সন্তান গ্রহণের বা ধারণের প্রাথমিক পর্যায় থেকেই বাবা-মাকে হতে হবে খুব সতর্ক
আদর্শ মানুষ গড়ার কৌশল (পর্ব-১৪)
শিশুদের ধর্মীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দান তাদের স্বাভাবিক বিকাশ এবং মানসিক ও আত্মিক নানা বিষয়সহ অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোর বিকাশের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
নৈতিকতাসহ মানুষের জীবনের নানা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা ও আচার-আচরণ শেখার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হল আসমানি ধর্ম এবং এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় শিক্ষকরা হলেন নবী-রাসুল। একজন বিখ্যাত মনীষী বলেছেন, 'আর' নামক ইংরেজি বর্ণমালা-যুক্ত তিনটি শব্দ রিডিং, রাইটিং ও অ্যারাথমেটিক তথা পড়া, লেখা ও গণিত জানা মানুষের জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু শিশুদের এই থ্রি আর শেখানোর পাশাপাশি যদি চতূর্থ আর তথা রিলিজিয়ন বা ধর্ম শেখানো না হয় তবে তারা হবে বদমাশ বা রাস্কেল।
বলা হয় চার বছর বয়স থেকেই শিশুদের মধ্যে ধর্মের অনুভূতি জাগে। তাই অন্তত এ সময় থেকেই ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া শুরু করা উচিত। এ সময় থেকেই শিশুদের মনে স্রস্টা ও বিশ্ব-সৃস্টি সম্পর্কে নানা প্রশ্ন জাগতে শুরু করে। মহানবীর (সা) পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য হযরত ইমাম মুহাম্মাদ বাক্বির (আ) বলেছেন: তিন বছর বয়সে শিশুদেরকে কলেমায়ে তাওহিদ শেখাও। আর চার বছর বয়সে তাদের কাছে মহানবীর (সা) নবুওয়্যাতের পরিচিতি তুলে ধর।.... আর সাত বছর বয়সে তাদেরকে ওজু ও নামাজ শেখাও।
শিশুদের মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতি গড়ে তোলা হলে জীবন ও জগত যে বিশেষ লক্ষ্যপূর্ণ এবং অর্থহীন নয় এ ধারণাও তাদের মধ্যে গড়ে উঠবে। এরই আলোকে তারা ধর্মীয় বাস্তবতার নিরেট উৎসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রশান্তি ও তৃপ্তি অনুভব করবে। শিশুর যে আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় চাহিদা তা পূরণ করা তার পরিবারের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব।
শিশুকে তার ধারণ-ক্ষমতা ও যোগ্যতার আলোকে ধর্মীয় মূল বিষয়গুলো শেখাতে হবে। যেমন, তাওহিদ, নবুওয়্যাত ও রিসালাত,পরকাল, পুনরুত্থান, মহান আল্লাহর ন্যায়বিচার, নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদি। মহানবী (সা) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের প্রতি ভালবাসার বিষয়ও শিশুরা বড়দের দেখেই শিখে থাকে প্রাথমিক পর্যায়ে। শিশুদেরকে কঠোরতার মাধ্যমে ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া উচিত নয়।
শৈশবেই শিশুদের পবিত্র কুরআন শেখানোর ও সম্ভব হলে সমগ্র কুরআন হিফয বা মুখস্ত করানোর উদ্যোগ নেয়া উচিত। শিশুদের কোমল মনে যা গেঁথে যায় তা অন্য সময়ের তুলনায় অনেক বেশি স্থায়ী হয়। মহানবীর হাদিসের আলোকে এ সময়ে শিশুরা যা শিখবে তা পাথরে খোদাই করা লেখার মত স্থায়ী হয়ে থাকবে। মানুষের বয়স যখন বাড়তে থাকে তখন স্মরণ-শক্তি ও মুখস্ত করার ক্ষমতা কম যায়।
ইসলামের দৃষ্টিতে পুত্র সন্তানের বয়স যখন ১৫ ও কন্যা সন্তানের বয়স যখন নয় বছর হয় তখন থেকে ধর্মীয় দায়িত্বগুলো পালন তার জন্য আবশ্যক বা ফরজ হয়ে যায়। যেমন, এ সময় থেকে নামাজ-রোজা পালন তাদের জন্য ফরজ হয়ে যায়। তাই এই বয়সে পৌঁছার আগেই এমনভাবে তাদেরকে এইসব ধর্মীয় বিষয়গুলোতে অভ্যস্ত করতে হবে যাতে এসব ইবাদাত বা দায়িত্ব পালন তাদের জন্য কঠিন মনে না হয়।
