জুন ২৯, ২০২২ ২৩:৩৯ Asia/Dhaka

জিলক্বদ মাসের শেষ দিন ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে কম বয়স্ক মজলুম ইমাম হযরত জাওয়াদ (আ)'র শাহাদত বার্ষিকী। ২২০ হিজরির এই দিনে তিনি শাহাদাত বরণ করেছিলেন। ইমাম মুহাম্মাদ বিন আলী আল জাওয়াদ-এ'র জন্ম হয়েছিল মদীনায় ১৯৫ হিজরিতে তথা ৮১১ খ্রিস্টাব্দের ১২ এপ্রিল।

তার মায়ের নাম ছিল সাবিকাহ বা খিইজরান। তিনি ছিলেন মহানবীর স্ত্রী উম্মুল মু’মিনিন হযরত মারিয়া কিবতির (আ) বংশধর।  পিতা  ইমাম রেজা (আ.)'র শাহাদতের পর মাত্র ৮ বছর বয়সে ইমামতের দায়িত্ব পান ইমাম জাওয়াদ।  ১৭ বছর এই পদে দায়িত্ব পালনের পর মাত্র ২৫ বছর বয়সে শাহাদত বরণ করেন। মজলুম ও দরিদ্রদের প্রতি ব্যাপক দানশীলতা ও দয়ার জন্য তিনি 'জাওয়াদ' উপাধি পেয়েছিলেন। তাকি বা খোদাভীরু ছিল তাঁর আরেকটি উপাধি।

ইমাম রেজা (আ.)-এর বোন হাকিমাহ বলেন : ইমাম রেজা (আ.) আমাকে ইমাম মুহাম্মদ তাকী (আ.)-এর জন্মের সময় খিযরানের কাছে তথা তাঁর স্ত্রীর কাছে থাকার নির্দেশ দেন। নবজাতক জন্মের তৃতীয় দিবসে আকাশের দিকে ও অতঃপর ডানে-বায়ে দেখলেন এবং স্পষ্ট করে কলেমায়ে শাহাদাতাইন বললেন, যার অর্থ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে,আল্লাহ্ ছাড়া কোন মাবুদ নেই এবং হযরত মুহাম্মদ (সা.) হচ্ছেন আল্লাহর রাসূল।’  আমি এই বিস্ময়কর ঘটনা দেখেই সঙ্গে সঙ্গে ভাইয়ের কাছে এ ঘটনা বর্ণনা করলাম। ইমাম রেজা (আ.) বললেন,‘যা দেখেছ তার চেয়ে আরও বেশি বিস্ময়কর ঘটনা ভবিষ্যতে তার থেকে দেখতে পাবে’ (মানাকেব,৪র্থ খণ্ড,পৃ. ৩৯৪)।

মহানবীর (সা) আহলে বাইতের অন্য ইমামগণের মত ইমাম জাওয়াদ (আ.)ও ছিলেন উচ্চতর নৈতিক গুণ, জ্ঞান ও পরিপূর্ণতার অধিকারী এবং ইসলামের মূল শিক্ষা ও সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন ও  বিকাশ ছিল তাঁরও মূল লক্ষ্য। সেযুগের সব মাজহাবের জ্ঞানী-গুণীরা ইমাম জাওয়াদ (আ.)'র উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। 

সমসাময়িক যুগের প্রখ্যাত সুন্নি চিন্তাবিদ কামালউদ্দিন শাফেয়ি ইমাম জাওয়াদ (আ) সম্পর্কে বলেছেন, "মুহাম্মাদ বিন আলী তথা ইমাম জাওয়াদ (আ.) ছিলেন অত্যন্ত উঁচু মর্যাদা ও গুণের অধিকারী। মানুষের মুখে মুখে ফিরত তাঁর প্রশংসা। তাঁর উদারতা, প্রশস্ত দৃষ্টি ও সুমিষ্ট কথা সবাইকে আকৃষ্ট করত। যে-ই তাঁর কাছে আসতো নিজের অজান্তেই এই মহামানবের অনুরাগী হয়ে পড়ত এবং তাঁর কাছ থেকে জ্ঞান অর্জন করত।"

