জুলাই ১৪, ২০২১ ১৭:৩৭ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র এ পর্ব থেকে সূরা জুখরুফের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। পবিত্র কুরআনের ৪৩তম এই সূরায় ৮৯টি আয়াত রয়েছে। মক্কায় অবতীর্ণ অন্যান্য সূরার মতো এই সূরাতেও আল্লাহ, পরকাল ও নবুওয়াতের মতো আকিদাগত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই সূরার ২৯ ও ৩০ নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

بَلْ مَتَّعْتُ هَؤُلاءِ وَآبَاءَهُمْ حَتَّى جَاءَهُمُ الْحَقُّ وَرَسُولٌ مُبِینٌ ﴿٢٩﴾ وَلَمَّا جَاءَهُمُ الْحَقُّ قَالُوا هَذَا سِحْرٌ وَإِنَّا بِهِ کَافِرُونَ ﴿٣٠﴾

বরং আমিই তাদেরকে এবং তাদের পূর্ব-পুরুষদেরকে সুযোগ দিয়েছিলাম (নানা প্রকার নেয়ামত) ভোগের; অবশেষে তাদের নিকট এলো সত্য ও স্পষ্ট বার্তাবাহক রাসূল।” (৪৩:২৯)

আর যখন তাদের কাছে সত্য এলো, তখন তারা বলল, এ তো জাদু এবং নিশ্চয় আমরা তা প্রত্যাখ্যান করছি।” (৪৩:৩০)

আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের কাছে সত্যের বার্তা না পাঠিয়ে তাদেরকে শাস্তি দেন না মক্কার মুশরিকরাও এই সুযোগ পেয়েছিল মহান আল্লাহ আরব জাতির কাছে তাদেরই মধ্য থেকে একজনকে নবী হিসেবে প্রেরণ করেন যাতে তারা তাঁর কথা সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করতে ও সত্যকে গ্রহণ করতে পারে কিন্তু বেশিরভাগ জাতির মতো যখন আরব জাতির কাছে সত্য আসে তখন তাদের বেশিরভাগ লোক তার বিরোধিতা করে এবং সত্যের বার্তাবাহককে যাদুকর হিসেবে অভিহিত করে কিন্তু তারপরও আল্লাহ তায়ালা তাদের কাছ থেকে পার্থিব নেয়ামতরাজি উঠিয়ে নেননি বরং তাদেরকে সত্য পথে ফিরে আসার জন্য সময় দিয়েছেন।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

- আল্লাহর পক্ষ থেকে যা কিছু নাজিল হয়েছে তার সবকিছুই সত্য মানবজাতি যদি এই সত্যের বিরোধিতা করে কোনো আইন তৈরি করে তা ভ্রান্ত; যদিও বেশিরভাগ মানুষ তা মেনে চলে

- কারো কাছে ভোগবিলাসের সব উপকরণ থাকার অর্থ এই নয় যে, আল্লাহ তাকে ভালোবাসেন তিনি মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত সময় দেন

- মানুষ যখন সত্য উপলব্ধি করতে পারে তখন তার প্রতি আল্লাহর দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় এরপর যদি মানুষ তা গ্রহণ করতে গড়িমসি করে তাহলে তা হবে কুফরি ও সত্যের বিরোধিতার নামান্তর

সূরা জুখরুফের ৩১ ও ৩২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

وَقَالُوا لَوْلا نُزِّلَ هَذَا الْقُرْآنُ عَلَى رَجُلٍ مِنَ الْقَرْیَتَیْنِ عَظِیمٍ ﴿٣١﴾ أَهُمْ یَقْسِمُونَ رَحْمَةَ رَبِّکَ نَحْنُ قَسَمْنَا بَیْنَهُمْ مَعِیشَتَهُمْ فِی الْحَیَاةِ الدُّنْیَا وَرَفَعْنَا بَعْضَهُمْ فَوْقَ بَعْضٍ دَرَجَاتٍ لِیَتَّخِذَ بَعْضُهُمْ بَعْضًا سُخْرِیًّا وَرَحْمَةُ رَبِّکَ خَیْرٌ مِمَّا یَجْمَعُونَ ﴿٣٢﴾

আর তারা বলল- এ কুরআন (মক্কা ও তায়েফ এই) দুই জনপদের কোন গণ্যমান্য ব্যক্তির উপর কেন অবতীর্ণ হল না?”(৪৩: ৩১)

তারা কি আপনার রবের রহমত বণ্টন করে? আমিই দুনিয়ার জীবনে তাদের মধ্যে তাদের জীবিকা বণ্টন করি এবং তাদের একজনকে (অন্যের) উপর মর্যাদায় উন্নীত করি যাতে তাদের কেউ কেউ অন্যের দ্বারা কাজ করিয়ে নিতে পারে; আর তারা যা জমা করে তা থেকে আপনার রবের রহমত উৎকৃষ্টতর।(৪৩: ৩২)

এখানে সত্য গ্রহণ না করার অজুহাত হিসেবে মক্কার মুশরিকদের একটি বড় অজুহাত তুলে ধরা হয়েছে  তারা বলেছিল: যদি আমাদের ভেতর থেকেই নবী পাঠানো হয় তাহলে মক্কা ও তায়েফের কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তিকে কেন এ কাজের জন্য বাছাই করা হলো না? এমন একজনকে কেন নবুওয়াতের জন্য বেছে নেয়া হলো যে শিশুকালে এতিম হয়েছে এবং এখন পার্থিব ধন-সম্পদ ও জৌলুস বলে যার কিছু নেই?

