সূরা আহকাফ : আয়াত ২৯-৩৫ (পর্ব-৭)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা আহকাফের ৭ম ও শেষ পর্ব নিয়ে আলোচনা। আজ আমরা এই সূরার ২৯ থেকে ৩৫ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির সম্পর্কে জানব। এই সূরার ২৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
وَإِذْ صَرَفْنَا إِلَيْكَ نَفَرًا مِنَ الْجِنِّ يَسْتَمِعُونَ الْقُرْآنَ فَلَمَّا حَضَرُوهُ قَالُوا أَنْصِتُوا فَلَمَّا قُضِيَ وَلَّوْا إِلَى قَوْمِهِمْ مُنْذِرِينَ ﴿۲۹﴾
“আর স্মরণ করুন, যখন আমি আপনার দিকে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম জিনদের একটি দলকে, যারা মনোযোগ সহকারে কুরআন পাঠ শুনছিল। অতঃপর যখন তারা তার কাছে উপস্থিত হল, বলল, চুপ করো [এবং শোন]। অতঃপর যখন [কুরআন শোনা] সমাপ্ত হল তখন তারা তাদের সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে গেল সতর্ককারীরূপে।” (৪৬:২৯)
আগের আয়াতগুলোতে মক্কার কাফেরদের পক্ষ থেকে ঈমানের দাওয়াত প্রত্যাখ্যান সম্পর্কে আলোচনা করার পর এই আয়াতে বলা হচ্ছে: তোমরা ঈমান না আনলেও জ্বিনদের একটি দল কুরআনের আয়াত শুনে নবীর প্রতি ঈমান এনেছে এবং অন্যদেরকেও ইসলামের প্রতি দাওয়াত দিয়েছে। জ্বিন আল্লাহর এমন এক সৃষ্টি যার সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। এই মহাগ্রন্থে জ্বিন নামের একটি স্বতন্ত্র সূরা রয়েছে যেখানে আল্লাহ তায়ালা, কুরআন ও কিয়ামতের ব্যাপারে জ্বিনদের বিশ্বাস সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে, মানুষের মতো জ্বিনদের মধ্যেও ঈমানদার ও কাফের রয়েছে।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- মানুষের মতো জ্বিনদেরও ভালোমন্দ উপলব্ধি করার ক্ষমতা রয়েছে এবং তাদেরকেও আল্লাহর ইবাদত করতে হয়।
২- শুধুমাত্র ঈমান আনাই যথেষ্ট নয় অপরকে দ্বীনের দাওয়াত দেয়াও একজন মুমিন মুসলমানদের ধর্মীয় কর্তব্য।
সূরা আহকাফের ৩০ থেকে ৩২ নং আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
قَالُوا يَا قَوْمَنَا إِنَّا سَمِعْنَا كِتَابًا أُنْزِلَ مِنْ بَعْدِ مُوسَى مُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيْهِ يَهْدِي إِلَى الْحَقِّ وَإِلَى طَرِيقٍ مُسْتَقِيمٍ ﴿۳۰﴾
يَا قَوْمَنَا أَجِيبُوا دَاعِيَ اللَّهِ وَآمِنُوا بِهِ يَغْفِرْ لَكُمْ مِنْ ذُنُوبِكُمْ وَيُجِرْكُمْ مِنْ عَذَابٍ أَلِيمٍ ﴿۳۱﴾
وَمَنْ لَا يُجِبْ دَاعِيَ اللَّهِ فَلَيْسَ بِمُعْجِزٍ فِي الْأَرْضِ وَلَيْسَ لَهُ مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءُ أُولَئِكَ فِي ضَلَالٍ مُبِينٍ ﴿۳۲﴾
“তারা বলল, ‘হে আমাদের জাতি! আমরা তো এক কিতাবের [বাণী] শুনেছি, যা মূসার পরে নাযিল হয়েছে যা পূর্ববর্তী কিতাবসমূহকে সত্যায়ন করে আর মানুষকে সত্য ও সরল পথে হেদায়েত করে’।” (৪৬:৩০)
“হে আমাদের জাতি! আল্লাহর দিকে আহ্বানকারীর আহ্বানে সাড়া দাও এবং তার প্রতি ঈমান আন, তাহলে আল্লাহ তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করবেন আর তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক আযাব থেকে রক্ষা করবেন’।” (৪৬:৩১)
“আর যে আল্লাহর দিকে আহবানকারীর প্রতি সাড়া দেবে না, দুনিয়াতে সে [আল্লাহকে] অক্ষম করে দিতে পারবে না, আর আল্লাহ ছাড়া তার আর কোনো সাহায্যকারী থাকবে না। এ ধরনের ব্যক্তিরা সুস্পষ্ট গুমরাহীতে লিপ্ত।”(৪৬:৩২)
