জুন ২৬, ২০২১ ২০:৪৭ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র এ পর্বে সূরা ফুসসিলাতের ৪৯ থেকে ৫৪ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ৪৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

لَا يَسْأَمُ الْإِنْسَانُ مِنْ دُعَاءِ الْخَيْرِ وَإِنْ مَسَّهُ الشَّرُّ فَيَئُوسٌ قَنُوطٌ (49)

“মানুষ (যা কিছু) কল্যাণ (মনে করে তা) প্রার্থনায় কোন ক্লান্তি বোধ করে না, কিন্তু যখন তাকে অকল্যাণ স্পর্শ করে তখন সে প্রচণ্ডভাবে হতাশ ও অধৈর্য হয়ে পড়ে।” (৪১:৪৯)

বেঈমান বা দুর্বল ঈমানের মানুষেরা সাধারণত স্বল্পবুদ্ধির ও কম সহনশীল হয়। এ ধরনের মানুষ পার্থিব সুখ শান্তির জন্য ধন-সম্পদ আকাঙ্ক্ষা করতে ক্লান্তিবোধ করে না এবং তাদের যত বেশি সম্পদ হয় তত বেশি চাইতে থাকে। যত বেশি সম্পদশালীই হোক না কেন তারা কখনো তৃপ্ত হয় না। কিন্তু এই পৃথিবী যদি তাদের প্রতি বিমুখ হয়, তাদের কোনো বিপদ আসে বা সম্পদ কমে যায় তখন তারা চরম হতাশ হয়ে পড়ে। মনে হয় যেন গোটা আকাশ তাদের মাথার ওপর ভেঙে পড়েছে। বস্তুবাদী ধ্যানধারণার বাইরে কোনো কিছু চিন্তা করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- মানুষ সাধারণত লোভী হয় ও ভালো সবকিছু পেতে চায়। কিন্তু সম্পদ জমা না করে যত বেশি সম্ভব দান-সদকা করা হচ্ছে নবী-রাসূলদের শিক্ষা।

২- বিপদে পড়লে হতাশ হয়ে পড়া দুর্বল ঈমানের পরিচায়ক। ঈমানদার ব্যক্তি কখনো নিজেকে অসহায় ভাবে না।

সূরা ফুসসিলাতের ৫০ ও ৫১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

وَلَئِنْ أَذَقْنَاهُ رَحْمَةً مِنَّا مِنْ بَعْدِ ضَرَّاءَ مَسَّتْهُ لَيَقُولَنَّ هَذَا لِي وَمَا أَظُنُّ السَّاعَةَ قَائِمَةً وَلَئِنْ رُجِعْتُ إِلَى رَبِّي إِنَّ لِي عِنْدَهُ لَلْحُسْنَى فَلَنُنَبِّئَنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا بِمَا عَمِلُوا وَلَنُذِيقَنَّهُمْ مِنْ عَذَابٍ غَلِيظٍ (50) وَإِذَا أَنْعَمْنَا عَلَى الْإِنْسَانِ أَعْرَضَ وَنَأَى بِجَانِبِهِ وَإِذَا مَسَّهُ الشَّرُّ فَذُو دُعَاءٍ عَرِيضٍ (51)

“আর যদি দুঃখ-দৈন্য স্পর্শ করার পর আমি তাকে আমার পক্ষ থেকে অনুগ্রহের আস্বাদন দেই, তখন সে জোর দিয়ে বলে থাকে, ‘এটি আমার ন্যায্য অধিকার এবং আমি মনে করি না যে, কিয়ামত সংঘটিত হবে। আর যদি আমাকে আমার রবের কাছে ফিরিয়ে নেয়াও হয়, তবুও তার কাছে আমার জন্য শ্রেষ্ঠ (পুরস্কার) থাকবে। অতএব, আমি অবশ্যই কাফিরদেরকে তাদের আমল সম্বন্ধে অবহিত করব এবং তাদেরকে অবশ্যই আস্বাদন করাব কঠোর শাস্তি।” (৪১:৫০)

“আর যখন আমরা মানুষের প্রতি অনুগ্রহ করি তখন সে মুখ ফিরিয়ে নেয় ও (আমার থেকে) দূরে সরে যায়। আর যখন তাকে অকল্যাণ স্পর্শ করে তখন সে (ওই অকল্যাণ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য) দীর্ঘ সময় ধরে অনেক বেশি দোয়া প্রার্থনা করে।” (৪১:৫১)