মালিকি মাজহাবের বিশিষ্ট ফকীহ ইবনে সাব্বাগ ইমাম জাওয়াদ (আ) এর জীবন-বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে লিখেছেন: কী বলবো! সবার চেয়ে কম বয়স অথচ তাঁর মান-মর্যাদা ছিলো সবার উপরে। ... তাঁর জ্ঞান, তাঁর প্রজ্ঞা, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি সংক্রান্ত বহু মূল্যবান অবদান এখনো অবশিষ্ট রয়েছে। স্বল্পভাষী হয়েও তিনি শত্রুর বক্তব্যকে অকাট্য যুক্তি দিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় ও সুমিষ্ট ভাষায় খণ্ডন করে নিজ বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। সে সময়কার সব তর্কবাগীশ , আলঙ্কারিক ও ভাষাবিদকে তিনি হার মানিয়েছেন। 

রাজা-বাদশাহদের জুলুম-অত্যাচারের বিরুদ্ধে  আহলে বাইতের ইমামদের সংগ্রামের মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রকৃত ইসলাম ও এর শিক্ষাকে রক্ষা করা। আব্বাসীয় শাসক মামুন ও মুতাসিম ছিল ইমাম জাওয়াদ (আ.)'র যুগের দুই বাদশাহ। ইমাম পবিত্র মদিনা ছাড়াও হজের  সময় মক্কায় গমন উপলক্ষে সেখানে ইসলামের ব্যাখ্যা তুলে ধরতেন এবং বক্তব্যের পাশাপাশি নিজ আচার-আচরণের মাধ্যমে দিক-নির্দেশনা দিতেন রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ে। শাসকদের জুলুমের বিরুদ্ধেও থাকতেন সোচ্চার। এইসব শাসক বিশ্বনবী (সা.)'র আদর্শ ও সুন্নাতকে ত্যাগ করেছিল। ইমাম জাওয়াদ (আ.) শাসকগোষ্ঠী ও তাদের দোসরদের প্রতিপালিত চিন্তাগত হামলা মোকাবেলা করে আহলে বাইত (আ.)'র আদর্শকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছিলেন। 

ইমাম জাওয়াদ (আ) মাত্র আট বছর বয়সে ইমামতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ফলে অনেকেই এ বিষয়ে সন্দেহ করতেন। অথচ আল্লাহ মানুষকে তার বয়সের স্বল্পতা সত্ত্বেও পরিপূর্ণ বিবেক-বুদ্ধির পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেন। কুরআনের আয়াতের এরকম কিছু দৃষ্টান্ত আছে। যেমন শিশুকালে হযরত ইয়াহিয়া (আ) এর নবুয়্যত প্রাপ্তি, মায়ের কোলে নবজাতক ঈসা (আ) এর কথা বলা ইত্যাদি আল্লাহর সর্বশক্তিমান ক্ষমতারই নিদর্শন।

ইমাম জাওয়াদ (আ) শৈশব-কৈশোরেই ছিলেন জ্ঞানে-গুণে, ধৈর্য ও সহনশীলতায়, ইবাদাত-বন্দেগিতে, সচেতনতায়, কথাবার্তায় শীর্ষস্থানীয় মহামানব। একবার হজ্জ্বের সময় বাগদাদ এবং অন্যান্য শহরের বিখ্যাত ফকীহদের মধ্য থেকে আশি জন মদীনায় ইমাম জাওয়াদ (আ) এর কাছে গিয়েছিলেন। তাঁরা ইমামকে বহু বিষয়ে জিজ্ঞেস করে অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত ও সন্তোষজনক জবাব পেলেন। ফলে জাওয়াদ (আ) এর ইমামতিত্বের ব্যাপারে তাদের মনে যেসব সন্দেহ ছিল-তা দূর হয়ে যায়। 

ইমাম জাওয়াদ (আ) বড়ো বড়ো পণ্ডিতদের সাথে জ্ঞানগত বিতর্কে অংশ নিয়ে তাদের হারিয়ে দিতেন। একদিন আব্বাসীয় বাদশাহ মামুন ইমাম জাওয়াদ (আ) এর জ্ঞানের গভীরতা পরীক্ষা করার জন্যে একটি মজলিসের আয়োজন করে। জ্ঞানী-গুণীজনদের ঐ মজলিসে নামকরা পণ্ডিত ইমামকে প্রশ্ন করেন: যে ব্যক্তি হজ পালনের জন্যে এহরাম বেঁধেছে, সে যদি কোনো প্রাণী শিকার করে, তাহলে এর কী কাফফারা হবে? ইমাম জাওয়াদ (আ) এই প্রশ্নটির উত্তর সংশ্লিষ্ট ২২টি অবস্থায় কি হবে তা সুদীর্ঘ বর্ণনার মাধ্যমে জানিয়ে দেন। উত্তর পেয়ে সবাই হতবাক হয়ে যান এবং ইমামের অলৌকিক জ্ঞানের প্রশংসা করেন।

ইমাম জাওয়াদ (আ) এর ১১০ জন ছাত্রের নাম উল্লেখ করা হয়েছে যাঁরা তাঁরই জীবনাদর্শ ও শিক্ষার আলোকে সুশিক্ষিত হয়েছেন, সমৃদ্ধ হয়েছেন। তাঁদের মধ্য থেকে বহু মহান মনীষীর নাম ইতিহাসের পাতায় জ্বলজ্বল করে যাঁরা তাঁদের সমকালে ছিলেন শ্রেষ্ঠ জ্ঞানীদের অন্তর্ভুক্ত, ফিকাহ ও জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তাঁরা ব্যাপক অবদান রেখে গেছেন।  

ইমাম জাওয়াদ (আ) জ্ঞানের গুরুত্ব প্রসঙ্গে বলেছেনঃ‌ ইহকালীন এবং পরকালীন সব বৈধ চাহিদা মেটাতে জ্ঞানের বাতিকে কাজে লাগাও।
ইমাম জাওয়াদ (আ.) মানুষের কুপ্রবৃত্তিকে দমন করার ওপর গুরুত্ব দিতেন। তিনি দুনিয়াকে পুণ্য অর্জনের জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করলেও কখনোই দুনিয়ামুখী ছিলেন না। ইতিহাসে এসেছে তিনি তাঁর অর্জিত সম্পদ বহুবার মানুষের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছেন। 

ইমাম জাওয়াদ তাকি (আ.)'র জীবনের শেষ দু'বছরে আব্বাসীয় শাসক ছিলো মুতাসিম। মুতাসিম জনগণের মাঝে ইমামের জনপ্রিয়তায় আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে ইমামের বক্তব্যে জনগণের মাঝে এক ধরনের জাগরণ সৃষ্টি হয়। যার ফলে মুতাসিমের ভেতর ঈর্ষার আগুণ জ্বলতে থাকে। তাই সে ইমামের বিরুদ্ধে শুরু করে নানা ষড়যন্ত্র। মুতাসিমের ষড়যন্ত্রের ফলেই মাত্র ২৫ বছর বয়সে ইমাম জাওয়াদ (আ.) শাহাদাত বরণ করেন। 

আব্বাসীয় শাসক মামুন ও মুতাসিম ছিল ইমাম জাওয়াদ (আ.)'র যুগের দুই বাদশাহ। ইমাম পবিত্র মদিনা ছাড়াও হজের সময় মক্কায় গমন উপলক্ষে সেখানে ইসলামের ব্যাখ্যা তুলে ধরতেন এবং বক্তব্যের পাশাপাশি নিজ আচার-আচরণের মাধ্যমে দিক-নির্দেশনা দিতেন রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ে। শাসকদের জুলুমের বিরুদ্ধেও থাকতেন সোচ্চার। এইসব শাসক বিশ্বনবী (সা.)'র আদর্শ ও সুন্নাতকে ত্যাগ করেছিল। ইমাম জাওয়াদ (আ.) শাসকগোষ্ঠী ও তাদের প্রতিপালিত দোসরদের চিন্তাগত হামলা মোকাবেলা করে আহলে বাইতের আদর্শকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছিলেন। 

ইসলামী সভ্যতার পুনরুজ্জীবনে এমন মহান ইমামের আদর্শ অনুসরণ খুবই জরুরি। 

ইমাম জাওয়াদ বলেছেন, যে কর্মের সময় এখনো আসেনি সেজন্য তাড়াহুড়া করো না,করলে অনুতপ্ত হবে। আকাশচুম্বি আশা-আকাঙ্ক্ষা করোনা,কেননা তাতে আত্মা পাষণ্ড ও কঠিন হয়। দুর্বল-অক্ষমদের প্রতি দয়া কর এবং তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের মাধ্যমে আল্লাহর অনুগ্রহ প্রার্থনা কর (আল ফুসুলুল মোহেম্মাহ,পৃ. ২৯২)। তিনি আরও বলেছেন, "বাজে লোকের বন্ধুত্ব থেকে দূরে থাকো, কারণ, তার বন্ধুত্ব হলো তলোয়ারের মতো, যার বাহ্যিক দিকটা বেশ চকচকে আর কাজটি খুবই জঘন্য।"  তাঁর শাহাদাত-বার্ষিকীতে আবারো সবার প্রতি রইলো আন্তরিক সমবেদনা। #

পার্সটুডে/মু.আ.হুসাইন/মো.আবুসাঈদ/১০

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। 

ট্যাগ