পবিত্র 'হজের তাৎপর্য ও উদ্দেশ্য' (২য় পর্ব)
(last modified Tue, 21 Aug 2018 14:36:23 GMT )
আগস্ট ২১, ২০১৮ ২০:৩৬ Asia/Dhaka

পবিত্র 'হজের তাৎপর্য ও উদ্দেশ্য' সম্পর্কিত বিশেষ আলোচনা 'চল রে কাবার জিয়ারতে, চল নবীজীর (সা) দেশ' শীর্ষক আলোচনার দ্বিতীয় তথা শেষ পর্বে আপানাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।পবিত্র হজ অফুরন্ত কল্যাণ ও শক্তির উৎস। মহান আল্লাহর পথে জীবন, সম্পদ ও আমিত্বকে বিসর্জন দেয়ার এবং সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও ইসলামী ঐক্যের চেতনাকে শানিত করার বার্ষিক মহড়া অনুষ্ঠিত হয় এই পবিত্র হজে।

রাজনৈতিক ও সামাজিক কল্যাণের দিক থেকে হজ ইসলামের শীর্ষস্থানীয় এবাদত। পবিত্র কোরআনে সূরা হজের ২৭ ও ২৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, মানুষকে হজের দিকে আহ্বান কর যাতে তারা নিজের বিভিন্ন কল্যাণগুলো দেখতে পারে। হজ সব ধরনের খোদাদ্রোহী শক্তিকে অস্বীকার করার পাশাপাশি ইসলামী ভ্রাতৃত্ব,ঐক্য ও সংহতির আলোকোজ্জ্বল প্রকাশ ঘটায়। হজের মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ইসলামের পবিত্রতম স্থানে এবং সেখানে একই পোশাকে একই শ্লোগান দিয়ে সমবেত হয় সারা বিশ্বের সব জাতি ও বর্ণের মুসলিম নর-নারী।

ইসলামী ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেছেন,

'হজ রহস্যে ভরপুর এমন এক ইবাদত ও পবিত্র স্থানে বসবাস এবং এমন এক অবস্থান যা খোদায়ী বরকতে টইটুম্বর ও মহান আল্লাহর নানা নিদর্শন আর প্রতীকের প্রকাশ। হজ আল্লাহর বিশ্বাসী বা মু'মিন দাস, বিনম্র ও চিন্তাশীল-জ্ঞানী ব্যক্তিদের আধ্যাত্মিক মর্যাদা এনে দিতে পারে এবং তাকে করতে পারে আলোকিত হৃদয়ধারী ও উচ্চতর ব্যক্তি। হজ এ ধরনের ব্যক্তিকে অন্তর্দৃষ্টি ও সাহসিকতার মত নানা গুণ দান করতে পারে এবং তাদেরকে দান করতে পারে কাজের উদ্যম ও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সংগ্রাম বা জিহাদ করার গুণ। হজের রাজনৈতিক, আধ্যাত্মিক এবং ব্যক্তিগত ও সামাজিক দিকগুলো নজিরবিহীন,অত্যন্ত উচ্চমানের ও দৃশ্যমান। আজ মুসলিম সমাজের জন্য হজের এই আধ্যাত্মিক ও সামাজিক-রাজনৈতিক উভয় দিকই খুবই জরুরি।'

হজ মুসলমানদের বিশ্ব-সম্মেলন। এ প্রসঙ্গে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আরও বলেছেন, ইসলামের অন্যান্য ইবাদত ও ধর্মীয় কর্তব্যের চেয়ে হজের অগ্রগণ্য দিকটি হল-এর আন্তর্জাতিকতা বা বৈশ্বিক রূপ। যে খোদাভীতি ও খোদার প্রতি বিনম্রতা প্রত্যেক মুসলমানের মধ্যে থাকা উচিত তা  হজে এক আন্তর্জাতিক বা বৈশ্বিক রূপ নেয়। বিভিন্ন জাতি, ভাষা, গোত্র, বর্ণ ও সংস্কৃতির অধিকারী মুসলমানরা মক্কায় সমবেত হন এবং তাদের সবাই খোদার প্রতি বিনম্র ও ভীত-বিহ্বল থাকেন।

হজের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হল, আল্লাহর নির্দেশ ও আইনকে সব কিছুর উপরে প্রাধান্য দেয়া। হযরত ইসমাইল (আঃ) যেমন আল্লাহর নির্দেশে নিজেকে পিতার হাতে কোরবানী করতে রাজী হয়েছিলেন এবং ইসলামকে দূষণ ও বিকৃতির হাত থেকে রক্ষার জন্য হযরত ইমাম হুসাইন (আঃ) যেভাবে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন তেমনি আমাদেরকেও অন্ধ সাম্প্রদায়িকতা ও মাজহাবি সংকীর্ণতা ভুলে গিয়ে ইসলামের বৃহত্তর স্বার্থে ও ঐক্যের স্বার্থে চরম আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। প্রতি বছর হজ আমাদেরকে সে জন্য প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ নেয়ার ডাক দিয়ে যায়।