আগের আয়াতে সুখ ও দুঃখের সময়গুলোতে বেঈমান ব্যক্তিদের অবস্থা বর্ণনা করার পর এই দুই আয়াতে এসব মানুষের বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন: এসব মানুষ অহংকারী হয় এবং নিজেদের জীবনে তারা আল্লাহর কোনো ভূমিকা দেখতে পায় না। তাদের যে ধন-সম্পদ ও প্রভাব-প্রতিপত্তি রয়েছে তাকে তারা নিজেদের যোগ্যতার অর্জন বলে মনে করে। এই অহংকার মানুষকে শেষ পর্যন্ত পরকালে অবিশ্বাসী করে তোলে। তারা বলে: পরকাল বলে কিছু নেই। আর যদি পরকাল থেকেও থাকে তাহলে সেখানেও আমার প্রচুর আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা থাকবে। কিন্তু এ ধরনের একরোখা মানুষদের ব্যাপারে আল্লাহ বলছেন: আমি তাদেরকে শিগগিরই তাদের কৃতকর্মের ফল জানিয়ে দেব এবং পরকালে তাদেরকে দেব কঠিন শাস্তি।

পরের আয়াতে এ ধরনের দুর্বল ঈমানদার ব্যক্তির প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হচ্ছে: তাদেরকে প্রচুর পরিমাণে পার্থিব সম্পদ দান করলে তারা আল্লাহকে ভুলে যায় এবং দম্ভভরে তাঁর শিক্ষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। তাদের ভাবখানা তখন এমন হয় যেন আল্লাহর প্রতি তাদের কোনো বিশ্বাস নেই। কিন্তু যখন তাদের জীবনে বিপদ-আপদ নেমে আসে তখন তারা আল্লাহকে দীর্ঘ সময় ধরে ডাকে এবং এমনভাবে কাকুতি-মিনতি করে যেন এসব বিপদ-আপদের জন্য আল্লাহই দায়ী!

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- পথভ্রষ্ট মানুষের ধারণ ক্ষমতা কম থাকে এবং তারা অহংকারী হয়।

২- আমরা আল্লাহর দেয়া নেয়ামত তাঁর অনুগ্রহে পাই, আমাদের যোগ্যতার বলে নয়। কাজেই সারাক্ষণ এসব নেয়ামতের শোকর আদায় করতে হবে।

৩- ধন-সম্পদ ও প্রভাব-প্রতিপত্তি থাকা আল্লাহর ভালোবাসায় ধন্য হওয়ার নিদর্শন নয়। কাজেই এসবের অধিকারী মানুষেরা যেন স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরকালেও এরকম আয়েশি জীবন পাওয়ার আশা না করে।

৪- সুখের সময়ে আল্লাহকে ভুলে গেলে চলবে না বরং তার বিধিবিধান মেনে চলতে হবে। তা না হলে এসব নেয়ামত আমাদের জন্য ধ্বংস ডেকে আনতে পারে।

সূরা ফুসসিলাতের ৫২ থেকে ৫৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

قُلْ أَرَأَيْتُمْ إِنْ كَانَ مِنْ عِنْدِ اللَّهِ ثُمَّ كَفَرْتُمْ بِهِ مَنْ أَضَلُّ مِمَّنْ هُوَ فِي شِقَاقٍ بَعِيدٍ (52) سَنُرِيهِمْ آَيَاتِنَا فِي الْآَفَاقِ وَفِي أَنْفُسِهِمْ حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُ الْحَقُّ أَوَلَمْ يَكْفِ بِرَبِّكَ أَنَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ شَهِيدٌ (53) أَلَا إِنَّهُمْ فِي مِرْيَةٍ مِنْ لِقَاءِ رَبِّهِمْ أَلَا إِنَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ مُحِيطٌ (54)

“বলুন, তোমরা আমাকে জানাও, যদি (এ কুরআন) আল্লাহর কাছ থেকে নাযিল হয়ে থাকে, আর তোমরা এটা প্রত্যাখ্যান কর, তবে যে ব্যক্তি (কুরআনের) ঘোর বিরুদ্ধাচরণে লিপ্ত, তার চেয়ে বেশি বিভ্রান্ত আর কে আছে?”  (৪১:৫২)

“অচিরেই আমি তাদেরকে বিশ্ব জগতের প্রান্তসমূহে এবং তাদের নিজেদের মধ্যে আমাদের নিদর্শনাবলী দেখাব যাতে তাদের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, তিনি (এবং তাঁর কুরআন) অবশ্যই সত্য। এটা কি যথেষ্ট নয় যে, আপনার রব সব কিছুর উপর সাক্ষী?” (৪১:৫৩)

“জেনে রাখুন, নিশ্চয় তারা (কিয়ামত দিবসে) তাদের রবের সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যাপারে ঘোরতরভাবে সন্দিহান। জেনে রাখুন, নিশ্চয় তিনি (অর্থাৎ আল্লাহ) সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে রয়েছেন।” (৪১:৫৪)

