সূরা জুখরুফ : আয়াত ২৩-২৮ (পর্ব-৪)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র এ পর্ব থেকে সূরা জুখরুফের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। পবিত্র কুরআনের ৪৩তম এই সূরায় ৮৯টি আয়াত রয়েছে। মক্কায় অবতীর্ণ অন্যান্য সূরার মতো এই সূরাতেও আল্লাহ, পরকাল ও নবুওয়াতের মতো আকিদাগত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই সূরার ২৩ নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
وَکَذَلِکَ مَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِکَ فِی قَرْیَةٍ مِنْ نَذِیرٍ إِلا قَالَ مُتْرَفُوهَا إِنَّا وَجَدْنَا آبَاءَنَا عَلَى أُمَّةٍ وَإِنَّا عَلَى آثَارِهِمْ مُقْتَدُونَ ﴿٢٣﴾
“এভাবে আপনার পূর্বে কোন জনপদে যখনই কোন সতর্ককারী প্রেরণ করেছি, তখনই ওদের মধ্যে যারা বিত্তশালী, আরামপ্রিয় ও দাম্ভিক ছিল তারা বলেছে: ‘আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে একটি মতাদর্শের অনুসারী পেয়েছি এবং আমরা তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করছি।” (৪৩:২৩)
এর আগের আয়াতগুলোতে মূর্তিপূজা করার জন্য মক্কার মুশরিকরা যে অজুহাত তুলে ধরেছিল তা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এরপর আজকের এই আয়াতে রাসূলুল্লাহ (সা.)কে উদ্দেশ করে বলা হচ্ছে: মক্কার মুশরিকরা যা বলে তা নতুন কোনো কথা নয়। এর আগে বিভিন্ন শহর ও জনপদে প্রেরিত নবী-রাসূলগণ যখনই মানুষকে শিরক ও মূর্তিপূজা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন তখনই তারা বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করার পরিবর্তে নবীদের বলেছে: আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া ধর্ম ছেড়ে অন্য কোনো বিশ্বাস গ্রহণ করতে পারব না।
এখানে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের পাশাপাশি সম্পদশালী, আরামপ্রিয় ও দাম্ভিক লোকজন নবী-রাসূলদের বিরোধিতায় নেতৃত্ব দিয়েছে। অর্থাৎ নবীদের বিরোধিতাকারীদের বেশিরভাগ ছিল আত্মম্ভরী এবং সম্পদ ও ক্ষমতার অধিকারী। আর সাধারণ মানুষ তাদের ভয়ে কিংবা তাদের কাছে দুনিয়াবি স্বার্থ থাকার কারণে এসব দাম্ভিক লোককে অনুসরণ করত।
বর্তমান সময়েও বিশ্বব্যাপী ক্ষমতা ও সম্পদের অধিকারীরা সর্বগ্রাসী প্রচারযন্ত্র ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে প্রতারিত ও হতবুদ্ধি করে রেখেছে। বিশ্বের বেশিরভাগ অপকর্ম, সংঘাত ও দুর্নীতি এই আগ্রাসী জালিমদের মাধ্যমেই সংঘটিত হচ্ছে। তাদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে গেলেই তাকে কঠোর হাতে দমন করা হয় যাতে তার পক্ষে আর কোনো উচ্চবাচ্য করা সাহস না থাকে।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- পূর্বপুরুষদের ধর্মবিশ্বাস, সভ্যতা ও সংস্কৃতির অনুসরণ করতে গিয়ে আমরা যেন চিন্তা-গবেষণা করার পথ বন্ধ করে না দেই। আমাদের উচিত পূর্বপুরুষদের ক্রিয়াকলাপ নিয়ে চিন্তাভাবনা করা এবং সেখানে কোনো ভুল-ত্রুটি থাকলে তা সংশোধন করা।
২- প্রতিটি সমাজে এমন আন্তরিক ও বিজ্ঞ কিছু মানুষ থাকা প্রয়োজন যারা সম্ভাব্য বিপদ-আপদ উপলব্ধি করে সে সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করবে; যদিও বেশিরভাগ মানুষ এসব সতর্কবাণীতে ভ্রুক্ষেপ করবে না এবং বিজ্ঞ মানুষদের বিরোধিতায় লিপ্ত হবে।