ধর্মীয় সঙ্গীত ও কবিতা শিশুদের ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর দিকে আকৃষ্ট করার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নামাজের জামায়াত ও দোয়ার মজলিশও শিশুদের জন্য খুবই আকর্ষণীয়। শিশুরা যখন দেখবে যে বড়রা অশ্রু বিসর্জন করে আল্লাহর দরবারে মুনাজাত করছেন তখন তা তাদের মনেও খোদার প্রতি অনুরাগ সৃষ্টি করবে। মহামানবদের জন্মদিনের অনুষ্ঠানসহ ইসলামের ঈদ উৎসবগুলোতেও শিশুদের শরিক করা উচিত যাতে তারা এইসব অনুষ্ঠান থেকেও অনেক কিছু শিখতে পারে এবং ধর্মীয় প্রশান্তি পেতে পারে।
পবিত্র কুরআনে বর্ণিত কাহিনীগুলোসহ ধর্মীয় নানা কাহিনী ও ইতিহাস শিশু-কিশোরদের শোনানো উচিত। চার বছর বয়স থেকেই শিশুরা নানা বিষয়ে ব্যাপক কৌতুহলী হয়ে ওঠে। এই বয়সে শিশু যদি প্রশ্ন করে আল্লাহ কোথায় থাকেন? তাকে বলতে হবে: আল্লাহ সব জায়গাতেই আছেন। এরপর শিশু যদি প্রশ্ন করে আল্লাহ কিভাবে সব জায়গায় থাকতে পারেন-অথচ আমরা তাহলে তাকে দেখি না কেন? তখন বলতে হবে: আল্লাহ তো মানুষের মত সীমিত ক্ষমতার অধিকারী নন যে কেবল এক জায়গায় থাকেন, বরং তিনি সর্বশক্তিমান বলে সর্বত্র থাকতে পারেন। সব ঘরের টেলিভিশনের পর্দায় যদি একই বক্তাকে বা একই অনুষ্ঠানকে বিশ্বের সব অঞ্চল থেকে দেখা যায় তাহলে কেন আল্লাহ সর্বত্র উপস্থিত থাকতে পারবেন না? এ ছাড়াও আমরা বাতাস, বিদ্যুৎ ও তাপ এসবকে তো দেখি না যদিও এসবের অস্তিত্ব রয়েছে। মহান আল্লাহর ব্যাপারটাও এমনই যে তাঁকে দেখা যায় না। অথবা এভাবেও বলা যায় যে, একটি চকলেট বা মিছরির টুকরো যদি এক গ্লাস পানিতে গলানো হয় তাহলে তা গ্লাসের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও যেমন দেখা যায় না তেমনি আল্লাহর অস্তিত্বও সর্বত্র থাকা সত্ত্বেও তাঁকে দেখা যায় না।
চার বা এর কাছাকাছি বছর বয়সের শিশুরা অনেক বাবা-মা ও বড় মানুষদের আল্লাহর কাছাকাছি পর্যায়ের বড় কোনো অস্তিত্ব বলে কল্পনা করে। তাই এই বয়সে শিশুরা যেসব প্রশ্ন করে সেসবের এমন উত্তর দেয়া উচিত যাতে তা সঠিকও হয় এবং তারা সন্তুষ্টও হয়। তাদেরকে যুক্তিবিদ্যা বা দর্শন শাস্ত্রের জটিল ও গভীর পরিভাষা এবং জটিল যুক্তিগুলো দিয়ে এসব বিষয় বোঝানোর চেষ্টা করা উচিত নয়। কারণ সীমিত জ্ঞান ও ধারণার অধিকারী শিশুরা এইসব জটিল তত্ত্বের কিছুই বুঝবে না ।
ছয় বছর বয়সে শিশুরা নামাজ ও মুনাজাতের মত বিষয় এবং আল্লাহর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বা সম্পর্ক স্থাপনের মত অনেক কিছুই বুঝতে থাকে। ফলে তারা এ সময় ইবাদাতের অনুরাগী হয়ে ওঠে এবং আল্লাহর কাছে প্রার্থনাও করতে পিছপা হয় না, যদিও তাদের প্রার্থনার বিষয় হতে পারে তাদের খেলনা, খাদ্য ও পোশাক বিষয়ক। সাত বছর বয়স হলে শিশুরা বুঝতে পারে যে তাদের বাবা-মায়ের তুলনায় মহান আল্লাহ অনেক বেশি বড় ও শক্তিশালী। এ সময় তারা আল্লাহ সম্পর্কে আরও বেশি জানতে ও বুঝতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। তাই মহানবী (সা) বলেছেন: যখন তোমার সন্তানের বয়স ছয় বছর হবে তখন তাকে নামাজের দিকে ডাক। আর যখন তার বয়স সাত বছর হবে তখন এ বিষয়ে আরও বেশি তাগিদ দিবে।
ধর্মীয় বিষয় প্রশিক্ষণ দেয়ার ক্ষেত্রে শিশুর সাধ্য ও ক্ষমতার বিষয়টিও মনে রাখা দরকার। মহানবী (সা) বলেছেন, শিশু তার সাধ্য অনুযায়ী যা করেছে তা গ্রহণ করবে, তাদেরকে কোনো কঠিন ও শ্রমসাধ্য কাজ করার আদেশ দিবে না এবং তাদেরকে অবাধ্য ও পাপী হতে বাধ্য করবে না। তাদের কাছে মিথ্যা কথা বলবে না। তাদের সামনে কখনও কোনো হাস্যকর ও বোকামীপূর্ণ কিছু করবে না।– এ থেকে বোঝা যায় শিশুদের শেখাতে হবে ভালোবাসা ও কোমলতার মাধ্যমে বলপ্রয়োগ করে নয়। শিশুদের সঙ্গে নমনীয় আচরণ করা হলে তাদের সঙ্গে হৃদ্যতার সম্পর্কের বন্ধন মজবুত হবে। পরিবারের ভেতরে যখন সে আদর ও যত্ন পাবে তখন সে এসবের সন্ধানে বহির্মূখী হবে না। এই নীতিমালা মেনে চলা হলে বাবা-মা হবে শিশুদের জন্য আদর্শ।#
পার্সটুডে/এমএএইচ/আবুসাঈদ/১৭
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।