তারা নবুওয়াতকে গোত্র প্রধানের মতো কোনো পদ হিসেবে ধরে নিয়েছিল যে পদে বসবে সম্পদশালী বা ক্ষমতাবান কোনো ব্যক্তি গোত্রের সব লোক তাকে ভয় পাবে অথচ বাস্তবতা হচ্ছে নবুওয়াতের যোগ্য হবেন তিনি যিনি পবিত্র আত্মার অধিকারী একজন পরিপূর্ণ মানব, সত্যবাদী, সচ্চরিত্রবান, সাহসী, জ্ঞানী ও মর্যাদাসম্পন্ন মানুষ একইসঙ্গে সমাজের বঞ্চিত শ্রেণির দুর্দশার সঙ্গে যিনি পরিচিত থাকবেন ইতিহাসের যুগে যুগে যত নবী-রাসূল এসেছেন তাদের সবাই এসব গুণের অধিকারী ছিলেন

পরে আয়াতে বলা হচ্ছে: নবুওয়াত কাকে দেয়া হবে সে সিদ্ধান্ত কি আল্লাহ তায়ালা মানুষের কাছে জিজ্ঞাসা করে নেবেন? এটা কি হতে পারে যে, মানুষ যাকে চাইবে তিনি তাকে নবুওয়াত দেবেন আর যাকে চাইবে না তাকে দেবেন না? না তা হতে পারে না আল্লাহ মানুষের অন্তরের খবর রাখেন এবং তিনিই ভালো জানেন কে নবুওয়াত পাওয়ার যোগ্য

নবুওয়াতের পাশাপাশি পার্থিব বিষয়াদিতেও মানুষের মধ্যে সামর্থ্য ও যোগ্যতায় ব্যাপক তারতম্য দেখা যায় এটিও আল্লাহর প্রজ্ঞা দ্বারা নির্ধারিত হয় বাস্তবতা হচ্ছে, সব মানুষের শারিরীক ও মানসিক শক্তি, ক্ষমতা ও সামর্থ্য একই রকম হলে মানব সমাজ পরিচালনা করা সম্ভব হতো না আল্লাহ তায়ালা বরং সমাজের সব কাজ করার মতো মানুষ সৃষ্টি করেছেন ফলে একজন যে কাজ পারে তা দিয়ে সে অন্যদেরকে সাহায্য করে এভাবে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সমাজ ও রাষ্ট্রসহ গোটা বিশ্ব পরিচালিত হচ্ছে

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

- বেশিরভাগ মানুষের কাছে সম্পদ, ক্ষমতা ও যশের মাধ্যমে মানুষের মর্যাদা নির্ধারিত হয় কিন্তু আল্লাহর কাছে এসব মানদণ্ডের কোনো মূল্য নেই

- পার্থিব জীবনে আমরা যেসব নেয়ামত ভোগ করি তা আল্লাহ তায়ালাই নির্ধারণ করেন দুনিয়াবি বিষয়াদিতেই যখন মানুষের কোনো হাত নেই তখন নবুওয়াতের মতো অতি গুরত্বপূর্ণ বিষয়ের সিদ্ধান্ত আল্লাহ মানুষের হাতে ছেড়ে দিতে পারেন না

- সমাজ পরিচালনায় সব শ্রেণির মানুষের প্রয়োজন আছে কাজেই ধনী ও সম্পদশালী ব্যক্তিরা যেন সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে অপমান-অপদস্থ না করে এবং সম্পদ ও ক্ষমতার দম্ভ না দেখায়

সূরা জুখরুফের ৩৩ থেকে ৩৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

وَلَوْلا أَنْ یَکُونَ النَّاسُ أُمَّةً وَاحِدَةً لَجَعَلْنَا لِمَنْ یَکْفُرُ بِالرَّحْمَنِ لِبُیُوتِهِمْ سُقُفًا مِنْ فَضَّةٍ وَمَعَارِجَ عَلَیْهَا یَظْهَرُونَ ﴿٣٣﴾ وَلِبُیُوتِهِمْ أَبْوَابًا وَسُرُرًا عَلَیْهَا یَتَّکِئُونَ ﴿٣٤﴾ وَزُخْرُفًا وَإِنْ کُلُّ ذَلِکَ لَمَّا مَتَاعُ الْحَیَاةِ الدُّنْیَا وَالآخِرَةُ عِنْدَ رَبِّکَ لِلْمُتَّقِینَ ﴿٣٥﴾