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর তেলাওয়াতকৃত আয়াত শুনে ঈমান গ্রহণকারী জ্বিনেরা তাদের জাতির কাছে ফিরে গিয়ে দাওয়াতের বাণী শোনায়। তারা বলে, যে আল্লাহ হযরত মূসাকে কিতাবসহ প্রেরণ করেছিলেন তিনিই আরেক নবীকে কুরআন নামক কিতাব দিয়ে পাঠিয়েছেন। আজ আমরা সেই কিতাবের আয়াত শুনেছি যেখানে হযরত মূসার কিতাবের মতো মানুষকে সত্যের পথে আহ্বান জানানো হচ্ছে। যে কেউ এই নবীর প্রতি ঈমান আনবে তার পাপ ক্ষমা করে দেয়া হবে এবং সে ভয়াবহ শাস্তি থেকে রক্ষা পাবে। কিন্তু যে ঈমান আনবে না সে যেন জেনে রাখে আল্লাহর মোকাবিলায় দাঁড়ানোর শক্তি তার নেই এবং সে আল্লাহর ক্রোধ থেকে রক্ষা পাবে না। কারণ আল্লাহ ছাড়া আর কেউ ওই কঠিন শাস্তি থেকে কাউকে রক্ষা করতে পারবে না।
এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- অতীতে প্রেরিত নবীদের ইতিহাস ও তাদের আসমানি কিতাবের বিষয়বস্তু সম্পর্কে জ্বিন জাতি অবহিত। তাদের একদল মুমিন আরেক দল কাফের।
৩- সিরাতুল মুস্তাকিম হচ্ছে একমাত্র সত্য পথ। এই পথ মানুষকে বাড়াবাড়ি, ছাড়াছাড়ি ও সব ধরনের বিচ্যুতি থেকে রক্ষা করে এবং ভারসাম্যপূর্ণ ঈমানের পথ বাতলে দেয়।
৪- নবী-রাসূলগণ মানুষকে নিজেদের প্রতি নয় বরং আল্লাহর প্রতি আহ্বান করেছেন। সেইসঙ্গে তাঁরা আল্লাহর নির্দেশকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন; মনগড়া কোনো কথা বলেননি।
৫- আল্লাহর প্রতি অবিশ্বাস মানুষকে চরম অচলাবস্থার মুখোমুখি করে। সেই অচলাবস্থা থেকে সে নিজে যেমন মুক্ত হতে পারে না তেমনি অন্য কাউকেও সে সাহায্যকারী পায় না।
সূরা আহকাফের ৩৩ থেকে ৩৪ নং আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
أَوَلَمْ يَرَوْا أَنَّ اللَّهَ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَلَمْ يَعْيَ بِخَلْقِهِنَّ بِقَادِرٍ عَلَى أَنْ يُحْيِيَ الْمَوْتَى بَلَى إِنَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ ﴿۳۳﴾
وَيَوْمَ يُعْرَضُ الَّذِينَ كَفَرُوا عَلَى النَّارِ أَلَيْسَ هَذَا بِالْحَقِّ قَالُوا بَلَى وَرَبِّنَا قَالَ فَذُوقُوا الْعَذَابَ بِمَا كُنْتُمْ تَكْفُرُونَ ﴿۳۴﴾
“আর তারা কি দেখে না, যে আল্লাহ্ আসমানসমূহ ও যমীন সৃষ্টি করেছেন এবং এসবের সৃষ্টিতে কোন ক্লান্তি বোধ করেননি, তিনি মৃতদের জীবিত করতে সক্ষম? হ্যাঁ, নিশ্চয় তিনি সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান। ”(৪৬:৩৩)
“আর যেদিন কাফেরদেরকে পেশ করা হবে জাহান্নামের আগুনে [সেদিন তাদেরকে বলা হবে] এটা কি সত্য নয়? তারা বলবে, আমাদের রবের শপথ! অবশ্যই সত্য। [সুতরাং] তিনি বলবেন, তোমরা কুফরী করেছিলে বলে [আজ] শাস্তি আস্বাদন কর।”(৪৬:৩৪)
সূরা আহকাফের শেষের দিকের এই আয়াতে আবারো কিয়ামত প্রসঙ্গের অবতারণা করা হয়েছে। মুশরিকদের উদ্দেশ করে বলা হচ্ছে: যে আল্লাহ তায়ালা আকাশমণ্ডলী ও ভূপৃষ্ঠ সৃষ্টি করেছেন এবং এগুলো সৃষ্টি করতে গিয়ে ক্লান্ত হননি তিনি কিয়ামতের দিন মৃতদেরকে আবার জীবিত করতে পারবেন। কাজেই তোমরা যে পরকালে বিশ্বাস করো না তার জন্য আল্লাহ দায়ী নন। বরং তোমরা তোমাদের জৈবিক চাহিদা পূরণ এবং যা খুশি তাই করবে বলে পরকালে বিশ্বাস করতে চাও না। কিন্তু এই তোমরাই কিয়ামতের দিন জাহান্নামের ভয়ঙ্কর আগুন দেখার পর তাতে বিশ্বাস করবে এবং তার স্বীকারোক্তি দেবে। কিন্তু সেদিনের স্বীকারোক্তি তোমাদেরকে কঠিন আজাব থেকে রক্ষা করতে পারবে না।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- মহান আল্লাহ অপরিসীম ক্ষমতার অধিকারী। এই বিশ্বজগতের অস্তিত্বের দিকে তাকালে যে কারো একথা উপলব্ধি করতে কষ্ট হওয়ার কথা নয় যে, এই জগতের মালিক কিয়ামতের বিচার দিবস সৃষ্টি করে মানুষকে আবার জীবিত করতে সক্ষম হবেন।
