সূরা জুখরুফ : আয়াত ১১-১৫ (পর্ব-২)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র এ পর্ব থেকে সূরা জুখরুফের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। পবিত্র কুরআনের ৪৩তম এই সূরায় ৮৯টি আয়াত রয়েছে। মক্কায় অবতীর্ণ অন্যান্য সূরার মতো এই সূরাতেও আল্লাহ, পরকাল ও নবুওয়াতের মতো আকিদাগত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই সূরার ১১ ও ১২ নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
وَالَّذِی نَزَّلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً بِقَدَرٍ فَأَنْشَرْنَا بِهِ بَلْدَةً مَیْتًا کَذَلِکَ تُخْرَجُونَ ﴿١١﴾ وَالَّذِی خَلَقَ الأزْوَاجَ کُلَّهَا وَجَعَلَ لَکُمْ مِنَ الْفُلْکِ وَالأنْعَامِ مَا تَرْکَبُونَ ﴿١٢﴾
“আর যিনি আসমান থেকে বারি বর্ষণ করেন পরিমিতভাবে। অতঃপর তা দ্বারা আমি সঞ্জীবিত করি মৃত জনপদকে। এভাবেই তোমাদেরকেও (কবর থেকে) বের করা হবে।”(৪৩:১১)
“আর যিনি সকল প্রকারের জোড়াসমূহ সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন এমন নৌযান ও চতুস্পদ জন্তু যাতে তোমরা আরোহণ কর।” (৪৩:১২)
এই দুই আয়াতে বলা হচ্ছে: ভূপৃষ্ঠ, গাছপালা ও মানুষের জীবন আকাশ থেকে বৃষ্টিবর্ষণের ওপর নির্ভরশীল। পৃথিবীর কোনো স্থানে যদি দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হয় তাহলে সেখানে খরা ও দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে। প্রশ্ন হচ্ছে, সাগর থেকে সূর্যের তাপে জলীয় বাস্প ও মেঘমালা সৃষ্টি এবং তার মাধ্যমে স্থলভাবে বৃষ্টিপাতের বিশাল কর্মযজ্ঞে মানুষের কি কোনো হাত আছে? উত্তর হচ্ছে- নেই। শুষ্ক মাটির মধ্যে গাছের যে বীজ লুকিয়ে থাকে তা একমাত্র বৃষ্টির পানি পাওয়ার পরই অঙ্কুরিত হয় এবং মাটি ফেটে বেরিয়ে আসে। অসংখ্য লতাগুল্ম, উদ্ভিদ ও ফসল এই প্রক্রিয়ায় আল্লাহ তায়ালা মানুষের জন্য ফুলে-ফলে সুশোভিত করে দেন।
এরপর আল্লাহ মানুষকে উদ্দেশ করে বলছেন: এই মৃত মাটির জীবিত হওয়ার মতো তোমরাও একদিন কবর থেকে জীবিত হয়ে বেরিয়ে আসবে। বৃষ্টির পানি পেয়ে মাটির নীচের মৃত বীজ যেভাবে জীবিত গাছে পরিণত হয় সেভাবেই কিয়ামতের দিন আল্লাহর নির্দেশে কবরস্থ মানুষেরা জীবিত হয়ে মাটি ভেদ করে বেরিয়ে আসবে। কাজেই কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সংশয় পোষণ করা উচিত নয়। কারণ, আল্লাহ একই রকম নিদর্শন পৃথিবীতে মানুষের চোখের সামনে ঘটিয়ে দেখাচ্ছেন। পরের আয়াতে জোড়া সৃষ্টির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিটি জীবের প্রজন্ম সংরক্ষণের জন্য আল্লাহ এসব জীবকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন যা তাঁর অপার জ্ঞান ও ক্ষমতার নিদর্শন।
