রংধনু আসর: ঐতিহাসিক মোবাহিলা দিবস
রংধনু আসরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছো তোমরা? আশা করি যে যেখানেই আছে ভালো ও সুস্থ আছো? আজকে র আসরে তোমাদেরকে স্বাগত জানাচ্ছি আমি গাজী আবদুর রশীদ এবং আমি আকতার জাহান।
বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই স্কুলে, মাদ্রাসায় বক্তৃতা কিংবা বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নাও অথবা বন্ধুদের অংশ নিতে দেখো-তাই না? বিতর্কের মাধ্যমে জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি প্রকৃত সত্যকে আবিষ্কার করা যায়। আর তাই ইসলামে বিতর্ক বা বাহাসের ওপর ব্যাপক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
আল্লাহপাক পবিত্র কুরআনের সূরা নাহলের ১২৫ নম্বর আয়াতে রাসূল (সা.)কে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, (ইকো) “হে নবী! আল্লাহর পথে মানুষদেরকে ডাকুন হিকমত ও ভালো উপদেশের সাহায্যে। আর লোকদের সাথে বিতর্ক করুন উত্তম পন্থায়।”
আল্লাহর এ নির্দেশের আলোকে রাসূল (সা.) মানুষকে ভালো উপদেশের মাধ্যমে ইসলামের দিকে ডাকতেন। কিন্তু এমন অনেকেই ছিলেন যারা কেবল উপদেশে বিশ্বাসী ছিল না। গোড়ামী, একগুঁয়েমি ও ভুল চিন্তাধারার অধিকারী এসব ব্যক্তির সাথে রাসূলেখোদা মুনাযিরাহ বা বিতর্কে লিপ্ত হতেন।
মুনাযিরাহ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের সূরা নিসার ৭১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন, (ইকো) “তোমরা যারা ঈমান এনেছো, শত্রুদের মুকাবিলায় তোমাদের প্রস্তুতিকে ধরে রাখো।”
এই আয়াতে বলা হয়েছে, মুসলমানরা অবশ্যই সকল পন্থায় শত্রুদের মুকাবিলায় প্রস্তুত থাকো। ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বিরোধীদের সাথে মুনাযিরাহ্ করার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলেছেন: “বিরোধীদের সাথে আলোচনা কর এবং হিদায়েতের পথকে তা তাদের সামনে উপস্থাপন কর। সেই সাথে তাদের গোমরাহীর পথকেও তাদের সামনে তুলে ধরো।”
বন্ধুরা, মুনাযিরাহ বা বিতর্কের গুরুত্ব সম্পর্কে জানলে। এবার নিশ্চয়ই জানতে চাচ্ছো, রাসূল (সা.) কাদের সাথে বিতর্ক করেছেন? তোমাদের জিজ্ঞাসার জবাবে বলছি, আল্লাহর রাসূল- ইহুদী, খ্রিস্টান, মুর্তিপুজক, নাস্তিকসহ পাঁচ শ্রেণীর ইসলাম বিরোধী শক্তির সঙ্গে মুনাযিরাহ বা বিতর্ক করেছেন। প্রত্যেকটি বিতর্কে তারা রাসূলের অকাট্য যুক্তি, অগাধ জ্ঞান ও প্রমাণের কাছে হেরে যায়। একবার নাজরানের এক খ্রিস্টান প্রতিনিধি দল বিতর্কে হেরে গিয়ে রাসূলকে মোবাহিলা করার প্রস্তাব দেয়।
বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই জানতে চাচ্ছো, মোবাহিলা আবার কি? মোবাহিলা হচ্ছে 'পরস্পরের প্রতি অভিশাপ দেয়ার অনুষ্ঠান'। রাসূলের যুগে পরস্পর বিরোধী দু’টি পক্ষ একটি স্থানে একত্রিত হয়ে একে অপরের প্রতি ততক্ষণ পর্যন্ত অভিশাপ দিত যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ তাদের এক পক্ষকে ধ্বংস না করতেন।
বন্ধুরা, ২৪ জিলহজ হচ্ছে ঐতিহাসিক মোবাহিলার দিন। ১০ হিজরীর এই দিনে নাজরানের খ্রিস্টান প্রতিনিধিদের সাথে রাসূলেখোদার মোবাহিলা সংঘটিত হয়েছিল আজকের আসরে এই ঐতিহাসিক দিনটি সম্পর্কেই একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি। অনুষ্ঠানের শেষ দিকে থাকবে বাংলাদেশের এক নতুন বন্ধুর সাক্ষাৎকার। আমাদের আজকের অনুষ্ঠানটিও তৈরি করেছেন আশরাফুর রহমান।