২- কিয়ামতের দিন কাফেররা আল্লাহ ও পরকালে ঈমান আনবে। কিন্তু সে ঈমান তাদেরকে জাহান্নামের কঠিন আজাব থেকে বাঁচাতে পারবে না।
সূরা আহকাফের ৩৫ নং আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
فَاصْبِرْ كَمَا صَبَرَ أُولُو الْعَزْمِ مِنَ الرُّسُلِ وَلَا تَسْتَعْجِلْ لَهُمْ كَأَنَّهُمْ يَوْمَ يَرَوْنَ مَا يُوعَدُونَ لَمْ يَلْبَثُوا إِلَّا سَاعَةً مِنْ نَهَارٍ بَلَاغٌ فَهَلْ يُهْلَكُ إِلَّا الْقَوْمُ الْفَاسِقُونَ ﴿۳۵﴾
“অতএব [হে রাসূল] আপনি ধৈর্য ধারণ করুন যেমন ধৈর্য ধারণ করেছিলেন দৃঢ় প্ৰতিজ্ঞ রাসূলগণ। আর আপনি তাদের [আজাবের] জন্য তাড়াহুড়ো করবেন না। তাদেরকে যে বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে তা যেদিন তারা দেখতে পাবে, সেদিন তাদের মনে হবে, তারা যেন দিনের এক দণ্ডের বেশী [দুনিয়াতে] অবস্থান করেনি। [এটি সবার জন্য] একটি ঘোষণা, সুতরাং পাপাচারী সম্প্রদায় ছাড়া আর কাউকে কি ধ্বংস করা হবে?” (৪৬:৩৫)
এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বিশ্বনবী (সা.)কে উদ্দেশ করে বলছেন, কাফের ও মুশরিকদের অত্যাচার ও গোঁয়ার্তুমির বিপরীতে আপনি ধৈর্যধারণ করুন এবং তাদের ওপর আজাব নাজিল হওয়ার ব্যাপারে তাড়াহুড়ো করবেন না। কারণ, আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন তাদের এসব কুৎসিত কর্মের শাস্তি দেবেন। আপনি দ্বীন প্রচারের দায়িত্ব পালন করে যান কিন্তু এর ফলাফল আপনার হাতে নেই। তারা ঈমান আনুক বা না আনুক সেজন্য তাদেরকে জবাবদিহী করতে হবে আপনাকে নয়।
পার্থিব জীবনের সময় যে অতি সংক্ষিপ্ত এই আয়াতে সেদিকেও ইঙ্গিত করা হয়েছে। কিয়ামত দিবসের তুলনায় পৃথিবীর জীবন এতবেশি ছোট যে সেদিন সবার মনে হবে তারা দিনের একটি মুহূর্ত পৃথিবীতে অবস্থান করেছিল। তখন কাফের ও মুশরিকরা এত সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য কেন সঠিক পথটি বেছে নেয়নি সেজন্য অনুতাপ করতে থাকবে।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- আল্লাহর বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া নবী-রাসূলদের দায়িত্ব। মানুষকে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা বা গ্রহণ না করলে তাদেরকে শাস্তি দেয়া নবী-রাসূলগণের কাজ নয়।
২- শত্রুদের উৎপীড়ন সহ্য করা সব নবী-রাসূলের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। কাজেই তাদের উম্মতদেরও উচিত বিপদে আপদে ধৈর্যধারণ করা।
৩- আল্লাহ তায়ালা কাফের ও গোনাহগার ব্যক্তিদেরকে পৃথিবীর জীবনে তাঁর দিকে ফিরে আসার জন্য সময় দেন। কিন্তু সে সময়কে যারা খারাপ কাজ করার সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে তাদেরকে কিয়ামতের দিন অনুতপ্ত হতে হয়।#
পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ২৮
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।