আসমাউল হুসনা (পর্ব-৪৮)
দয়াময় আল্লাহর আসমাউল হুসনার অন্তর্ভুক্ত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নাম হ'ল মাজিদ। এই নামের অর্থ হল অত্যন্ত উচ্চ, মহান, অভিজাত, সভ্রান্ত, দয়াশীল ও গৌরবময় ইত্যাদি।
মহান আল্লাহ অত্যন্ত দানশীল ও কল্যাণ দাতা বলে এই নামের অধিকারী। পবিত্র কুরআনে এই নাম চার বার এসেছে। মহান আল্লাহর নাম হিসেবে দুই বার ও পবিত্র কুরআনের গুণ হিসেবে এসেছে দুই বার।
মাজিদ বলা হয় এমন কাউকে যার সব কাজ সম্মানজনক এবং যিনি এতই দয়ালু যে চাওয়ার আগেই কাউকে দান করেন বা দান গ্রহণের দরকার না থাকা সত্ত্বেও কাউকে দান করেন। অন্য কথায় তাঁর চেয়ে বড় দানশীল ও করুণাময় আর কেউ নেই।
মাজিদ আরও অর্থও ধারণ করে। মহান আল্লাহ মাজিদ এই অর্থেও যে তিনি এমনই শক্তির অধিকারী যে কোনো কিছুই তাকে অসহায় করে না। বরং তিনি এমনই ক্ষমতার অধিকারী যে তিনিই ভাগ্য ও পরিণতি নির্ধারণ করেন। আবার দয়ার ক্ষেত্রে তিনি এমনই দয়াশীল যে তাঁর দয়া বা রহমত সব কিছুকে বেষ্টন করে। তিনি এমনই হাকিম বা কৌশলী যে প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতায় তিনি পরিপূর্ণ ক্ষমতার অধিকারী এবং তাঁর গৌরব ও মর্যাদা অসীম। আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ) মহান আল্লাহর প্রশংসা করতে গিয়ে বলেছেন:
প্রতিষ্ঠিত প্রশংসা আল্লাহর যিনি সকল বান্দার সাদৃশ্যের উর্দ্ধে,বর্ণনাকারীদের বর্ণনার উর্দ্ধে;যিনি দৃষ্টিবানকে তাঁর ব্যবস্থাপনা দেখিয়ে দিয়ে হতবাক করেছেন;যিনি স্বীয় মহিমায় চিন্তাবিদগণের কল্পনা থেকে গুপ্ত;যিনি জ্ঞানার্জন ছাড়াই জ্ঞানী যাতে কোন বাড়তিও নেই,কমতিও নেই;এবং যিনি কোন প্রকার চিন্তা ও প্রতিফলন ছাড়াই সকল বিষয়ের নিয়ামক। তিনি এমন যে,গাঢ় অন্ধকারে তাঁর কিছু আসে যায় না,অথবা উজ্জ্বলতার কাছ থেকেও তার কোন আলোর প্রয়োজন হয়না। রাত তাঁকে অতিক্রম করে না,দিবাভাগও তাঁর জন্য পার হয়ে যায় না (অর্থাৎ দিবারাত্রির পরিবর্তন তাঁকে প্রভাবিত করে না)। কোন জিনিস সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধি চক্ষু দ্বারা নয় এবং তাঁর জ্ঞান অবহিতির ওপর নির্ভরশীল নয় ।
মাজিদ হচ্ছেন এমন কেউ যার সত্ত্বাই সভ্রান্ত এবং যার সব নাম ও গুণ চূড়ান্তভাবে পরিপূর্ণ সেসবের কোনো একটিতেও বিন্দুমাত্র ত্রুটি ও ঘাটতি নেই। সব সৃষ্টিই তাঁর মহত্ত্ব ও উচ্চতার কাছে নতজানু। সুরা রাদের ১৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
আল্লাহকে সেজদা করে যা কিছু নভোমন্ডলে ও ভূমণ্ডলে আছে ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় এবং তাদের প্রতিচ্ছায়াও সকাল-সন্ধ্যায়।
সুরা বুরুজের ১৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ নিজেকে মাজদ্-এর অধিকারী তথা মাজিদ হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন: তিনি জুল আরশুল মাজিদ তথা সম্মানিত আরশ্-এর অর্থাৎ অস্তিত্ব জগতের ওপর পরিপূর্ণ বা চূড়ান্ত কর্তৃত্বের অধিকারী এবং সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী।