এখানকার প্রথম আয়াতে কাফিরদের উদ্দেশ করে বলা হচ্ছে: তোমরা কুরআনের এতটা বিরোধিতা করার আগে একবারও কি ভেবে দেখবে না যে, এই কিতাব আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিল হয়ে থাকতে পারে? যদি কুরআন সত্য হয়ে থাকে এবং এতে বর্ণিত জান্নাত ও জাহান্নাম সঠিক হয়ে থাকে তাহলে তোমরা কিয়ামতের দিন কি করবে? কাজেই তোমরা চিন্তাভাবনা করো এবং শুধুমাত্র অন্ধ বিশ্বাসে পূর্বপুরুষদের অনুসৃত পথ অবলম্বন করো না।

পরের আয়াতে বলা হচ্ছে, আল্লাহর অস্তিত্বের বহু প্রমাণ এই পৃথিবীর চারপাশে এমনকি মানুষের দেহের ভেতরেও রয়েছে। তোমরা কেন সেগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করো না। যদি করতে তাহলে তোমাদের কাছে আল্লাহর সত্যতা স্পষ্ট হয়ে যেত।

তোমরা যখন শরিয়তের কিতাবে সংশয় করছ তখনি কি প্রকৃতির কিতাবেও সংশয় করবে?! কারণ, এই বিশাল সুবিন্যস্ত প্রকৃতি ও সৃষ্টিজগত তৈরি ও তা প্রতিপালনে তো একজন মহাজ্ঞানী ও মহাশক্তিধর সৃষ্টিকর্তার প্রয়োজন।  সূর্য, চন্দ্র ও তারকারাজি সৃষ্টি এবং সেগুলোকে নির্দিষ্ট নিয়মের তাবেদার করে দেয়া, বিভিন্ন ধরনের প্রাণী, উদ্ভিদ, পাহাড়, সাগর- এগুলোর প্রতিটি মহান আল্লাহর পবিত্র সত্ত্বার নিদর্শন। এছাড়া, মানব দেহের শ্বাসতন্ত্র, পরিপাকতন্ত্র, রক্ত চলাচল ব্যবস্থা, হৃদপিণ্ডের সুনিপুণ কাজ, মস্তিষ্কের অভূতপূর্ব কার্যক্ষমতাসহ শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ- এগুলোর প্রতিটির মধ্যেই রয়েছে সেই পবিত্র সত্ত্বার অপার মহিমা ও নিদর্শন।

‘আমি আমার নিদর্শনাবলী দেখাব’ এই বাক্য থেকে একথা প্রতীয়মান হয় যে, বর্তমানের মতো ভবিষ্যতেও তিনি তাঁর নিদর্শনাবলী দেখাবেন।  মানব জাতি জ্ঞান-বিজ্ঞানে যত উন্নতি করে ততই তার সামনে আল্লাহর সৃষ্টিরহস্যের নতুন নতুন দিক উন্মোচিত হয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে কাফিররা যেমন বিশ্বজগতের সৃষ্টি নিয়ে সংশয়ের মধ্যে রয়েছে তেমনি এর পরিণতি নিয়েও তারা সন্দিহান। তারা আল্লাহ তায়ালার সাক্ষাতের ব্যাপারে ঘোরতর সংশয়ে লিপ্ত। তবে এ বিষয়ে চিন্তা-গবেষণা করে সঠিক ধারণা লাভেরও কোনো অভিপ্রায় তাদের নেই। তারা বিষয়টিকে অন্তর থেকে মেনে নেবে না বলেই মুখে সংশয় প্রকাশ করে। তারা যেকোনো ধরনের নোংরা কাজ ও অপকর্ম করতে দ্বিধা করে না। কিন্তু তাদের জেনে রাখা উচিত সবকিছুর উপর আল্লাহর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এবং কিয়ামত দিবসে তাঁর সামনে প্রতিটি কথা ও কাজের হিসাব দিতে হবে।

এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে:

১- বুদ্ধিমান মানুষ যেকোনো বড় বিপদ দেখলে তা থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করে। কাজেই পরকালের কঠিন বিপদের ভয়ে যে মানুষ গোনাহ ও পাপকাজ থেকে বিরত থাকে সে-ই বুদ্ধিমান।

২- সৃষ্টির শুরু এবং শেষের প্রতি ঈমান একই সুতায় গাঁথা। কারণ, যে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন তিনিই একদিন এর অবসান ঘটাবেন এবং ভালো-মন্দের বিচার করবেন। #

পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/০৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।