৩- সম্পদ ও ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হলে তা মানুষকে স্বেচ্ছাচারী বানিয়ে দেয়। এ কারণে যুগে যুগে সম্পদশালী ও ক্ষমতাধর লোকজন নবী-রাসূলদের শিক্ষা ও ঐশী ধর্মের বিরোধিতায় নেতৃত্ব দিয়েছে।
সূরা জুখরুফের ২৪ - ২৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
قَالَ أَوَلَوْ جِئْتُکُمْ بِأَهْدَى مِمَّا وَجَدْتُمْ عَلَیْهِ آبَاءَکُمْ قَالُوا إِنَّا بِمَا أُرْسِلْتُمْ بِهِ کَافِرُونَ ﴿٢٤﴾ فَانْتَقَمْنَا مِنْهُمْ فَانْظُرْ کَیْفَ کَانَ عَاقِبَةُ الْمُکَذِّبِینَ ﴿٢٥﴾
(তাদের নবীরা যখন) বলত: ‘তোমরা তোমাদের পূর্বপুরুষগণকে যার অনুসারী পেয়েছো, আমি যদি তোমাদের জন্য তা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট পথনির্দেশ আনয়ন করি (তবুও কি তোমরা তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে?)’ (প্রত্যুত্তরে) তারা বলত: ‘তোমরা যা নিয়ে প্রেরিত হয়েছ, আমরা তা প্রত্যাখ্যান করি।” (৪৩:২৪)
“সুতরাং আমি ওদের নিকট থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করলাম। অতএব দেখ, (সত্য) প্রত্যাখ্যানকারীদের পরিণাম কি হয়েছে?” (৪৩:২৫)
পূর্বপুরুষদের পদাঙ্ক অনুসরণ সম্পর্কে কাফেরদের বক্তব্যের জবাবে নবী-রাসূলগণ বলতেন: আমি যে ধর্ম নিয়ে এসেছি তা যদি তোমাদের পিতৃপুরুষদের চেয়ে ভালো হয় এবং দুনিয়া ও আখিরাতে তোমাদের জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনে তবুও কি তোমরা এই ধর্ম গ্রহণ করবে না? তোমরা কি সৌভাগ্য অর্জন করতে চাও না? যে মতাদর্শ ও ধর্ম তোমাদের সৌভাগ্য নিশ্চিত করে তোমাদের উচিত সেটি গ্রহণ করা।
কিন্তু গোয়ার্তুমি, উগ্রতা ও পূর্বপুরুষদের প্রতি অন্ধবিশ্বাসের কারণে আল্লাহর রাসূলের এ আহ্বান নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা না করেই তারা জবাব দিত: তুমি নিশ্চিত থাকো আমরা তোমাদের প্রতি ঈমান আনব না। কাজেই শুধু শুধু বকবক করে আমাদের জন্য অশান্তি সৃষ্টি করো না!
এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে: নবী-রাসূলগণ মুশরিকদের ধর্মের অসারতার কথা জানার পরও তাদের সঙ্গে বিতর্কের সময় একথা বলতেন না যে: তোমরা কেন ভ্রান্ত পথ ত্যাগ করে আমাদের সত্য পথ অনুসরণ করছ না? তারা বরং নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে বলতেন: তোমরা তোমাদের ধর্মের সঙ্গে আমার ধর্মের তুলনা করে দেখো। আগে দেখো তোমাদের দৃষ্টিতে কোনটা শ্রেয় মনে হয়, তারপর সেটিকে বেছে নাও।
দাম্ভিক ও গোঁয়ার প্রকৃতির লোকদের সঙ্গে আলোচনা ও বিতর্কের সময় পবিত্র কুরআনে বর্ণিত এই রীতি অনুসরণ করতে হবে। তাদের সামনে দু’টি পথ তুলে ধরে যেটি ভালো সেটি গ্রহণ করার আহ্বান জানাতে হবে। পরের আয়াতে বলা হচ্ছে: এসব জেদি ও অবাধ্য মানুষদের এই একগুঁয়ে আচরণের কারণে গোটা জাতি নবী-রাসূলগণের সঙ্গে চরম বেয়াদবি করেছে এবং এর ফলে তাদের ওপর আল্লাহর গজব নাজিল হয়েছে। কখনো ভয়াবহ তুফান, কখনো বিধ্বংসী ভূমিকম্প এবং কখনো প্রচণ্ড ঝঞ্ঝাবায়ু ও বজ্রপাতে এ ধরনের অবাধ্য ও কাফের জাতিকে আল্লাহ ধ্বংস করে দিয়েছেন।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- অমুসলিমদের কাছে ইসলামের বাণী পৌঁছে দেয়ার উৎকৃষ্ট পন্থা হলো অন্যান্য ধর্মের সঙ্গে এই ঐশী ধর্মের তুলনা করা এবং তা করতে হবে যুক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তি দিয়ে।