সব মানুষের (আল্লাহকে অস্বীকার ক’রে) এক জাতিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা না থাকলে যারা দয়াময় আল্লাহকে অস্বীকার করে তাদেরকে অবশ্যই তাদের গৃহের জন্য রৌপ্য নির্মিত ছাদ আর সিঁড়ি দিতাম যাতে তারা আরোহণ করত।” (৪৩:৩৩)

এবং তাদের ঘরের জন্য দরজা ও পালংক (দিতাম) যাতে তারা হেলান  দিতে পারে।” (৪৩:৩৪)

এবং (দিতাম প্রচুর পরিমাণ) স্বর্ণালংকার। কিন্তু এ সব তো পার্থিব জীবনের (সামান্য) ভোগ্যবস্তু  আর মুত্তাকিদের জন্য তোমার প্রতিপালকের নিকট রয়েছে পরকাল। ”(৪৩:৩৫)

আল্লাহ তায়ালা কেন সম্পদের অধিকারী ও ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের নবুওয়াত দেননি মুশরিকদের সে প্রশ্নের উত্তর দেয়ার পর এই তিন আয়াতে বলা হচ্ছে: আল্লাহর কাছে এসব পার্থিব বিষয়াদির বিন্দুমাত্র মূল্য নেই তাঁর কাছে আত্মিক পবিত্রতা ও তাকওয়া গুরুত্বপূর্ণ এবং তিনি এসবের ভিত্তিতে নিজ বান্দাদের কাজকর্ম নির্ধারণ করে দেন সোনা-রূপাসহ অন্যান্য অলঙ্কার ও বিলাসী পণ্য মানুষের চোখে অতি মূল্যবান এবং এসব পাওয়ার জন্যই সে দিনরাত পরিশ্রম করে কিন্তু আল্লাহর কাছে এগুলো পুরোপুরি মূল্যহীন  কাফেরদের এসব দুনিয়াবি চাকচিক্য দেখে যদি দুর্বল ঈমানদার মুসলমানদের কাফের হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা না থাকত তাহলে আল্লাহ তায়ালা কাফেরদের সমস্ত আসবাবপত্র এমনকি ঘরের সিঁড়ি পর্যন্ত স্বর্ণ দিতে বাধাই করে দিতেন

দুর্বল ঈমানদারদের ঈমান চলে যাওয়ার আশঙ্কা না থাকলে তিনি সব কাফেরের জন্য প্রাদাদোপম বাড়ি তৈরি করে দিতেন যার খাট-পালঙ্কসহ সব আসবাবপত্র স্বর্ণখচিত থাকত এ ছাড়া, তাদের ব্যবহারের প্রতিটি সামগ্রী এমন সব মূল্যবান ধাতু দিয়ে তৈরি করে দিতেন যাতে পার্থিব ভোগসামগ্রীতে তারা সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছে যেত  তিনি যদি সেটা করতেনও তাহলে এজন্য করতেন যে, কাফেররা পরকালে আল্লাহর কাছে কিছুই পাবে না এবং এই দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবন শিগগিরই শেষ হয়ে যাবে পরের আয়াতে বলা হচ্ছে: কিন্তু এসব চাকচিক্য ও বিলাসী পণ্য পার্থিব জীবনের সামান্য ভোগ্যবস্তু আর আখিরাতের চিরকালীন জীবনের কল্যাণ নির্ধারিত রয়েছে শুধুমাত্র মুত্তাকি বা পরহেজগারদের জন্য

এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

- বেশিরভাগ মানুষ চোখে যা দেখে তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে তারা যদি কাফেরদেরকে সুখ-শান্তিতে থাকতে ও আরাম-আয়েশ ভোগ করতে দেখে তাহলে ধরে নেয় যে, কাফেররাই সঠিক পথে আছে

- মানুষের মর্যাদা তার নিজের ওপর নির্ভর করে; তার গাড়ি, বাড়ি, আসবাব ও বিলাসী পণ্যের ওপর নয় মানুষ নিজের অন্তরকে বিশুদ্ধ করে কতটা নৈতিক চরিত্র ও আত্মিক পবিত্রতা অর্জন করল সেসবের ওপর আল্লাহর কাছে তার মর্যাদা নির্ধারিত হয়

- পার্থিব জীবনে আমরা যদি মুত্তাকি ও নেক আমলকারী হতে পারি তাহলে কিয়ামতের দিন আল্লাহ মহা প্রতিদান দিয়ে আমাদেরকে দুনিয়ার জীবনের ভোগসামগ্রীর ক্ষতি পুষিয়ে দেবেন সেদিন আল্লাহর কাছে যা পাওয়া যাবে তা পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ও ক্ষমতাবান মানুষের কাছেও নেই#

পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ১৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