সূরা জুখরুফ : আয়াত ৩৬-৪২ (পর্ব-৬)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র এ পর্ব থেকে সূরা জুখরুফের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। পবিত্র কুরআনের ৪৩তম এই সূরায় ৮৯টি আয়াত রয়েছে। মক্কায় অবতীর্ণ অন্যান্য সূরার মতো এই সূরাতেও আল্লাহ, পরকাল ও নবুওয়াতের মতো আকিদাগত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই সূরার ৩৬ ও ৩৭ নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
وَمَنْ یَعْشُ عَنْ ذِکْرِ الرَّحْمَنِ نُقَیِّضْ لَهُ شَیْطَانًا فَهُوَ لَهُ قَرِینٌ ﴿٣٦﴾ وَإِنَّهُمْ لَیَصُدُّونَهُمْ عَنِ السَّبِیلِ وَیَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ مُهْتَدُونَ ﴿٣٧﴾
“যে ব্যক্তি পরম দয়াময় আল্লাহর স্মরণে উদাসীন হয় আমি তার জন্য এক শয়তানকে নিয়োজিত করি, অতঃপর সে হয় তার সহচর।”(৪৩:৩৬)
“আর নিশ্চয় তারা (অর্থাৎ শয়তানরা) মানুষদেরকে সৎপথ থেকে বাধা দেয়, অথচ মানুষরা (ভ্রষ্ট পথে থাকার পরও) মনে করে তারা হেদায়াতপ্রাপ্ত।” (৪৩:৩৭)
গত আসরে আমরা বলেছি, দুনিয়াপ্রেমী মানুষেরা পার্থিব জীবনের সবকিছুকে বস্তুবাদী চিন্তাচেতনা থেকে পরিমাপ করে এবং সারাক্ষণ ধন-সম্পদ ও প্রভাব-প্রতিপত্তি অর্জনের চেষ্টায় মত্ত থাকে। অন্যদিকে প্রকৃত মুমিন ব্যক্তিদের সারাক্ষণের ব্যস্ততা থাকে আখেরাতের প্রস্তুতি নেয়ার কাজে এবং দুনিয়ার চাকচিক্যের প্রতি তাদের কোনো মোহ থাকে না।
এরপর এই দুই আয়াতে বলা হচ্ছে, বস্তুবাদী চিন্তায় ডুবে থাকা এবং পার্থিব সম্পদের প্রতি মোহের সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক হলো এর ফলে মানুষ আল্লাহ তায়ালার স্মরণ থেকে বিচ্যুত হয়ে পরকাল সম্পর্কে উদাসীন হয়ে যায়। এ অবস্থায় শয়তান তার ওপর ভর করে বসে এবং তার ইচ্ছেমতো এই ব্যক্তিকে পরিচালিত করতে থাকে।
অন্য কথায় মানুষের অন্তর আল্লাহ তায়ালা অথবা শয়তান- এই দুইয়ের যেকোনো একজনের জন্য নির্ধারিত। আল্লাহকে ভুলে গিয়ে দুনিয়ার চাকচিক্যের নেশায় মেতে থাকা এবং নানারকম পাপ কাজে লিপ্ত থাকলে মানুষের জীবনের পুরো নিয়ন্ত্রণ শয়তানের হাতে চলে যায়। এই মানুষের অন্তরে আল্লাহর কোনো স্থান থাকে না। এ ধরনের মানুষকে শয়তানের দল মিলে তাদের ইচ্ছেমতো ভ্রান্ত পথে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। আল্লাহর স্মরণ থেকে তার অন্তরকে ভুলিয়ে রাখে। এ ধরনের মানুষ কখনো আল্লাহর রাস্তায় ফিরে আসতে চাইলেও শয়তানের দল তাকে বাধা দেয়। শয়তানরা এই ভ্রান্ত পথগুলোকে এই ব্যক্তির চোখের সামনে এতটা চাকচিক্যময় করে তুলে ধরে যে তার চিন্তা করার ও সত্যমিথ্যার পার্থক্য করার ক্ষমতা লোপ পেয়ে যায়। তারা ভাবতে থাকে তারা নিজেদের জন্য যে পথ বেছে নিয়েছে এটাই সত্য ও হেদায়েতর পথ। এরা বরং উল্টো সত্য পথের অনুসারীদেরকে পথভ্রষ্ট মনে করতে থাকে। এ কারণে এ ধরনের মানুষের পক্ষে সংশোধন হওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তার পক্ষে নামাজ আদায় ও কুরআন তেলাওয়াতের মতো নেক আমল করা সম্ভব হয় না। সে প্রকৃতপক্ষে তার জীবনের নিয়ন্ত্রণ শয়তানের হাতে ছেড়ে দিয়েছে।
