নির্বাচন
‘বর্তমান কাঠামোয় অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়’
বাংলাদেশের রাজনীতি, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের দাবি, জাতীয় সরকার গঠন এসব বিষয়ে রেডিও তেহরানের সাথে কথা বলেছেন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি বা সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। তিনি বলেন, আমাদের দেশ থেকে এখন রাজনীতি প্রায় নির্বাসিত করে রেখেছে ক্ষমতাসীনরা।
তিনি আরও বলেছেন, যদি ফেরেশতাদের দিয়েও নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয় তারপরও বাংলাদেশে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। কেননা গোটা নির্বাচন ব্যবস্থাটা এমনভাবে স্থাপন করা হয়েছে যে সেখানে কোনোভাবেই জনমতের প্রতিফলন নিশ্চিত করা তো দূরের কথা নির্বাচনের প্রতিচ্ছবিও যে দেখা যাবে তারও কোনো সুযোগ নেই।
বিদগ্ধ এই রাজনীতিবিদ বলেন,বর্তমান কাঠামোর মধ্যে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। ফেরেশতাদের দিয়ে নির্বাচন করালেও অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে না। আমাদের পুরো নির্বাচন ব্যবস্থাকে পুরো ঢেলে সাজাতে হবে।
সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ,তৈরি ও উপস্থাপনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।
রেডিও তেহরান: মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, করোনা মহামারি চলছে বিশ্বজুড়ে। বাংলাদেশও তার বাইরে নয়। একরকম থেমে গেছে সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকা। আর রাজনীতির কথা অনেক আগেই থেমে গেছে বলে রাজনৈতিক দলগুলো এবং সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে বলা হয়ে থাকে, আপনারা বলছেন। তো বর্তমানে দেশের রাজনীতি নিয়ে আপনি কী বলবেন?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: আপনি রাজনীতি সম্বন্ধে যেকথা বললেন সে প্রসঙ্গে আমি ছোট করে বলে নিতে চাই যে,আমাদের দেশ থেকে এখন রাজনীতি প্রায় নির্বাসিত করে রেখেছে ক্ষমতাসীনরা। তাছাড়া বিরাজনীতিকরণের নানারকম প্রচেষ্টা আমরা এর আগেও দেখেছি এনজিও ও আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মাধ্যমে এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপরিচালনার বদলে রাষ্ট্র শক্তিকে ব্যবহার করে এবং ব্যুরোক্রেসি নির্ভর হয়ে রাষ্ট্রপরিচালনা করতে। আমি বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বড় ক্যাসুয়ালটি হচ্ছে রাজনীতি এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়া।
রেডিও তেহরান: মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম আপনি রাজনীতি এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার কথা বলছিলেন। তো সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সম্প্রতি বিএনপি নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের কথা বলা হচ্ছে। বিএনপি বলেছে, এরপর আবার গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরীও একই দাবি জানিয়েছেন। এই দাবির যৌক্তিকতা কি?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: দেখুন, এটা সবাই জানে যে, নির্বাচন কমিশনের একটা মেয়াদ থাকে। সেই মেয়াদের পর আবার নতুন করে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হয়। এ বিষয়ে বেশিরভাগ আলোচনা ঘুরপাক খাচ্ছে- নির্বাচন কমিশন কাদের নিয়ে হবে, কি পদ্ধতিতে হবে ইত্যাদি।
এ বিষয়ে আমি বলব যদি ফেরেশতাদের দিয়েও নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয় তারপরও বাংলাদেশে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। কেননা গোটা নির্বাচন ব্যবস্থাটা এমনভাবে স্থাপন করা হয়েছে যে সেখানে কোনোভাবেই জনমতের প্রতিফলন নিশ্চিত করা তো দূরের কথা নির্বাচনের প্রতিচ্ছবিও যে দেখা যাবে তারও কোনো সুযোগ নেই। আমরা একসময় বিএনপি সরকারের সময় দেখেছি ভোটার তালিকা ও নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে কাণ্ড কারখানা করা হয়েছিল। ইদানিং কালে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। দেশের পার্লামেন্টে নির্বাচনে ১৫৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছে। অনেক এমন বলেন যে কি করব অন্য কোনো প্রতিদ্বন্দ্বি ছিল না!ভোট ছাড়াই তারা নির্বাচিত হয়েছেন। একটুখানি ভেবে দেখতে হবে জনগণের একটি ভোটও না পেয়েও ক্ষমতায় অধিষ্টিত সরকার গঠনের ব্যবস্থা আপনারা করে নিলেন। সুতরাং বিনা ভোটে, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় একটা সরকার গঠন করে নেয়ার মতো একটা তামাশা গত নির্বাচনের আগের বার করা হয়েছে। গত নির্বাচনেও কৌশল বদলানো হয়েছে। ৩০ তারিখের নির্বাচন তার আগের রাতেই হয়ে গেছে!
রেডিও তেহরান: আচ্ছা বাংলাদেশে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য কেমন নির্বাচন কমিশন দরকার বলে আপনি মনে করেন?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: আমাদের দেশে, অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে হলে- একথা ঠিক যে এমন একটা নির্বাচন কমিশন দরকার যেটি হবে আইনানুগ, বিধি বিধান মেনে এবং দল নিরপেক্ষ। যারা অবাধ নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে। তবে বর্তমান কাঠামোর মধ্যে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। আমাদের পুরো নির্বাচন ব্যবস্থাকে পুরো ঢেলে সাজাতে হবে। সংখ্যানুপাতে প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা-যেমন প্রতিটি দল তাদের কর্মসূচি নিয়ে মানুষের কাছে যাবে। মানুষ তাদেরকে ভোট দেবে। যে দল যত বেশি জনসমর্থন পাবে সেই অনুপাতে তারা সংসদ আসন পাবে। নামগুলো অবশ্য আগে থেকে দলগুলোর পক্ষ থেকে ঘোষণা দিয়ে রাখবে। এ পদ্ধতি ইউরোপ, ল্যাটিন আমেরিকা এমনকি ভারত বাদ দিয়ে এশিয়ার অনেক দেশে আংশিকভাবে রয়েছে। এরকম হলে টাকার খেলাসহ অনেক অনিয়ম কমবে। তবে বর্তমান যে ব্যবস্থা তাতে নির্বাচন তামাশায় পরিণত হয়েছে।
রেডিও তেহরান: নির্বাচন তামাশায় পরিণত হয়েছে এমন কথা বলছিলেন কিন্তু- কেন কিভাবে?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: দেখুন, আমি যেকথা বলছিলাম যে বর্তমানে নির্বাচন তামাশায় পরিণত হয়েছে এর কারণ নির্বাচনে টাকার খেলা চলছে। সেখানে রয়েছে পেশী শক্তির দাপট এবং সাম্প্রদায়িকতাকে ভিত্তি করে কে বেশি ইসলামি সেটি প্রমাণ করার চেষ্টা রয়েছে। এসবের ওপর ভিত্তি করে নির্বাচনের ফলাফল আসে। আজকাল টাকা বিলি করার বিষয়টি আগের মতো পাবলিকের মধ্যে করা হয় না; তার দরকারও নেই। একেবারে চাবিকাঠি যারা এরকম কয়েক ডজন মানুষকে পর্যাপ্ত উপঢৌকন দিলেই হবে। আপনি এ কাজটি করে ঘরে বসে থকান দেখবেন নির্বাচনে আপনাকে বিজয়ী করার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। ফলে আমাদের নির্বাচনে টাকার খেলা এবং পেশী শক্তির ব্যবহার বন্ধ করা অপরিহার্য। বিষয়টি নিয়ে সুনির্দিষ্ট সুপারিশমালা আমরা দিয়েছি বহুবছর আগে। প্রতিটি সরকার এবং প্রতিটি নির্বাচন কমিশনের কাছে আমাদের এ বিষয়ে দাবি দাওয়া পেশ করেছি এবং নানা কর্মসূচির মাধ্যমে এটিকে জনপ্রিয় করে তুলেছি। তারপরও কোনো কিছুতে কিছু হয়নি!
রেডিও তেহরান: এর মূল কারণ কি জনাব সেলিম?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: এর মূল কারণ সম্পর্কে আমি বলব-অনেকে আমাকে জিজ্ঞেস করে বাংলাদেশে সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা কী? আমি হেসে তার জবাবে বলি বাংলাদেশে সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা হচ্ছে এমপিগিরির ব্যবসা। দুর্ভ্যাগ্যজনক যে ত্রিশ লক্ষ মানুষের রক্তের বিনিময়ে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি আজ সেখানে এই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এরচেয়ে লজ্জার আর কি থাকতে পারে!
রেডিও তেহরান: গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে তো এরশাদবিরোধী আন্দোলন সংগ্রাম আপনারা করেছেন..তার ফল কি হলো?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: জ্বি আমরা এরশাদবিরোধী সংগ্রামে আমরা শামিল ছিলাম। তখন তিন জোটের রূপরেখার খসড়া করার সময় আমার নিজের হাতে যে খসড়াটি ছিল তাতে বলেছিলাম নির্বাচনে বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরিয়ে আনার জন্য অন্তত তিনটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা উচিত। আর বলেছিলাম আওয়ামী লীগ বিএনপি আপনারা অন্তত বছর দুয়েক ঝগড়া বিবাদ বন্ধ রাখেন আল্লাহর ওয়াস্তে এবং দেশ ও জাতিকে পুনর্গঠন করেন তারপর আমরা বহুদলভিত্তিক গণতন্ত্র শুর করব। এরশাদের পরাজয়ের পর সেটি হয়নি। এমনকি এরশাদকে কে পক্ষে নিতে পারবে তা নিয়ে শুরু হয় প্রতিযোগিতা। আর সেটাই আমাদের অধঃপতনের একটা বড় কারণ। আমাদের ইতিহাস ঠিক এরকম- আমরা বীরের জাতি এবং আমরা বিজয় লাভ করি কিন্তু আমরা দুর্ভাগা জাতি কারণ বিজয় লাভ করেও আমরা সেই বিজয় ধরে রাখতে পারিনা। এরশাদের পতনের পর আমরা ভেবেছিলাম যে আমরা গণতন্ত্র কায়েম করতে পারব কিন্তু আমরা তা করতে পারিনি। আমরা খুবই করুণ অবস্থার ভেতরে আছি। আমাদের অবস্থা সর্বাঙ্গে ব্যথা ওষুধ দেব কোথা!ফলে শুধুমাত্র কিভাবে নির্বাচন কমিশন নির্ধারণ হবে মাত্র এই একটা ইস্যুর মধ্যে দিয়ে নির্বাচন নয়; সামগ্রিকভাবে একটি সমাজ বিপ্লবের কথা ভাবা প্রয়োজন। আর সেক্ষেত্রে নির্বাচনের প্রসঙ্গ যদি আসে তাহলে শুধুমাত্র নির্বাচন কমিশনার না গোটা নির্বাচন ব্যবস্থাকেই ঢেলে সাজাতে হবে।
জনাব মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, আপনি বললেন সুষ্ঠু অবাধ নিরপেক্ষে নির্বাচনের জন্য গোটা নির্বাচন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। তো বাংলাদেশের রাজনীতি এবং নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে রেডিও তেহরানকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে আবারও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।#
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: আপনাকেও ধন্যবাদ।
পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/২৪