সূরা জুখরুফ : আয়াত ১৬-২২ (পর্ব-৩)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র এ পর্ব থেকে সূরা জুখরুফের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। পবিত্র কুরআনের ৪৩তম এই সূরায় ৮৯টি আয়াত রয়েছে। মক্কায় অবতীর্ণ অন্যান্য সূরার মতো এই সূরাতেও আল্লাহ, পরকাল ও নবুওয়াতের মতো আকিদাগত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই সূরার১৬, ১৭ ও ১৮ নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
أَمِ اتَّخَذَ مِمَّا یَخْلُقُ بَنَاتٍ وَأَصْفَاکُمْ بِالْبَنِینَ ﴿١٦﴾ وَإِذَا بُشِّرَ أَحَدُهُمْ بِمَا ضَرَبَ لِلرَّحْمَنِ مَثَلا ظَلَّ وَجْهُهُ مُسْوَدًّا وَهُوَ کَظِیمٌ ﴿١٧﴾ أَوَمَنْ یُنَشَّأُ فِی الْحِلْیَةِ وَهُوَ فِی الْخِصَامِ غَیْرُ مُبِینٍ ﴿١٨﴾
“তিনি (অর্থাৎ আল্লাহ) কি তাঁর সৃষ্টি হতে (নিজের জন্য) কন্যা-সন্তান গ্রহণ করেছেন এবং তোমাদের জন্য মনোনীত করেছেন পুত্র সন্তান?”(৪৩:১৬)
“যখন তাদের কাউকে সুসংবাদ দেয়া হয় সেই সন্তানের (জন্মগ্রহণ করার) যা সে দয়াময় আল্লাহর প্রতি আরোপ করে, তখন তার মুখমণ্ডলে কালিমা ছেয়ে যায় এবং সে দুঃসহ মর্ম যাতনায় ক্লিষ্ট হয়।” (৪৩:১৭)
“যে অলংকারে ও সাজসজ্জায় লালিত-পালিত হয় এবং তর্ক-বিতর্ক (কালে) স্পষ্ট যুক্তি দানে অসমর্থ (তোমরা কি আল্লাহর প্রতি এমন সন্তান আরোপ করো)?” (৪৩:১৮)
যুগে যুগে বিভিন্ন জাতির মধ্যে যে ভ্রান্ত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিশ্বাস প্রচলিত ছিল এই তিন আয়াতে সে বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। ওই অন্ধ বিশ্বাসের ভিত্তিতে তারা পুরুষকে নারীর চেয়ে শ্রেয় মনে করত এবং কন্যাসন্তানের জন্মগ্রহণকে নিজেদের জন্য কলঙ্কজনক মনে করত। তাই এখানে বলা হচ্ছে: তোমরা ছেলে সন্তানকে শ্রেয় মনে করো এবং ছেলে সন্তান জন্ম নিলে খুশি হও; কিন্তু কন্যা সন্তান জন্ম নিলে কেন তোমাদের কষ্ট শুরু হয়ে যায়? কেন তোমরা মুখটা মলিন করে ফেল?