২- মানুষের অন্তর কখনো শূন্য থাকে না। সেখানে হয় দয়ালু আল্লাহ অথবা শয়তান থাকে। আমরা যদি মনে করি আমাদের অন্তরে আল্লাহর স্থান নেই তাহলে নিশ্চিতভাবে ধরে নিতে হবে শয়তান সে শূন্যস্থান পূরণ করে নিয়েছে। শয়তান ও আল্লাহ একসঙ্গে ওই শূন্যস্থানে থাকতে পারে না। যদি কেউ ভাবে সে কিছু ক্ষেত্রে শয়তান ও কিছু ক্ষেত্রে আল্লাহর সঙ্গে আছে তাহলে প্রকৃতপক্ষ সে পুরোপুরি শয়তানের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে।
৩- পাপকাজ করার চেয়ে বিপজ্জনক বিষয় হচ্ছে, নিজের অপকর্মকে দেখতে না পাওয়া এবং একথা মনে করে সে সঠিক কাজটিই করছে।
সূরা জুখরুফের ৩৮ ও ৩৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
حَتَّى إِذَا جَاءَنَا قَالَ یَا لَیْتَ بَیْنِی وَبَیْنَکَ بُعْدَ الْمَشْرِقَیْنِ فَبِئْسَ الْقَرِینُ ﴿٣٨﴾ وَلَنْ یَنْفَعَکُمُ الْیَوْمَ إِذْ ظَلَمْتُمْ أَنَّکُمْ فِی الْعَذَابِ مُشْتَرِکُونَ ﴿٣٩﴾
“অবশেষে (কিয়ামতের দিন) যখন সে আমার নিকট আসবে, তখন সে [তার সহচর শয়তানকে] বলবে: হায়! আমার ও তোমার মধ্যে যদি পূর্ব ও পশ্চিমের ব্যবধান থাকত! তুমি কতই না নিকৃষ্ট সহচর ছিলে!” (৪৩: ৩৮)
“আর আজ [শয়তান থেকে দূরে থাকার জন্য তোমাদের এ আকাঙ্ক্ষা] তোমাদের কোন কাজেই আসবে না, যেহেতু তোমরা যুলুম করেছিলে; [কাজেই এখন] শাস্তিতে তোমরা সকলে [একে অপরের] সহচর।”(৪৩: ৩৯)
পার্থিব জীবনে আল্লাহকে ভুলে যাওয়া মানুষের পরিণতির প্রতি ইঙ্গিত করে এই দুই আয়াতে বলা হচ্ছে: আল্লাহর প্রতি উদাসীন থেকে যাদের পার্থিব জীবন শেষ হয় তারা শেষ পর্যন্ত আখিরাতে আল্লাহর সামনে উপস্থিত হয়। সেখানে তারা উপলব্ধি করে শয়তান তাদের কত বড় ক্ষতি করে ফেলেছে। তখন তারা এই বলে অনুতাপ করতে থাকে যে, হায় যদি দুনিয়াতে শয়তানকে সঙ্গী হিসেবে বেছে না নিতাম। তারা তখন শয়তানকে বলবে: পৃথিবীর পূর্ব প্রান্ত থেকে পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত যতটা দূরত্ব তোমার সঙ্গে যদি আমাদের এতটা দূরত্ব থাকত তাহলে কতই না ভলো হতো! তারা শয়তানকে বলবে: তুমি আমাদের জন্য কত ভয়াবহ বিপদ ডেকে এনেছ। তুমি ভ্রান্ত পথগুলোকে আমাদের সামনে সরল পথ হিসেবে প্রদর্শন করেছো।
কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই কিয়ামত দিবসের এই অনুশোচনা মানুষের কোনো কাজে আসবে না। তারা পার্থিব জীবনে যেভাবে শয়তানকে ঘনিষ্ঠ সহচরে পরিণত করেছিল কিয়ামতের দিনও তাদেরকে শয়তানের সঙ্গে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করা হবে। কিয়ামত হচ্ছে পার্থিব জীবনের প্রতিচ্ছবি এবং আখেরাতে মানুষের ঠিকানা নির্ধারিত হবে পার্থিব জীবনের সহচরদের ভিত্তিতে।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে:
১- পৃথিবীতে বন্ধু নির্বাচন করার সময় ভেবেচিন্তে করতে নির্বাচন হবে। আর তা করতে পারলে কিয়ামতের দিন অনুশোচনায় পড়তে হবে না।
২- জাহান্নাম নির্ধারিত রয়েছে মানুষ ও শয়তান উভয়ের জন্য এবং জাহান্নামবাসীকে শয়তানের সঙ্গে একসঙ্গে থাকতে হবে।
৩- জুলুম শুধু অপরের ওপরই করা যায় না। আল্লাহর স্মরণ থেকে বিচ্যুত থাকা হচ্ছে নিজের প্রতি সবচেয়ে বড় জুলুম।
সূরা জুখরুফের ৪০ থেকে ৪২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