মহান আল্লাহর মর্যাদা ও উচ্চতা সব কিছুকে অধিকার করে নিয়েছে ও সব সৃষ্টি তাঁরই নিয়ন্ত্রণাধীন ও কর্তৃত্বাধীন। মহান আল্লাহর মহত্ত্ব ও শক্তির কাছে সব কিছুই নতজানু। তিনি মুসা- আ. ও তাঁর জাতির জন্য দরিয়াকে ভাগ করে দেন এবং পাথরের মধ্য থেকে ঝর্ণাধারা বইয়ে দেন ও তাদের জন্য মান্না ও সালওয়া নামক খাদ্য তথা কোয়েল পাখি ও কাউ জাতীয় ফল পাঠান । মহান আল্লাহই জাকারিয়া নবীর বৃদ্ধা ও বন্ধ্যা স্ত্রীকে সুস্থতা দান করে তাঁকে ইয়াহিয়া নামের পবিত্র সন্তান দান করেন। তিনিই ইব্রাহিম নবীকে বৃদ্ধ অবস্থায় যখন তাঁর স্ত্রী সারাও বৃদ্ধা ছিলেন সে সময় পবিত্র পুত্র সন্তান দান করেন। আর ওই সুসংবাদ শুনে সারা বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। আর ফেরেশতারা তার বিস্ময় প্রকাশ দেখে বলেছিলেন: আল্লাহর কাছে বিস্ময় প্রকাশ করছেন। আল্লাহ চাইলেই সব কিছু করতে পারেন। সুরা হুদের ৭২ ও ৭৩ নম্বর আয়াতে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে:
সে বলল-কি দুর্ভাগ্য আমার! আমি সন্তান প্রসব করব? অথচ আমি বার্ধক্যের শেষ প্রান্তে এসে উপনীত হয়েছি আর আমার স্বামীও বৃদ্ধ, এতো ভারী বিস্ময়ের কথা! তারা বলল-তুমি আল্লাহর হুকুম সম্পর্কে বিস্ময়বোধ করছ? হে গৃহবাসীরা, তোমাদের উপর আল্লাহর রহমত ও প্রভুত বরকত রয়েছে। নিশ্চয় আল্লাহ প্রশংসিত মহিমাময় বা মাজিদ।
পবিত্র কুরআন মানুষকে অজ্ঞতা থেকে মুক্তির পথে ও জ্ঞানের পথে নিয়ে যাওয়াসহ অজস্র কল্যাণের আকর হওয়ায় পবিত্র কুরআনকেও মাজিদ বলা হয়েছে। পবিত্র কুরআন এমন এক আসমানি কিতাব যাতে বিন্দুমাত্র বিকৃতি নেই এবং সব যুগের জন্য এর বাণীই হচ্ছে বিচারের চূড়ান্ত রায়। তাই মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনকে উল্লেখ করতে গিয়ে সব সময় এর উচ্চ মর্যাদার দিকসহ উল্লেখ করেছেন। যেমন, সুরা ক্বাফ-এর প্রথম বাক্যে মহান আল্লাহ বলেছেন: ক্বাফ, কুরআন মাজিদ-এর শপথ!-এখানে বিচ্ছিন্ন অক্ষর ক্বাফ বলতেও কুরআনের অতি উচ্চ মর্যাদার ইঙ্গিত করা হয়েছে। আসলে মহান আল্লাহর বাণীর সংকলন কুরআনের মর্যাদাও অশেষ। তাই সব সময়ই এই মহাগ্রন্থের নাম উল্লেখের সময় শুধু কুরআন না বলে কুরআন মাজিদ বলা উচিত।
পবিত্র কুরআনের আলংকারিক ও বাগ্মিতার সৌন্দর্য এত উচ্চ মানের যে এমন মহাগ্রন্থের একটি বাক্যের সমতুল্য বাক্যও বিশ্বের সব বাক্য-বিশারদ ও সাহিত্যিকরা একযোগে চেষ্টা করেও রচনা করতে পারবেন না। পবিত্র কুরআনে যেসব মূল্যবান বিধি-বিধান, উচ্চতর বাস্তবতা ও অদৃশ্যের জ্ঞান ও ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে তা আর কোথাও পাওয়া যাবে না। কুরআন তাঁর অনুসারীদের উচ্চ মর্যাদা ও সৌভাগ্যের গ্যারান্টিও দেয়। মহান আল্লাহ নিজে যেমন অন্য সব কিছুর তুলনায় শ্রেষ্ঠ তেমনি মহান আল্লাহর রচিত কুরআনের কথাও সব কথার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। মহানবী বলেছেন: আমি তোমাদের জন্য দুটি বড় আমানত রেখে যাচ্ছি: এর একটি হল কুরআন ও অন্যটি হল আমার আহলে বাইত। আর এ দুই-ই হাউজে কাউসারে বা কাউসার নামক সরোবরে মিলিত না হওয়া পর্যন্ত পরস্পর থেকে কখনও বিচ্ছিন্ন হবে না।
মহান আল্লাহর মাজিদ নামের প্রতিফলন জীবনে ঘটাতে হলে নিজের ভেতর ও বাহিরকে সব কদর্যতা থেকে মুক্ত করতে হবে এবং সব ধরনের পাপ থেকে দূরে থাকতে হবে। সব ফরজ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নফল বা মুস্তাহাব কাজগুলোও যারা করবেন তারা আল্লাহর বিশেষ নৈকট্য লাভ করবেন এবং তাদের হৃদয়ে জন্ম নেবে প্রজ্ঞার ঝর্ণাধারা। এমন মানুষ তখন অন্যদেরকেও সুপথের দাওয়াত দিবেন ও মানুষের মধ্যে তারাও সম্মান বা মাজ্দ্ অর্জন করবেন। কোনো একজন মানুষকেও আল্লাহমুখি করতে পারা এতই বড় কাজ যে মহান আল্লাহ এই বড় কাজের অধিকারীর নাম লওহের মধ্যে প্রশংসাসহ যুক্ত করেন।#
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ০৯
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।