এর চেয়ে খারাপ হচ্ছে, তোমরা নিজেদের জন্য ছেলে সন্তান চাও আর আল্লাহর নামে কন্যা সন্তান চালিয়ে দাও। তোমরা বলে বেড়াও যে, আমি কন্যা সন্তান চাইনি এটা আল্লাহ দিয়েছেন। ছেলে যেহেতু কৃষিকাজ ও ব্যবসায়ে তোমাদের সহযোগী হতে পারে এবং যুদ্ধ-বিগ্রহেও তোমাদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে কাজেই তাকে তোমরা নিজের মনে করো। কিন্তু কন্যা যেহেতু ঘরে থাকে, অলঙ্কারও সাজ-সজ্জার মধ্যে লালিত পালিত হয় এবং ঝগড়া-বিবাদে শক্তিমত্তার অবস্থানে থেকে কথা বলতে পারে না, কাজেই তাকে আল্লাহর নামে চালিয়ে দাও।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ছেলে ও মেয়ে উভয়ই আল্লাহর সৃষ্টি এবং মানবজাতির প্রজন্ম রক্ষা করতে হলে তাদের দু’জনকেই প্রয়োজন। আল্লাহ তায়ালার কাছে তাদের কারো মর্যাদা অপরের চেয়ে বেশি নয়; যদিও শারিরীক ও মানসিক গঠন ও বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নারী ও পুরুষ আলাদা আলাদা দায়িত্ব পালন করে। এর একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কথা ও আচরণে নারীর মধ্যে আবেগ-অনুভূতি বেশি কাজ করে। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তায়ালা মানবজীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা অর্থাৎ মায়ের ভূমিকা পালনের জন্য নারীকে সৃষ্টি করেছেন, তাদের মধ্যে আবেগ-অনুভূতির পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছেন এবং এ কারণে তাদেরকে সামরিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের দায়িত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছেন।
এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে:
১- ছেলে ও মেয়ে সন্তানের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও ভ্রান্ত বিশ্বাসের ফসল যা করতে পবিত্র কুরআন কঠোর ভাষায় নিষেধ করেছে।
২- অলঙ্কার পরিধান ও সাজগোজ করা নারীদের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য এবং নারীদের জমায়েতে এটি করতে ইসলাম নিষেধ করেনি।
৩- যুদ্ধ-বিগ্রহ ও সংঘর্ষে নারীর অংশগ্রহণ বাঞ্ছনীয় নয় কারণ, প্রকৃতিগতভাবে নারী এসব করার জন্য জন্মগ্রহণ করেনি।
সূরা জুখরুফের ১৯ খেকে ২০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
وَجَعَلُوا الْمَلائِکَةَ الَّذِینَ هُمْ عِبَادُ الرَّحْمَنِ إِنَاثًا أَشَهِدُوا خَلْقَهُمْ سَتُکْتَبُ شَهَادَتُهُمْ وَیُسْأَلُونَ ﴿١٩﴾ وَقَالُوا لَوْ شَاءَ الرَّحْمَنُ مَا عَبَدْنَاهُمْ مَا لَهُمْ بِذَلِکَ مِنْ عِلْمٍ إِنْ هُمْ إِلا یَخْرُصُونَ ﴿٢٠﴾
“ওরা দয়াময় (আল্লাহর বান্দা) ফেরেশতাদেরকে নারী বলে স্থির করে, ওরা কি তাদের সৃষ্টি প্রত্যক্ষ করেছিল? ওদের উক্তি শিগগিরই লিপিবদ্ধ করা হবে এবং ( এ ব্যাপারে) ওদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।”(৪৩:১৯)
“আর ওরা বলে, ‘পরম দয়াময় (আল্লাহ) ইচ্ছা না করলে আমরা এদের পূজা করতাম না।’ এ বিষয়ে ওদের কোন জ্ঞান নেই; ওরা তো কেবল অনুমান-ভিত্তিক কথাই বলে ও মিথ্যাচার করে।” (৪৩:২০)