সেইসঙ্গে এই আয়াতে জলপথে চলাচলের জন্য নৌযান ও স্থলপথে চলার জন্য চতুস্পদ জন্তুর কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং এটিও মানুষের প্রতি আল্লাহর অশেষ রহমতের নিদর্শন। সদূর অতীতকাল থেকে সাগরে জাহাজসহ অন্যান্য নৌযানের মাধ্যমে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে মানুষ ও পণ্য পরিবহনের রেওয়াজ ছিল। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, হাজার হাজার টন ওজনের জাহাজ পদার্থবিজ্ঞানের বিশেষ নিয়মের কারণে পানিতে তলিয়ে যায় না; আর এই নিয়ম একমাত্র আল্লাহই এমন সময় প্রকৃতিতে সৃষ্টি করে রেখেছেন যখন মানুষ পদার্থবিজ্ঞান কি তা-ই জানত না। এই বিজ্ঞানের নিয়ম মেনেই মানুষ আজ নানারকম যানবাহন ও উড়োজাহাজ সৃষ্টি করে অল্প সময়ের মধ্যে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে চলে যাচ্ছে। আল্লাহ তায়ালা একদিকে যেমন প্রকৃতিকে মানুষের সহায়ক করে দিয়েছেন তেমনি এসব নৌ, স্থল ও আকাশযান সৃষ্টি করার মেধা ও শক্তি মানুষকে দিয়েছেন।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- বিশ্ব প্রকৃতির সবকিছু একটি নির্ধারিত নিয়ম মেনে চলে যা আল্লাহই সৃষ্টি করে দিয়েছেন।
২- জ্ঞান-বিজ্ঞানে মানুষ যত উন্নতিই করুক তা প্রকৃতিতে বিদ্যমান ব্যবস্থার সাহায্য নিয়ে করছে। তাদের পক্ষে প্রাকৃতিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। তারা শুধু আগে থেকে বিদ্যমান ব্যবস্থাগুলো আবিষ্কার করে তার সঠিক ব্যবহার করছে মাত্র।
সূরা জুখরুফের ১৩ খেকে ১৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
لِتَسْتَوُوا عَلَى ظُهُورِهِ ثُمَّ تَذْکُرُوا نِعْمَةَ رَبِّکُمْ إِذَا اسْتَوَیْتُمْ عَلَیْهِ وَتَقُولُوا سُبْحَانَ الَّذِی سَخَّرَ لَنَا هَذَا وَمَا کُنَّا لَهُ مُقْرِنِینَ ﴿١٣﴾ وَإِنَّا إِلَى رَبِّنَا لَمُنْقَلِبُونَ ﴿١٤﴾
“যাতে তোমরা এর পিঠে স্থির হয়ে বসতে পার। তারপর তোমরা এর উপর স্থির হয়ে বসার পর তোমাদের রবের অনুগ্রহ স্মরণ করবে এবং বলবে: পবিত্র -মহান তিনি, যিনি এই (বাহনকে) আমাদের বশীভূত করে দিয়েছেন। তা না হলে আমরা এদেরকে বশীভূত করতে সক্ষম ছিলাম না।”(৪৩:১৩)
“আর আমরা অবশ্যই আমাদের রবের নিকট প্রত্যাবর্তন করব।”(৪৩:১৪)
এই দুই আয়াতে বলা হচ্ছে: যখন তোমরা কোনো বাহনে চড়বে সেটি ঘোড়া, গাধা বা খচ্চর হোক কিংবা মানবসৃষ্ট জাহাজ, উড়োজাহাজ, গাড়ি বা ট্রেন হোক তখন একথা ভুলে যেও না যে, এগুলো আল্লাহই তোমাদের হাতে বশীভূত করে দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন পদার্থের মধ্যে যে গুণাগুণ সৃষ্টি করে দিয়েছেন তোমরা কেবল সেগুলো আবিষ্কার করে এসব পদার্থ দিয়ে জাহাজ, উড়োজাহাজ ও ট্রেনের মতো বাহন সৃষ্টি করে তা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছো। সেইসঙ্গে যেসব পশুকে তোমরা বাহন হিসেবে ব্যবহার করো সেগুলো শারিরীক আকার ও শক্তিতে তোমাদের চেয়ে অনেক বেশি বলবান এবং স্বাভাবিকভাবে সেগুলো তোমাদের বশীভূত হওয়ার কথা ছিল না।
অর্থাৎ আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ না থাকলে তোমরা এগুলোকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারতে না। কাজেই যে আল্লাহ তায়ালা এত বড় অনুগ্রহ তোমাদের করেছে তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো।