বন্ধুরা, মোবাহিলার ঘটনা নিয়ে আলোচনার আগে তোমাদের জন্য রয়েছে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে একটি নাতে রাসূল। এটির গীতিকার ও সুরকার আহমাদ আবদুল্লাহ। আর গেয়েছে আবদুল্লাহ আল কাফি, তোকি ইব্রাহিম, আবুবক ও আল আমিন
সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিবেদিত গানটি শুনলে। বন্ধুরা, এবার আমরা ঐতিহাসিক মোবাহিলা দিবস নিয়ে আলোচনা করব।
বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই জানো যে, বর্তমান সৌদি আরবের পূর্বনাম ছিল হিজাজ। এই হিজাজ এবং ইয়েমেনের সীমান্তে অবস্থিত একটি পার্বত্য অঞ্চলের নাম নাজরান। ইসলামের প্রাথমিক যুগে হেজাজের মধ্যে নাজরানই ছিল একমাত্র খ্রিস্টান অধ্যুষিত এলাকা। যে অঞ্চলের লোকজন বিভিন্ন কারণে মূর্তি পূজা ছেড়ে দিয়ে হযরত ঈসা মাসীহ (আ.) এর ধর্মকে গ্রহণ করেছিলেন। নাজরানের ৭৩টি ছোট শহরে প্রায় ৪০ হাজার খ্রিস্টান বাস করতো।
দশম হিজরীতে মহানবী (সা.) ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য ইয়েমেনের নাজরান এলাকায় একদল মুসলমানকে পাঠিয়েছিলেন। ওই দাওয়াত পাওয়ার পর নাজরানের খ্রিস্টান পোপ এ ব্যাপারে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সেখানকার জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের নিয়ে মিটিংয়ে বসেন। মিটিংয়ের পর তিনি রাসূল (সা.)এর সাথে আলোচনার জন্য মদীনায় একটি প্রতিনিধি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন।
১৪ সদস্যের ওই খ্রিস্টান প্রতিনিধি দলের প্রধান ছিলেন পোপ আবু হারিসা নিজে। তারা মদীনায় গিয়ে রাসুল (সা.)'র সাথে হযরত ঈসা (আ.)'র ব্যাপারে তর্ক-বিতর্ক করতে থাকে। কিন্তু তারা যুক্তি ও সত্য মেনে নিতে অস্বীকার করে। নাজরানের প্রতিনিধিরা দেখল, তারা যতই জিজ্ঞাসা করছে রাসূল (সা.) ততই সুন্দরভাবে যুক্তি ও দলিল দিয়ে কথা বলছেন তখন তারা নিশ্চিত পরাজয় জেনে মুনাযিরাহ বা বিতর্ক বন্ধ করে দিল।
মুনাযিরাহ বন্ধ করে তারা বলল : এসব যুক্তি-তর্ক আমাদেরকে সন্তুষ্ট করতে পারবে না। আমরা মোবাহিলা করতে চাই। এ সময় রাসূল (সা.) ওপর সূরা আলে ইমরানের ৬১ নম্বর আয়াত নাজিল হলো। মহান আল্লাহ বলেন, (ইকো) "যখন ঈসা সম্পর্কিত জ্ঞানগর্ভ আলোচনার পরেও তারা আপনার সাথে ঝগড়া করছে তখন আপনি বলুন, এসো! আমি আমার মহিলাদেরকে নিয়ে আসব, তোমরাও তোমাদের মহিলাদেরকে নিয়ে আসবে, আমি আমার সন্তানদেরকে নিয়ে আসব তোমরাও তোমাদের সন্তানদেরকে নিয়ে আসবে, আমি আমার নফসকে নিয়ে আসব তোমরাও তোমাদের নফসকে নিয়ে আসবে, তারপর মোবাহিলা করব এবং আল্লাহর লানতকে মিথ্যাবাদীদের ওপর বর্ষণ করব।"
পবিত্র কুরআনের এ আয়াত নাজিল হবার পর রাসূল (সা.) খ্রিস্টানদের বললেন, “তোমরা তোমাদের পুত্র, নারী ও ঘনিষ্ঠ কয়েকজনকে নিয়ে এসো। আর আমরাও একই কাজ করে জনসমাবেশে এসে মিথ্যাবাদীদের ওপর আল্লাহর অভিশাপ বর্ষণের জন্য প্রার্থনা করব।”
রাসূলেখোদার এ আহ্বানের পর খ্রিস্টানদের পোপ তার দলের অন্যান্য সদস্যদের বলল, "মোবাহিলার প্রস্তাব মেনে নাও। কিন্তু যদি দেখ, মুহাম্মদ তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের নিয়ে মোবাহিলার জন্য উপস্থিত হয়, তাহলে তোমরা তা করা থেকে বিরত থাকবে এবং কোনোভাবে আপোস করবে।"