أَفَأَنْتَ تُسْمِعُ الصُّمَّ أَوْ تَهْدِی الْعُمْیَ وَمَنْ کَانَ فِی ضَلالٍ مُبِینٍ ﴿٤٠﴾ فَإِمَّا نَذْهَبَنَّ بِکَ فَإِنَّا مِنْهُمْ مُنْتَقِمُونَ ﴿٤١﴾ أَوْ نُرِیَنَّکَ الَّذِی وَعَدْنَاهُمْ فَإِنَّا عَلَیْهِمْ مُقْتَدِرُونَ ﴿٤٢﴾
“[হে রাসূল] আপনি কি শোনাতে পারবেন বধিরদেরকে অথবা হেদায়াত দিতে পারবেন অন্ধদেরকে ও তাদেরকে, যারা স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে আছে?” (৪৩:৪০)
“অতঃপর আমি যদি আপনাকে [দুনিয়া থেকে] নিয়ে যাই, তবে নিশ্চয় তাদের থেকে প্রতিশোধ নেব।”(৪৩:৪১)
“অথবা [আপনার জীবদ্দশায়] আমি তাদেরকে [শাস্তির যে] প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, তা আপনাকে দেখাব, নিঃসন্দেহে আমি তাদের উপর পূর্ণ ক্ষমতাবান।”(৪৩:৪২)
এই তিন আয়াতে রাসূলে আকরাম (সা.)কে উদ্দেশ করে বলা হচ্ছে: যারা দ্বীনের কথা শুনতে ও সত্যকে দেখতে রাজি নয় তাদের শরীরের চোখ ও কান সুস্থ থাকলেও তাদের অন্তরের চোখ ও কান সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। এ কারণে আপনার বক্তব্য তাদের কানে পৌঁছে না এবং তারা সত্যকে দেখতে পায় না। ফলে আপনি তাদেরকে সৎপথে ফিরিয়ে আনতে পারেন না।
যে ব্যক্তি ঘুমিয়ে আছে আর যে ব্যক্তি ঘুমের ভান করছে তাদের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। যে ঘুমের ভান করছে তাকে যতই ডাকাডাকি করা হোক সে সাড়া দেয় না। কিন্তু সত্যিকার ঘুমন্ত ব্যক্তিকে কয়েকবার ডাক দিলেই সে জেগে ওঠে।
কিছু মানুষ এত বেশি গোনাহের মধ্যে ডুবে আছে যে, আল্লাহ বা তাঁর রাসূলে নাম শুনলেই তাদের বিরক্তি লাগে। দ্বীনি আলোচনা বা ওয়াজ নসিহত শুনলে তারা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। এ ধরনের মানুষ হেদায়াত লাভ করার সব পথ নিজেরাই নিজেদের জন্য বন্ধ করে দিয়েছে। এমনকি সেই হেদায়েতকারী যদি স্বয়ং আল্লাহর রাসূল (সা.)ও হন এবং তিনি যদি সর্বোত্তম পন্থায়ও এ ধরনের মানুষদেরকে হেদায়েত করার চেষ্টা করেন তাহলেও এসব মানুষ হেদায়েতপ্রাপ্ত হবে না।
সত্যের সঙ্গে এমন শত্রুতা, গোঁয়ার্তুমি ও বিদ্বেষের কারণে এসব মানুষ দুনিয়া ও আখিরাতে আল্লাহর ক্রোধের শিকার হয়। রাসূলের জীবদ্দশায় কিংবা তাঁর ওফাতের পরে সব সময়ের জন্য এই বক্তব্য প্রযোজ্য। কিন্তু এসব মানুষ সত্য গ্রহণ করুক বা না করুক আল্লাহর হাতে থেকে তারা বাঁচতে পারবে না। কারণ, মহান আল্লাহ সর্বময় ক্ষমতাবান এবং বিশ্বজগতের সবকিছু তার পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- সত্য গ্রহণের ক্ষেত্র প্রস্তুত না থাকলে শ্রেষ্ঠতম মানুষের পক্ষেও কাউকে হেদায়েত করা সম্ভব নয়।
২- শয়তান মানুষের অন্তরকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করলে তার অন্তর সত্য দেখা ও শোনা থেকে বঞ্চিত হয়।
৩- মুশরিকরা যেন একথা না ভাবে যে, যতদিন তাদের মাঝে রাসূলুল্লাহ (সা.) উপস্থিত আছেন ততদিন আল্লাহর আজাব আসবে না; অথবা রাসূলের তিরোধানের পর আল্লাহর শাস্তি বন্ধ হয়ে যাবে।#
পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ১৫
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।