক পথে আনতে প্রথমে কথা বলে ও নানা ধরনের উৎসাহ দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করতে হবে এবং কখনও কখনও তাদের মৃদু তিরস্কারও করা যেতে পারে। আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ) বলেছেন, ক্ষিপ্ত হয়ে বা ক্রুদ্ধ হয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেছেন, বুদ্ধিমান মানুষ আদব-কায়দা ও প্রশিক্ষণ থেকে উপদেশ নেয়। আর চতুষ্পদ জন্তু ও জানোয়ারদেরই কেবল চাবুক মেরে বা বেত্রাঘাত করে শেখাতে হয়।
অনেক বাবা-মায়ের এমন অভ্যাস রয়েছে যে সন্তানকে যে কোনো কিছু আদেশ দেয়ার ভঙ্গিতে শেখাতে চান। যেমন, অবশ্যই পড়াশুনা করবে ও নিজের কাজগুলো করবে বা অন্যদের সাহায্য করবে। এ ধরনের বক্তব্য বা সুর হচ্ছে অভিভাবক হিসেবে কোনো কিছু জোর করে চাপিয়ে দেয়া! যদিও তাদের এমন অধিকারও রয়েছে, কিন্তু জোর করে আসলে কিছু আদায় করা সম্ভব হয় না।
মহানবীর জীবনী পর্যালোচনা করে জানা যায় তিনি কখনও শিশু-কিশোরদের কিছু শেখানোর ক্ষেত্রে শারীরিক শাস্তি প্রয়োগ করতেন না। কেউ তার শিশুকে শারীরিক শাস্তি দিয়েছেন বলে শুনতে পেলেও মহানবী (সা) কঠোরভাবে তাকে বাধা দিতেন ও প্রতিবাদ জানাতেন।
আবু মাসউদ নামের এক ব্যক্তি তার এক দাসকে প্রহার করতেন। একদিন এমনই প্রহাররত অবস্থায় শুনতে পেলেন কেউ একজন বলছেন: আবু মাসউদ! আল্লাহ তোমাকে ক্ষমতা দিয়েছেন ও তাই তুমি তার এই দাসকে তোমার দাস হিসেবে পেয়েছ। তাই তাকে প্রহার করো না!-ফিরে তাকিয়ে দেখলাম মহানবী (সা) আমাকে এই কথাগুলো বলেছেন। আর আমিও তখন বললাম: আমি এই দাসকে আল্লাহর পথে মুক্ত করে দিলাম!
মহানবীর আহলে বাইতও শিশু-কিশোরদের প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে শারীরিক শাস্তির বিরোধিতা করতেন। এক ব্যক্তি তার সন্তানের ব্যাপারে ইমাম কাযেম (আ)'র কাছে অভিযোগ করলে তিনি বলেন: সন্তানকে প্রহার করো না। তাকে সুশিক্ষিত করতে ওর সঙ্গে অভিমান কর। তবে এই অভিমান যেন দীর্ঘ সময় ধরে না হয়। যতই শিগগিরই সম্ভব তার সঙ্গে আবারও খাতির করবে। মারধোর করে সন্তানকে ভীত-সন্ত্রস্ত করা গেলেও ও তার আচরণে পরিবর্তন আনা সম্ভব হলেও তা তার মধ্যে বদ্ধমূল হবে না। বাবা-মায়ের অনুপস্থিতিতে শিশু আবারও ওই নিষিদ্ধ কাজ করতে পারে অথবা অন্য অনেক সময় গোঁয়ার্তুমি করে তাদের মনে কষ্ট দিতে পারে। হযরত আনাস বিন মালেক শৈশব থেকে মহানবীর খাদেম ছিলেন। তিনি বলেছেন, কয়েক বছর মহানবীর খেদমতে ছিলাম। এ সময়ে তিনি কখনও আমাকে মন্দ কথা বলেননি এবং শারীরিক শাস্তি দেননি।
আসলে শাস্তি দেয়ার বিষয়টি খুব জরুরি প্রয়োজন না হলে প্রয়োগ করা উচিত নয়। আর প্রয়োগ করতে হলেও খুবই কম মাত্রায় তা ব্যবহার করা উচিত। যখন স্নেহ-ভালবাসায় কাজ হয় না কেবল তখনই এ পন্থার আশ্রয় নিতে হবে। ইসলামের প্রত্যাশিত শাস্তিতে শারীরিক শাস্তির স্থান নেই। কেবলই বিশেষ আকর্ষণীয় কোনো উপহার তাকে না দিয়ে বা তার প্রতি মনোযোগ না দিয়ে, জরিমানা করে, চেহারায় রাগের ভাব এনে বা তার দিক থেকে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে শাস্তি দেয়া যেতে পারে। কখনও এমন কথাও বলা যেতে পারে যে, তুমি যদি আর একবার ঘরের ভেতরে ফুটবল খেলো তাহলে তোমাকে আর ফুটবল দেয়া হবে না।
শিশু-কিশোর যদি খুব উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করে তাহলে শাস্তি হিসেবে তার দিকে তাকানো বন্ধ করে ও কথা বলা বন্ধ করেও শাস্তি দেয়া যেতে পারে। এ অবস্থায় তারা ভাববে যে উচ্ছৃঙ্খলতা বন্ধ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই এবং বাবা-মা বা অভিভাবকের কাছে ক্ষমাও চাইতে হবে। একই উদ্দেশ্যে শিশুকে তার প্রিয় খেলা, খাবার ও খেলনা থেকে সাময়িকভাবে বঞ্চিতও করা যেতে পারে।
আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ) বলেছেন, সুন্দর আচরণ যাকে সংশোধন করতে পারে না তাকে ভালোমত শাস্তি দেয়া হলে সে তখন প্রত্যাশিত আচরণ করবে।
শাস্তি দেয়ার ক্ষেত্রেও প্রত্যাশিত নীতি মেনে চলা উচিত। কোনো শিশু যদি অসতর্ক হওয়ার কারণে একটি পাত্র ভেঙ্গে ফেলে তাহলে এ জন্য তাকে তিরস্কার করা উচিত নয় এবং এক্ষেত্রে তিরস্কার করা হলেও তা ফলপ্রসূ হবে না। তা ছাড়া শাস্তি হতে হবে ভুলের বা অন্যায়ের সমানুপাতিক। মহানবী (সা) বলেছেন, যদি কাউকে শাস্তি দাও তাহলে তার পাপের সমানুপাতিক শাস্তি দাও। মনে রাখতে হবে শাস্তি যেন শিশুর ব্যক্তিত্বকে আহত না করে ও তাকে অপমান না করে। শারীরিক শাস্তি মানুষের প্রতি অত্যন্ত অবমাননাকর এবং তা শাস্তিদাতার প্রতি অশ্রদ্ধা সৃষ্টি করে। শিশুরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কান্নাকাটি করে অপমান-বোধের জন্য তিরস্কারের জন্য নয়।#
পার্সটুডে/এমএএইচ/আবুসাঈদ/১৩
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।