মক্কার মুশরিকদের একটি ভ্রান্ত বিশ্বাস ছিল এই যে, তারা ফেরেশতাদেরকে আল্লাহ তায়ালার কন্যা সন্তান বলে মনে করত। এই বিশ্বাসের ওপর তারা এতটা অটল ছিল যে, তাদের কথায় মনে হতো, তারা ফেরেশতাদের সৃষ্টির সময় উপস্থিত ছিল এবং তারা এ বিষয়টি দেখতে পেয়েছে যে, আল্লাহ কন্যা সন্তান জন্ম দিচ্ছেন! এর চেয়ে খারাপ হচ্ছে, তারা ফেরেশতাদের পূজা করতে শুরু করেছিল এবং ফেরেশতারা স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে সৃষ্টিজগত পরিচালনার কিছু দায়িত্ব পালন করছে বলে বিশ্বাস করত। অথচ এই বিশ্বাস ছিল সম্পূর্ণ অনুমান-নির্ভর এবং তাদের কাছে এ সম্পর্কে কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ছিল না। এ কারণে পবিত্র কুরআনে বলা হচ্ছে: তাদের এই ভ্রান্ত বিশ্বাসের ব্যাপারে কিয়ামত দিবসে তাদের কাছে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সেদিন তাদের কাছে কোনো জবাব থাকবে না।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- ফেরেশতারা আল্লাহর সৃষ্টি; আল্লাহর কন্যা নয়। তাদের মধ্যে মানুষের মতো নারী-পুরুষের কোনো বিষয় নেই।
২- ফেরেশতা হোক কিংবা হযরত ঈসা (আ.)-এর মতো মানুষ হোক আল্লাহর কোনো সৃষ্টির ইবাদত বা পূজা করা যাবে না।
৩- আমরা যেন মনে না করি আমরা যা কিছু বলছি ও মুখ থেকে বের করছি তা শেষ হয়ে যাচ্ছে। বরং, আমরা যা কিছু বলছি তা সঙ্গে সঙ্গে রেকর্ড হয়ে যাচ্ছে এবং একদিন প্রতিটি কথার হিসাব দিতে হবে।
এবং
৪- আমরা যেন নিজেদের অন্যায় কাজের দায় আল্লাহ তায়ালার ওপর চাপিয়ে না দেই। আল্লাহ নবী-রাসূল ও কিতাব পাঠিয়ে আমাদেরকে অন্যায় করতে নিষেধ করেছেন।
সূরা জুখরুফের ২১ ও ২২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
أَمْ آتَیْنَاهُمْ کِتَابًا مِنْ قَبْلِهِ فَهُمْ بِهِ مُسْتَمْسِکُونَ ﴿٢١﴾ بَلْ قَالُوا إِنَّا وَجَدْنَا آبَاءَنَا عَلَى أُمَّةٍ وَإِنَّا عَلَى آثَارِهِمْ مُهْتَدُونَ ﴿٢٢﴾
“আমি তাদেরকে কুরআনের আগে কি কোনো কিতাব দিয়েছি যে, তারা তা দৃঢ়ভাবে ধারণ করে আছে?”(৪৩:২১)
“বরং তারা বলে: নিশ্চয় আমরা আমাদের পিতৃপুরুষদেরকে একটি মতাদর্শের উপর পেয়েছি এবং নিশ্চয় আমরা তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে হেদায়াতপ্ৰাপ্ত হয়েছি।”(৪৩:২২)
এই আয়াতে মুশরিকদের ভ্রান্ত বিশ্বাসের কারণ উল্লেখ করে বলা হচ্ছে: তারা তাদের ভ্রান্ত বিশ্বাসে অটল থাকার ব্যাপারে কোনো আসমানি কিতাব বা নবীদের শিক্ষাকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরতে পারেনি, কারণ নবী-রাসূলরা কখনো মানুষকে কুসংস্কার শিক্ষা দেননি। তারা বরং তাদের পূর্বপুরুষদের দেখাদেখি অন্ধবিশ্বাস অনুসরণ করছে। তাদের পিতৃপুরুষরা ছিল অজ্ঞ-মূর্খ, তাদের কোনো ঐশী জ্ঞান ছিল না এবং আন্দাজ অনুমান করে তারা আল্লাহ সম্পর্কে বিভিন্ন ভ্রান্ত বিশ্বাস পোষণ করত। এই বিশ্বাসে যেমন কোনো যুক্তি-বুদ্ধি বা জ্ঞানের অস্তিত্ব নেই তেমনি এতে অতীত নবী-রাসূলদের কোনো ঐশী গ্রন্থেরও উদ্ধৃতি পাওয়া যায় না। তারা শুধু অন্ধভাবে তাদের পূর্বপুরুষদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- বিশ্বাস হতে হবে বুদ্ধিবৃত্তি এবং ওহীভিত্তিক। বুদ্ধিবৃত্তি কিংবা ঐশী কিতাবের বাণী দিয়ে যা প্রমাণ করা যায় না তা শিরক ও কুসংস্কার। কোনো সমাজে যদি এ ধরনের কুসংস্কার চালু থাকে এবং সবাই মিলেও যদি তা অনুসরণ করে তারপরও তা গ্রহণযোগ্য নয়।
২- পূর্বপুরুষদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে গিয়ে আমরা যেন সমাজে ভ্রান্ত রীতিনীতি ও আচার-অনুষ্ঠান প্রচার বা প্রসারে ব্যস্ত হয়ে না পড়ি সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
এবং
৩- পবিত্র কুরআনের দৃষ্টিতে অন্ধবিশ্বাস ও অযৌক্তিক আচরণকে আকড়ে ধরে জাতিগত, বর্ণগত বা ভাষাগত গোঁড়ামি গ্রহণযোগ্য নয়।#
পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ১৫
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।