পরের আয়াতে আল্লাহর কাছে মানুষের ফিরে যাওয়ার প্রসঙ্গ এসেছে। কোনো বাহনে চড়ার সময় যেন তোমাদের মধ্যে অহংকার না জন্মে এবং দুনিয়ার চাকচিক্য যেন তোমাদেরকে আল্লাহর কাছে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে উদাসীন করে না দেয়। যেকোনো অবস্থায় আখেরাতের কথা স্মরণ রাখতে হবে। এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যাওয়ার সময় মনে রাখতে হবে, একদিন আমরা এভাবেই ইন্তেকাল করব অর্থাৎ পার্থিব জগত ছেড়ে পরকালীন জগতে চলে যাব।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- বস্তুগত নেয়ামত ভোগ করার সময় আল্লাহকে ভুলে যাওয়া যাবে না বরং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হবে। আল্লাহর নামে দোয়া ও তসবীহ পাঠ করে এই কৃতজ্ঞতাকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে হবে।
২- আল্লাহ তায়ালার সামনে আমাদেরকে অক্ষম ও দুর্বল হিসেবে তুলে ধরতে হবে। এটি কৃতজ্ঞতা প্রকাশেরই নামান্তর। কোনো অবস্থাতে কোনো কিছুর জন্যই অহংকার করা যাবে না।
৩- পার্থিব জগতের প্রতিটি সফরের সময় আমাদেরকে পরকালীন সফর অর্থাৎ মৃত্যুর কথা স্মরণ রাখতে হবে।
সূরা জুখরুফের ১৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
وَجَعَلُوا لَهُ مِنْ عِبَادِهِ جُزْءًا إِنَّ الإنْسَانَ لَکَفُورٌ مُبِینٌ ﴿١٥﴾
“আর তারা তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে তার অংশ (অর্থাৎ সন্তান) সাব্যস্ত করেছে। নিশ্চয়ই মানুষ স্পষ্ট অকৃতজ্ঞ।”(৪৩:১৫)
সৃষ্টি ও প্রতিপালনে আল্লাহর একত্ববাদের কিছু নিদর্শন বর্ণনা করার পর এই আয়াতে কিছু মানুষের শিরকি আচরণের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে বলা হচ্ছে: মুশরিকরা কীভাবে এই ধারণা করে যে, ফেরেশতারা আল্লাহর সন্তান? তারা কীভাবে ভাবতে পারে যে, মানুষের সন্তানদের মতো ফেরেশতাদেরও পিতা-মাতা রয়েছে?
অথচ আল্লাহ তায়ালা এমন এক মহাসত্ত্বা যিনি শারিরীক অবয়বের অনেক ঊর্ধ্বে। কাজেই যাঁকে শরীর হিসেবেই ধরে নেয়া যায় না তার কোনো অংশ থাকতে পারে না যা এই দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হবে। ফেরেশতারা আর দশটি সৃষ্টির মতো আল্লাহ তায়ালারই সৃষ্টি। বিশ্বজগত পরিচালনার কিছু কাজ আল্লাহ তাদেরকে দিয়ে করান। কিন্তু তারা আল্লাহর কোনো অংশ বা তাঁর সন্তান নয়।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- ইতিহাসে যুগে যুগে আল্লাহ সম্পর্কে অনেক কুসংস্কার ও ভুল ধারনা প্রচলিত ছিল। মানুষ অজ্ঞতার কারণে অথবা নবী-রাসূলগণের শিক্ষা থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণে এসব ধারনা পোষণ করত।
২- কুসংস্কার ও শিরক মিশ্রিত বিশ্বাসের কারণে আল্লাহর সঙ্গে মানুষের দূরত্ব তৈরি হয় এবং মানুষ সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে কুফরির দিকে ধাবিত হয়।#
পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ১৪
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।