এ সিদ্ধান্তের পর মুসলিম-খ্রিস্টান উভয় সম্প্রদায়ের লোকজন অধীর আগ্রহে মোবাহিলার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। অবশেষে যিলহজ্জ মাসের ২৪ তারিখে মহানবী (সা.) তার পরিবারের মাত্র চার জন সদস্যকে নিয়ে নির্ধারিত স্থানে উপস্থিত হলেন। এই চারজন হলেন- রাসূল কন্যা ফাতেমা (সা.), জামাতা হয়রত আলী (আ.) এবং তাঁদের দুই পুত্র হাসান ও হোসাইন (আ.)। মহানবী (সা.) তাদের বললেন, 'যখনই আমি দোয়া করব তোমরা 'আমীন' বলবে।'
রাসূলের সঙ্গে এই চারজনকে দেখে খ্রিস্টানরা ভয় পেয়ে গেল। তাদের আর বুঝতে বাকি থাকল না যে, মুহাম্মাদ (সা.) সত্যের পথে আছেন। তিনি যদি সঠিক পথে না থাকতেন তাহলে কখনই নিজের সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তিত্বদেরকে নিয়ে মোবাহিলার জন্য উপস্থিত হয়ে ঐশি আযাবের মুখোমুখি হতেন না।
পোপ বলল, "আমি এমন কিছু চেহারাকে দেখতে পাচ্ছি যে, যদি তাঁরা দোয়া করেন, তাহলে পাহাড় টলে যাবে এবং যদি আমাদের ওপর অভিশাপ দেন, তাহলে আমরা একজনও জীবিত থাকব না। সুতরাং তোমরা এক্ষুণি মোবাহিলা বন্ধ কর।"
পোপের পীড়াপীড়ি নাজরানের প্রতিনিধিদের ওপর প্রভাব বিস্তার করল। এক ধরনের অস্থিরতা তাদেরকে ঘিরে ধরল। দ্রুত তারা একজনকে প্রতিনিধিকে পাঠাল রাসূল (সা.)-এর কাছে। ওই প্রতিনিধি রাসূলের সাথে দেখা করে মোবাহিলা বন্ধ করার জন্য বিনীত অনুরোধ জানাল এবং শান্তি চুক্তির প্রস্তাব দিল।
খ্রিস্টানদের প্রস্তাব পেয়ে মহানবী (সা.) তাদের ওপর দয়া করলেন এবং হযরত আলীকে নির্দেশ দিলেন চুক্তির শর্ত লিখতে। মহানবীর নির্দেশ অনুযায়ী হযরত আলী চুক্তির শর্ত লিখলেন। শর্ত অনুযায়ী কর হিসেবে প্রতি বছর ৮০ হাজার দিরহাম দিতে রাজি হলো খ্রিস্টানরা। আর যদি কোনো যুদ্ধ হয় তাহলে ৩০টি যেরা, ৩০টি বর্ষা এবং ৩০টি ঘোড়া ধার হিসেবে মুসলমানদেরকে দেয়ার সিদ্ধান্ত হলো। চুক্তির শর্ত মেনে নিয়ে নাজরানের উদ্দেশ্যে মদীনা থেকে চলে গেল। আর এভাবেই খ্রিস্টানদের ওপর মুসলমানদের বিজয় অর্জিত হলো।
এ ঘটনার পর মহানবী (সা.) বলেন, “আল্লাহর কসম! এরা যদি মোবাহিলা করত তাহলে আল্লাহ তাদের বানর বা শুকরে রূপান্তরিত করতেন এবং ময়দান আগুনে পরিণত হতো। আর নাজরানের একটি প্রাণীও এমনকি পাখি পর্যন্ত রক্ষা পেত না।”
এভাবে খ্রিস্টানদের সঙ্গে সংলাপে বিশ্বনবী (সা.)’র বিজয় এবং তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের উচ্চতর মর্যাদা প্রকাশিত হওয়ার জন্য ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে এই ঘটনা।
বন্ধুরা, দেখলে তো খ্রিস্টানদের ওপর মুসলমানদের কিভাবে জয় হলো! আসলে যেখানে রাসূলে খোদাসহ তাঁর পরিবারের সদস্যরা আছেন সেখানে সত্যের জয় হবে-এটাই স্বাভাবিক। কুরআন-হাদিসে যেভাবে বিতর্ক করার কথা বলা হয়েছে তোমরাও যদি সেভাবে বিতর্ক কর তাহলে তোমরাও বিজয়ী হবে।
বন্ধুরা, অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে তোমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি ঢাকার এক নতুন বন্ধুকে। ওর নাম মোঃ হাবিবুল হক মিঞা নিবরাস।

পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/৬
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।