২- যেকোনো মতাদর্শ বা বিশ্বাসের প্রতি অন্ধ অনুসরণ মানুষকে সঠিক পথের দিশা থেকে বঞ্চিত রাখে। তার পক্ষে সঠিক পথ পাওয়া দুষ্কর হয়ে যায়।
সূরা জুখরুফের ২৬ থেকে ২৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِیمُ لأبِیهِ وَقَوْمِهِ إِنَّنِی بَرَاءٌ مِمَّا تَعْبُدُونَ ﴿٢٦﴾ إِلا الَّذِی فَطَرَنِی فَإِنَّهُ سَیَهْدِینِ ﴿٢٧﴾ وَجَعَلَهَا کَلِمَةً بَاقِیَةً فِی عَقِبِهِ لَعَلَّهُمْ یَرْجِعُونَ ﴿٢٨﴾
“আর (স্মরণ করুন) যখন ইবরাহীম তার পিতা এবং তার সম্প্রদায়কে বলেছিলেন, তোমরা যেগুলোর ইবাদত কর সেগুলোর সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।”(৪৩:২৬)
“তবে তিনি ব্যতীত যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন অতঃপর নিশ্চয় তিনি আমাকে সঠিক পথের দিশা দেবেন।”(৪৩:২৭)
“আর এই (ঐশী) ঘোষণাকে তিনি চিরন্তন বাণীরূপে রেখে গিয়েছেন তার উত্তরসূরীদের মধ্যে, যাতে তারা (আল্লাহর দিকে) ফিরে আসে।”(৪৩:২৮)
এই তিন আয়াতে আল্লাহর নবী হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর জীবনী সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হয়েছে যাতে মক্কার মুশরিকদের একথা বলা যায় যে: তোমরা যখন ইব্রাহিমকে নিজেদের পূর্বপুরুষ বলে দাবি করছ তখন সেই পূর্বপুরুষের ধর্ম অনুসরণ করতে হলেও তো ইব্রাহিমের একত্ববাদী ধর্ম অনুসরণ করতে হয়। তোমরা তা কেন করছ না?
ইব্রাহিম যখন দেখলেন তাঁর পালক পিতা আযোর ও তাঁর জাতি শিরকে লিপ্ত তখন তিনি তাদের ধর্মবিশ্বাস থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখেন। তিনি তাঁর জাতিকে বলে দেন: আমি কেবলমাত্র আমার সৃষ্টিকর্তা এক আল্লাহর ইবাদত করি। আমি সঠিক পথের দিশা পাওয়ার জন্য তাঁর আশ্রয় প্রার্থনা করছি এবং আমি নিশ্চিত যে, তিনি আমাকে বিপথে ঠেলে দেবেন না।
হযরত ইব্রাহিম (আ.) তাঁর তৌহিদের বাণী অনন্তকাল পৃথিবীর বুকে টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে সারাজীবন আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। কাজেই শিরক ও মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে সংগ্রাম হচ্ছে হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সুন্নত। তাঁর পরের নবী-রাসূলগণ তাঁর সেই সুন্নত অনুসরণ করেছেন এবং তাকে আরো শক্তভিতের ওপর প্রতিষ্ঠা করেছেন।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- কোনো বিশেষ দেশ, জাতি বা দলের প্রতি আমাদের দুর্বলতার কারণে আমরা যেন জীবনের জন্য সঠিক পথটি বেছে নিতে ভুল না করি। আমাদের উচিত যতটা সম্ভব সত্যপথ খুঁজে বের করে সেই পথ অনুসরণ করা।
২- যে আল্লাহ তায়ালা আমাদের সৃষ্টি করেছেন তিনি আমাদেরকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ছেড়ে দিতে পারেন না। কাজেই তিনি আমাদেরকে হেদায়াত করা বা সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য আক্ল বা বুদ্ধিবৃত্তির পাশাপাশি কিতাব দিয়েছেন।#
পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ১৫
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।