জুন ২৩, ২০২১ ১৭:১৯ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র এ পর্বে সূরা ফুসসিলাতের ২৯ থেকে ৩০ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ২৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا رَبَّنَا أَرِنَا الَّذَيْنِ أَضَلَّانَا مِنَ الْجِنِّ وَالْإِنْسِ نَجْعَلْهُمَا تَحْتَ أَقْدَامِنَا لِيَكُونَا مِنَ الْأَسْفَلِينَ (29)

“কাফিররা বলবে- হে আমাদের প্রতিপালক! জ্বিন ও মানুষদের মধ্যে যারা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল তাদেরকে দেখিয়ে দিন, আমরা তাদেরকে পায়ের তলায় রাখব (ও পদতলে পিষ্ট করব), যাতে তারা নিকৃষ্ট অধমদের মধ্যে গণ্য হয়।(৪১:২৯)

গত আসরে সেই সব কাফেরদের নিয়ে আলোচনা হয়েছিল যারা পার্থিব জীবনে মানুষকে কুরআনের আয়াত শুনতে বাধা দিত। সে আলোচনার সূত্র ধরে আজকের এই আয়াতে বলা হচ্ছে: এ ধরনের মানুষের কারণে যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে তারা কিয়ামতের দিন এদের বিরুদ্ধে আল্লাহর দরবারে নালিশ জানাবে। তারা আল্লাহকে বলবে, যেসব প্রতারক ও ধোঁকাবাজ কাফির তাদেরকে পথভ্রষ্ট করে আজকের চরম পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছে তাদেরকে যেন জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে এবং সবচেয়ে খারাপ স্থানে নিক্ষেপ করা হয়। সেইসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা যেন ওইসব ধোঁকাবাজ ব্যক্তিকে তাদের পায়ের নীচে ফেলে দেন যাতে তারা তাদেরকে পদদলিত করতে পারে। এসব প্রতারক কাফির পার্থিব জীবনে অনেক বড় মাপের অথবা বিখ্যাত মানুষ ছিল বলে কিয়ামতের দিন ধোঁকার শিকার হওয়া ব্যক্তিরা তাদেরকে অপমান করার জন্য পায়ের তলায় নিতে চাইবে।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- কিয়ামতের দিন কাফিররা তাদের কুফর ও পথভ্রষ্টতার দায় অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবে এবং আল্লাহকে একথা বোঝাবে যে, তাদের এই পরিণতির জন্য অন্যরা দায়ী। প্রত্যেক কাফির কোনো না কোনো অজুহাতে অপরের ওপর দোষ চাপাবে।

২- মানুষকে বিপথগামী ও পথভ্রষ্ট করার অনেকগুলো উপকরণ রয়েছে। এদের মধ্যে শয়তান এবং প্রতারক মানুষদের মাধ্যমে বিপথগামী হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি থাকে।

৩- পার্থিব জীবনে বিপথগামী কাফির ও শয়তান প্রকৃতির মানুষ বেশিরভাগ সময় প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান হয়। তারা তাদের ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটিয়ে সাধারণ মানুষকে বিপথগামী ও ধর্মচ্যুত করে। কিয়ামতের দিন তাদের অনুসারী মানুষগুলোই এসব নেতাকে পদদলিত করার জন্য আল্লাহর কাছে আবেদন পেশ করবে।

সূরা ফুসসিলাতের ২৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

 إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللَّهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلَائِكَةُ أَلَّا تَخَافُوا وَلَا تَحْزَنُوا وَأَبْشِرُوا بِالْجَنَّةِ الَّتِي كُنْتُمْ تُوعَدُونَ (30)

“নিঃসন্দেহে যারা বলে- আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ, অতঃপর (সে কথার উপর) অবিচল থাকে, ফেরেশতারা তাদের নিকট অবতীর্ণ হয় (আর বলে), তোমরা ভয় করো না, চিন্তা করো না, আর তোমাদেরকে যে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তার সুসংবাদ গ্রহণ করো। ”(৪১:৩০)

কাফির ও পথভ্রষ্ট ব্যক্তিদেরকে পার্থিব জীবনের চাকচিক্য ও ভোগবিলাসের দিকে আহ্বান করামাত্র তারা সেদিকে ছুটে যায়। প্রকৃতপক্ষে তারা তাদের অন্তরকে এ ধরনের আহ্বানের জন্যই দীর্ঘদিন ধরে প্রস্তুত করেছে বলে সামান্য আহ্বানেই খোদাদ্রোহীদের পানে ছুটে চলে। কিন্তু এর বিপরীতে একদল মানুষ আছে যারা শুধুমাত্র তাদের নবীদের ডাকে সাড়া দেয়। তারা একমাত্র আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে এবং অন্য সব চাকচিক্য ও রিপুর তাড়না প্রত্যাখ্যান করে।  তারা বলে: আমাদের পালনকর্তা হচ্ছে এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহ। তারা এই কথার ওপর অটল ও অবিচল থাকে এবং কোনো অবস্থাতেই এই অবস্থান থেকে সরে যায় না। কিয়ামতে বিশ্বাস এবং ঐশী প্রতিশ্রুতি তাদের অন্তরে এতটা গভীরভাবে স্থান করে নেয় যে, পার্থিব জীবনের ক্ষণস্থায়ী ইন্দ্রীয়সুখ ভোগের দিকে না তাকিয়ে তারা আল্লাহর দেয়া সুনিশ্চিত ও চিরস্থায়ী পুরস্কারের আশায় বুক বাঁধে। কাজেই দ্বীনি দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কোনো কিছুই তাদের জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে না।

অবশ্য মনে রাখতে হবে, আল্লাহর প্রতি ঈমানের দাবিদারদের সংখ্যা কম নয়। কিন্তু বাস্তব জীবনে তাদের অনেকে আল্লাহর পথে অটল-অবিচল থাকতে পারে না। তাদের ঈমান দুর্বল থাকে বলে তারা পার্থিব জীবনের যেকোনো ধরনের ছলচাতুরি ও প্রবঞ্চনার সামনে অসহায় হয়ে পড়ে। তখন তারা ইন্দ্রীয়সুখ ভোগের দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং পার্থিব স্বার্থ বিপন্ন হতে দেখলে সেই দুর্বল ঈমানটুকু তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে অন্তরের কামনা-বাসনা কিংবা নিকটাত্মীয় ও বন্ধুবান্ধবের পক্ষ থেকে ফূর্তি করে সময় কাটানোর আহ্বানকে উপেক্ষা করার মতো মানুষ পৃথিবীতে খুব কম। একইভাবে শত্রুর হুমকি ও হামলায় দুর্বল ও অসহায় বোধ করে না- এমন মানুষের সংখ্যাও বেশি নয়।

যাই হোক, আল্লাহ তায়ালার নিয়ম হচ্ছে প্রকৃত মুমিন ব্যক্তিদের সাহায্য করা। তাঁর সাহায্য করার অন্যতম উপায় হচ্ছে মুমিন ব্যক্তিদের অন্তরে ফেরেশতা নাজিল করে তাদেরকে মানসিক শক্তি যোগানো এবং পরকালীন মহা পুরস্কারের ব্যাপারে আশাবাদী করে তোলা। এর ফলে মুমিন ব্যক্তিদের অন্তর থেকে শত্রুদের পাশাপাশি ভবিষ্যতের ব্যাপারে ভয় দূর হয়ে যায়। সেইসঙ্গে অতীতের কার্যকলাপ ও ঘটনাপ্রবাহের ব্যাপারে মনে দুঃখ ও কষ্ট থাকলে তাও দূর হয়ে যায়। এ ধরনের মানুষকে ফেরেশতারা জান্নাতের সুসংবাদ শোনান।

নিঃসন্দেহে আল্লাহর পাঠানো ফেরেশতাদের এই সুসংবাদ ঈমানদার ব্যক্তিদের অন্তরে নূর বিকিরণ করে, জীবনের কঠিন পরিস্থিতিগুলোতে তাদেরকে শক্তি যোগায় এবং বিপথে গমনের স্থানগুলোতে তাদেরকে ঈমানের পথে অটল রাখে।

মুমিন ব্যক্তিদের প্রতি আল্লাহ তায়ালা এই অনুগ্রহ এজন্য করেন যে, তারা তাদের রবের নির্দেশ পালন করে নিজেদের কুপ্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণে রেখে মন্দ কাজের আহ্বানে সাড়া দেয়নি। খারাপ কাজে ক্ষণস্থায়ী সুখ রয়েছে বলে তার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করা কঠিন। এই কঠিন কাজটি করার মতো দৃঢ়তা দেখানোর কারণে আল্লাহ তায়ালা তাদের অন্তরে এসব কাজ থেকে বিরত থাকার শক্তি বাড়িয়ে দেন। কিন্তু পার্থিব জীবনে মুমিন ব্যক্তিরা যেসব মনোবাসনা পূর্ণ করতে পারেনি পরকালীন জীবনে আল্লাহ তায়ালা সে ক্ষতি পুষিয়ে দেবেন এবং তাদেরকে যা খুশি তাই করতে দেবেন। জান্নাত অপরাধ করার স্থান নয়। সেখানে মুমিন ব্যক্তিরা আল্লাহর অতিথি হিসেবে তাঁর দেয়া অফুরন্ত নেয়ামত অনন্তকাল ধরে ভোগ করবে।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- মুমিন ব্যক্তিদের বন্ধুর সংখ্যা কম হলেও তাদের আসমানি বন্ধু অর্থাৎ ফেরেশতা বন্ধুদের সংখ্যা কম নয়। ফেরেশতারা মুমিন ব্যক্তিদেরকে আল্লাহর ইচ্ছায় দুনিয়া ও আখেরাতে সহায়তা করে।

২- জান্নাতে শুধু যে মানুষের বস্তুগত ও শারিরীক চাহিদা মেটানোর ব্যবস্থা থাকবে তা নয় বরং সব ধরনের আত্মিক প্রশান্তির ব্যবস্থা করবেন আল্লাহ তায়ালা। জান্নাতবাসীর কাছে আত্মিক প্রশান্তি লাভের আবেদন বস্তুগত কামনাবাসনা পূর্ণ করার চেয়ে কোনো অংশে কম হবে না। আল্লাহ বলেছেন, জান্নাতবাসীর অন্তরে কোনো ভয়, কষ্ট বা দুঃখ থাকবে না।

৩- মুমিন ব্যক্তিদের প্রতি আল্লাহ তায়ালা রহমত ও ক্ষমার দৃষ্টিতে তাকাবেন বলেই তারা জান্নাতে যেতে পারবে। আর এ বিষয়টি আল্লাহ তায়ালার অসীম ও অফুরন্ত ক্ষমা প্রদানের বিষয়টি ফুটিয়ে তোলে।#

পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/২৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।