জুন ১৭, ২০২১ ১৬:১৮ Asia/Dhaka

শিশুদের ভরণ-পোষণসহ মৌলিক নানা চাহিদা মেটানোর দায়িত্ব তাদের অভিভাবক বা পিতা-মাতার।

আর এমনই এক চাহিদা হল স্নেহ ও ভালবাসার চাহিদা। যথাসময়ে তাদের এই চাহিদা মেটানোর দিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে। কারণ শিশু-কিশোরদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেয়ারও অন্যতম ভিত্তি হল তাদের প্রতি স্নেহ ও ভালবাসা। এ বিষয়টি শিশুদের খাবার দেয়া বা ভরণ-পোষণের চেয়েও কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

শিশু-কিশোরদের এই চাহিদা মেটানো না হলে তাদের চিত্ত প্রশান্ত ও নিরাপদ থাকবে না। অভিভাবকদের প্রতি আস্থা ও আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলার জন্যও এই চাহিদা মেটানো জরুরি। শিশু-কিশোরদের দীর্ঘকাল ধরে স্নেহ ও ভালাবাসা দেয়া না হলে তাদের আত্মবিশ্বাস ও অন্যদের প্রতি তাদের আস্থা বিলুপ্ত হবে। তখন তারা হীনমন্যতায় ভুগবে। এ অবস্থায় তারা রোগ ও শোকের শিকার হবে তারা এবং তাদের মধ্যে দেখা দেবে সামাজিক বিচ্যুতি।

একটি আদর্শ মুসলিম পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক সম্পর্ক হতে হবে ভালবাসা-ভিত্তিক। স্নেহ-ভালবাসায় শিশুরা যত আনন্দ পায় অন্য কোনো কিছুতেই তারা অত আনন্দ পায় না। আসলে শিশুদের এই চাহিদা হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা। তাই শিশুদের জন্য পরিবারের মধ্যে থাকতে হবে পবিত্র ভালবাসার এক প্রাণবন্ত ঝর্ণাধারা। এ ঝর্ণার পানি যদি শুকিয়ে যায় তাহলে তারা দূষিত পানি পান করতে বাধ্য হবে এবং এভাবে এগিয়ে যাবে ধ্বংসের অতল গহ্বরের দিকে। 

স্নেহ ও ভালবাসাহীন মন নিয়ে শিশুদের যতই শেখানোর ও প্রশিক্ষণ দেয়ার চেষ্টা করুন না কেন তা হবে অর্থহীন। যেসব মানুষ বাবা ও মায়ের কিংবা তাদের একজনের স্নেহ পায়নি এবং অন্য কোনো উৎস হতে যেমন, বড় ভাই-বোন কিংবা, খালা-খালু, মামা-মামী বা চাচা-চাচী বা ফুপু-ফুপার মত ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের কাছ হতে তাদের এই অপরিপূর্ণ চাহিদা মেটানো হয়নি তারা শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের এক জরুরি শক্তি হতেই বঞ্চিত হয়েছে।

মহানবী (সা) শিশুদের খুবই ভালবাসতেন। এমনকি অমুসলিম শিশুরাও মহানবীর কাছ থেকে ভালাবাসা ও স্নেহ পেত। তিনি শিশু সন্তানদের ভালবাসতে বলতেন। স্নেহ-ভালবাসা শিশুর ব্যক্তিত্বের ভিত্তি গড়ে তোলে বলে ইসলাম এর ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে বলে।

শিশুদেরকে ও সন্তানদেরকে কেবল মনে মনে ভালবাসলেই হবে না। সেই ভালবাসাটা প্রকাশ করে দেখাতে হবে।  আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ) ইমাম হাসানকে লিখেছিলেন: 'আমি তোমাকে আমার একটি অংশ বরং আমার সমগ্র অংশ হিসেবে পেয়েছি। কোনো কিছু যখন তোমার ওপর হয় আপতিত তখন যেন তা আমার ওপরই পড়ে, মৃত্যু যদি তোমার দিকে আসে তা যেন আমার দিকেই এসেছে! তাই তোমার কাছে এই চিঠি লিখলাম যাতে আমার ভালবাসা তোমার কাছে প্রকাশ করতে পারি।'

সন্তানের প্রতি ভালবাসার প্রকাশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক তথা পিতা-মাতার সাথে সন্তানের সম্পর্ককে জোরদার করে ও তা বাড়াতে থাকে। শিশুরা যখন বুঝতে পারে যে বাবা-মা তাদের স্নেহ করেন তখন তারাও বাবা-মায়ের প্রতি ইতিবাচক আচরণ করে, তাদের অনুরাগী হয়, তাদের প্রতি হয় আন্তরিক এবং তাদের কথা বেশি মাত্রায় মান্য করে। এভাবে স্নেহ ও ভালবাসা শিশুদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য সহায়ক হয়।  

ইসলাম শিশুদের চুমু দেয়ার ওপর বেশ গুরুত্ব দিয়েছে এবং একে সাওয়াবের কাজ বলে উল্লেখ করেছে। মহানবী (সা) বলেছেন, শিশুদেরকে দেয়া প্রতিটি চুম্বনের জন্য বেহেশতে বাবা-মাকে উচ্চতর আসন দেয়া হবে। এভাবেই ইসলাম শিশুদের মানসিক নিরাপত্তার ওপর জোর দিয়েছে। শিশুদের সঙ্গে দয়ার্দ্র চিত্তে কথা বলা, তাদের দিকে স্নেহভরে তাকানো, সন্তানের মাথায় আদর করে হাত বুলানো ও তাদের কোলে নেয়া- এসবই সাওয়াবের কাজ বলে ইসলামী বর্ণনা রয়েছে।

ইমাম মুসা কাযিম (আ) তাঁর শিশু সন্তান ইমাম রেজাকে (আ) চুমু দিতেন, তাঁকে নিজের কাঁধে বসাতেন, তাকে বুকে নিয়ে বা কোলে নিয়ে চেপে ধরতেন স্নেহভরে। আর এ অবস্থায় তিনি বলতেন: তোমার পিতা তোমার জন্য কুরবান হোক্। তোমার ঘ্রাণ কত আনন্দদায়ক, কত সুন্দর তোমার প্রকৃতি ও কত প্রকাশ্য ফজিলত বা গুণ রয়েছে তোমার!- একদিন মহানবী (সা) তাঁর দুই প্রিয় নাতি ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইনকে চুমু খেলেন। সেখানে উপস্থিত কোনো এক সাহাবি বললেন: আমার দশটি সন্তান রয়েছে, এ পর্যন্ত আমি তাদেরকে কখনও চুমু দেইনি! মহানবী (সা) বললেন: মহান আল্লাহ কি তোমার অন্তর থেকে দয়া-মায়া কেড়ে নিয়েছেন? থাকেন তাহলে আর কি করার আছে! অন্য এক বর্ণনায় এসেছে: যারা অন্যদের প্রতি দয়া দেখায় না, তারা দয়া পায় না।  

শিশুদের মন খুবই কোমল। তাদের ভাষাও কোমল। তারা সব সময় আনন্দময় স্বপ্নের জগতে বসবাস করে।  বাবা-মায়ের ফুলের মত কোমল বাক্য ও হৃদয়-জুড়ানো আচরণ তাদের স্নেহ-কাতর মনকে তৃপ্ত ও প্রশান্ত করে। তাদেরকে এমন কোমল ও প্রশান্ত ভালবাসা দেয়ার ক্ষেত্রে যারা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তারা হলেন শিশুর মা ও বাবা। শিশুদের স্নেহের চাহিদা মেটানো তাদের ভরণ-পোষণ তথা খাদ্য ও জামা-কাপড় দেয়ার চেয়েও বেশি জরুরি।  

যেসব শিশু বাবা-মায়ের কাছ থেকে ভালবাসাপূর্ণ ও স্নেহময় কথা শুনে তারা অন্য মানুষের প্রতিও স্নেহশীল এবং কল্যাণকামী হয়। এই শিশুরা যখন বড় হয় তখন স্ত্রী ও সন্তানদের প্রতিও এবং এমনকি সহকর্মী ও বন্ধু-বান্ধবের প্রতিও স্নেহপূর্ণ কোমল বাক্য ও কোমল আচরণ করে থাকে। তাদের ভালবাসাপূর্ণ আচরণে অন্য সবাই প্রফুল্ল থাকে এবং ফলে অন্যরাও তাদের প্রতি একই ধরনের আচরণ করে। 

পরিবারের সদস্যদের প্রতি ভালবাসার ক্ষেত্রে ন্যায় বিচার বজায় রাখার বিষয়টিও জরুরি। ন্যায়বিচার যেন ভালবাসার বলি না হয়। এমন কিছু হলে তা সৃষ্টি করবে ঈর্ষা, অভাববোধ, দুর্বল ব্যক্তিত্ব, অসহায়ত্বের অনুভূতি ও প্রতিশোধ-পরায়নতা এবং পরিণতিতে সন্তানরা বাবা-মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নও করতে পারে। এমনকি পরিবারে সন্তানদের বিষয়ে বৈষম্য ভবিষ্যতে পরিবারের ভিত্তিকে নড়বড়ে করে দিতে পারে।

মহানবী (সা) একবার লক্ষ্য করেন যে এক ব্যক্তি তার এক সন্তানকে চুমু দিচ্ছেন ও অন্য সন্তানকে তা দিচ্ছেন না তখন তিনি প্রতিবাদ করে বললেন: কেন তাদের সঙ্গে সমতাপূর্ণ আচরণ করছ না? !- অন্য এক সময় তিনি বলেছেন: সন্তানদের সঙ্গে ঠিক সেরকম ন্যায়বিচারপূর্ণ আচরণ কর ঠিক যেমনিভাবে দয়া ও কল্যাণের ক্ষেত্রে তোমার প্রতি ন্যায়বিচারপূর্ণ আচরণ করা হবে বলে তুমি প্রত্যাশা কর। #

পার্সটুডে/এমএএইচ/আবুসাঈদ/১৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