হজ একটি আদর্শ মুসলিম সমাজের প্রতীক। সব ধরনের বাহ্যিক ভেদাভেদ ভুলে মুসলিম ও অমুসলিম দেশগুলোর মুসলমানরা এখানে সমবেত হন। এ সময় তারা পরস্পরের সুখ ও দুঃখ, শক্তিমত্তা এবং সম্ভাবনার নানা দিগন্ত সম্পর্কে অবহিত হন। একটি নির্দিষ্ট স্থানে ও নির্দিষ্ট সময়ে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় সম্মেলন অনুষ্ঠানের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য এটাই। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা:)র পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য ইমাম জাফর সাদিক (আঃ) এ প্রসঙ্গে বলেছেন, মহান আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর দেয়া প্রতিটি বিধানের মধ্যে রয়েছে ইহকালীন ও পারলৌকিক কল্যাণ। হজের বিধান এ জন্য দেয়া হয়েছে যাতে পূর্ব ও পশ্চিমের জনগণ এখানে সমবেত হন এবং পরস্পরকে চিনতে পারেন। এ ছাড়াও মুসলমানরা যাতে মহানবী (সা)'র নানা নিদর্শন ও বিষয় সম্পর্কে জানতে পারে এবং এসব বিষয় যাতে তারা কখনও ভুলে না যায় তা হজের অন্যতম লক্ষ্য বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।  

হজের সময় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মুসলমানরা পরস্পরের দূঃখ-দূর্দশা ও সমস্যা সম্পর্কে জানার পাশাপাশি একে-অপরের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে পারে এবং কাফির ও মুশরিকদের ষড়যন্ত্রের মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। আর এ জন্যই বারাআত বা কাফির-মুশরিকদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা হজের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। আজ মুসলমানদের মধ্যে যত দূর্দশা ও সংকট মুসলমানদের অনৈক্য তার অন্যতম প্রধান কারণ। অথচ মুসলমানদের এক ধর্ম, এক নবী, এক পবিত্র গ্রন্থ রয়েছে এবং তাদের কিবলা ও ধর্মীয় শ্লোগানগুলোও অভিন্ন।
আজ ফিলিস্তিন, ইয়েমেন, মিয়ানমার, কাশ্মির, আফগানিস্তান, সিরিয়া ও ইরাকের মুসলমানদের দূর্দশার ব্যাপারে কোনো প্রকৃত মুসলমান নীরব থাকতে পারে না। নিষ্পাপ হবার জন্য সচেষ্ট হজযাত্রীরাও এ ব্যাপারে নীরব থাকতে পারেন না। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)'র পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য হযরত ইমাম হুসাইন (আ:) পবিত্র হজের সময় মক্কার মুসলমানসহ হজ উপলক্ষ্যে সমবেত বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলমানদের কাছে বক্তব্য রেখে এজিদের স্বৈরাচারি তাগুতি শক্তির বিপদ সম্পর্কে সচেতন করার চেষ্টা করেছিলেন।

সাম্রাজ্যবাদীদের নিয়ন্ত্রিত সংবাদ মাধ্যমের পক্ষপাতদুষ্ট প্রচারণার কারণে মুসলিম বিশ্বের নানা সমস্যা সম্পর্কে মুসলমানদের মধ্যে স্পষ্ট ধারণা নেই। কিন্তু হজের সুবাদে কোনো একটি মুসলিম দেশের সমস্যাগুলোর প্রকৃত চিত্র সরাসরি সংশ্লিষ্ট দেশের হাজী সাহেবদের কাছ থেকে জানা যায়। আজ সিরিয়া, ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান ও ইয়েমেনে কি ঘটছে তা এই দেশগুলোর হাজী সাহেবদের কাছ থেকে জেনে নিতে পারেন অন্যান্য দেশের মুসলমানরা।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা:) এ প্রসঙ্গে বলেছেন, যারা অন্য মুসলমানের সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা বা প্রচেষ্টা না চালিয়েই রাত অতিক্রম করে তারা মুসলমান নয়।
তাই হজের সমাবেশ মুসলমানদের সংকট ও সমস্যাগুলো দূর করার সবচেয়ে ভালো সুযোগ। মরহুম ইমাম খোমেনী (রঃ) এ প্রসঙ্গে বলে গেছেন,বিশ্বের হাজি সাহেবদের এক জায়গায় সমবেত করুন, ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থসহ এ সংক্রান্ত সমস্যা সম্পর্কে পরস্পর মত বিনিময় করুন এবং এইসব সমস্যা সমাধান ও ইসলামের পবিত্র লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্য  প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন।

পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন, মুসলমানদের সঙ্গে শত্রুতার ক্ষেত্রে ইহুদিরাই সবচেয়ে বেশি কঠোর। অথচ কোনো কোনো মুসলিম নামধারী সরকার ইহুদিবাদী ইসরাইলের সঙ্গে সব ধরনের সহযোগিতার সম্পর্ক রাখছেন তারা ইসরাইলকে নিরাপদে রাখার জন্যই ইরাক ও সিরিয়ায় এবং  ইয়েমেনের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছেন।#

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/মো.আবুসাঈদ/২১

খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন