পবিত্র ঈদুল ফিতরের বিশেষ অনুষ্ঠান: ঈদের খুশি
ঈদ মুবারক, ঈদ মুবারক, ঈদ মুবারক। শ্রোতাবন্ধুরা, আপনাদের সবাইকে পবিত্র ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে শুরু করছি বিশেষ অনুষ্ঠান 'ঈদের খুশি'।
ঈদ মানেই আনন্দ, ঈদ মানেই খুশি। দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনার পর পশ্চিমাকাশে শাওয়ালের নতুন চাঁদ উঠার পর পরই শুরু হয়ে যায় এই অনাবিল আনন্দ।
ঈদুল ফিতর মুসলমানের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব। আবেগ, অনুভূতি আনন্দ, উচ্ছ্বাসের মধ্য দিয়ে প্রতিবছর ঈদ পালিত হয়। পবিত্র ঈদুল ফিতর হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ থেকে রোজাদারদের জন্য পুরস্কার প্রাপ্তির দিন। কারণ রমজান মাসে সিয়াম সাধনার প্রতিদান মহান আল্লাহ এ দিনেই দিয়ে থাকেন। চমৎকার এ পুরস্কার পেয়ে রোজাদারদের মনে খুশির অন্ত কিংবা আনন্দের শেষ থাকে না।
শ্রোতাবন্ধুরা, রোজাদারদের আনন্দকে আরও বাড়িয়ে দিতে আমরা দুই পর্বের বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি। অনুষ্ঠানগুলো তৈরি করেছেন আশরাফুর রহমান। আর পরিবেশন করছি আমি নাসির মাহমুদ এবং আমি আকতার জাহান।
‘এলো ঈদুল-ফিতর এলো ঈদ ঈদ ঈদ
সারা বছর যে ঈদের আশায় ছিল না ক’ নিঁদ
দেখ হযরতের হাসির ছটা ঈদের চাঁদে জাগে
সেই চাঁদেরই রঙ যেন আজ সবার বুকে লাগে
এই দুনিয়াতেই মিটলো ঈদে বেহেশতি উমিদ।’
বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই গানে ঈদের আনন্দ-উচ্ছ্বাস পরিপূর্ণভাবে ফুটে উঠেছে। তবে, কবির লেখা 'ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ'- এই গান ছাড়া বাংলা ভাষাভাষী মুসলমানদের ঈদ যেন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। রমজান মাস শেষে পশ্চিম আকাশে শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখার সাথে সাথে বেতার ও টেলিভিশনে এই গান প্রচারের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বাঙালি মুসলমানদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব ঈদ-উল-ফিতর।
তেপান্তর মিডিয়া পরিবেশিত গানটি শুনলেন। এতে কণ্ঠ দিয়েছেন শিল্পী ওবায়দুল্লাহ তারেক, নাবিহা নূর, আবিদা নূর নাবিলা, মাইমুনা, আব্দুল্লাহ আল জারির, আব্দুল্লাহ আল আদনানী, এনাম খান এবং সুরাইয়া আক্তার সাইফা।
বন্ধুরা, ঈদুল ফিতর একটি অনন্য সাধারণ দ্বীনি উৎসব। এইদিনে ধনী-গরীবে কোনো ভেদাভেদ থাকে না। সবার জন্যই এই দিনটি সমান আনন্দের। এই আনন্দ যেন সবাই উপভোগ করতে পারে সেজন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কিছু বিধান দিয়েছেন। যেমন যারা ধনী তাদের ওপর ফিতরা দেওয়া অত্যাবশ্যকীয় করে দিয়েছেন। ফিতরা এক ধরনের জাকাত। এই জাকাত দেওয়া প্রত্যেক সামর্থবান মুসলমানের ওপর অবশ্য কর্তব্য।
বন্ধুরা, আমির-ফকিরের বিভেদ ভুলিয়ে সবার মনে খুশির জোয়ার বইয়ে দিতে আমাদের মাঝে আসে ঈদ। তবে, এ খুশির পেছনে আরও বেশকিছু কারণ আছে। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন, শাওয়াল মাস শুরু হলে এর প্রথমেই মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন আহ্বায়ক ডাক দিয়ে বলেন: হে মুমিনরা, এ দিন ভোর বেলায় পুরস্কার নেয়ার জন্য ছুটে যাও। অর্থাৎ রমজানের খোদায়ি পুরস্কার দেয়া হচ্ছে বলে তা গ্রহণ করতে ছুটে যাও। মহানবী (সা) আরও বলেছেন, যখন ঈদুল ফিতরের সন্ধ্যা- যার নাম পুরস্কারের সন্ধ্যা-তা সমাগত হয় তখন মহান আল্লাহ ইবাদাতকারী বা আমলকারীদেরকে কোনো হিসাব বা সংখ্যার তোয়াক্কা না করেই ব্যাপক পুরস্কার দিয়ে থাকেন।
ঈদুল ফিতরের দিন ভোরবেলায় মহান আল্লাহ ফেরেশতাদেরকে শহরগুলোতে পাঠান। তারা পৃথিবীতে নেমে আসে এবং জনপদগুলোর অলি-গলির মুখে ও চলাচলের পথে দাঁড়িয়ে বলেন: 'হে মুহাম্মাদের উম্মত! তোমাদের দয়ালু প্রতিপালকের দিকে রওনা হও তথা ঈদের জামাতে শরিক হতে বের হও। কারণ তিনি তোমাদের ব্যাপক বা বিপুল পুরস্কার দেবেন এবং তোমাদের গোনাহগুলো ক্ষমা করবেন।'
মুসলমানরা যখন ঈদের জামাতে শরিক হওয়ার জন্য সেদিকে যেতে থাকে তখন মহান আল্লাহ ফেরেশতাদের বলেন: "হে আমার ফেরেশতারা! যেসব কর্মী তাদের কাজ সম্পন্ন করে তাদের পুরস্কার কী? ফেরেশতারা বলেন: তাদের পুরস্কার হল পরিপূর্ণ পারিশ্রমিক বা প্রতিদান দেয়া।"
তখন মহান আল্লাহ বলেন: হে আমার বান্দারা! যা খুশি তা চাও আমার কাছে! আমার সম্মান ও ঔজ্জ্বল্যের কসম খেয়ে বলছি, আজ এই ঈদের জামাতের সমাবেশে তোমরা দুনিয়া ও পরকালের জন্য যা যা চাইবে তার সবই আমি তোমাদের দান করব।
শ্রোতাবন্ধুরা, রোজা ও ঈদের দিনের পুরস্কার সম্পর্কে মহান আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সবসময়ের জন্য। আর ঈদ উদযাপনের পদ্ধতিও প্রায় একই রকম। ঈদের আগে কেনাকাটা করা ও শাওয়ালের চাঁদ দেখার মধ্য দিয়ে শুরু হয় ঈদ আনন্দ। ঈদের দিন নানা পদের মিষ্টান্নসহ সুস্বাদু রান্নার তোড়জোড়, ঈদের দিন নামাজ শেষে কোলাকুলি করা, বাসায় ফিরে গুরুজনদের পা ছুঁয়ে সালাম করা, মৃত মা-বাবার কবর জিয়ারত প্রভৃতি মুসলিম পরিবারগুলোতে রেওয়াজে পরিণত হয়েছে।
তবে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঈদের রং বদলায়। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বদলায় ঈদ আনন্দ উদযাপনের ধরন। অবশ্য শৈশব, কৈশোরের ঈদ আনন্দের স্মৃতিই সবার মনে চিরজাগরুক থেকে যায়।
শৈশবের ঈদ আর বর্তমানের ঈদ উদযাপনের ক্ষেত্রে কী ধরনের পার্থক্য লক্ষ্য করেছেন- জানতে চেয়েছিলাম বাংলাদেশের ময়মনসিংহ মহিলা ডিগ্রি কলেজের সমাজকল্যাণ বিভাগের প্রভাষক এবং সাইকোসোস্যাল কাউন্সেলর নাসিমা বেগম ঝুনুর কাছে।
অতীত ও বর্তমানের ঈদ নিয়ে বাস্তবধমী একটি চিত্র তুলে ধরেছেন আপনি। আপনার ঈদের কোনো মধুর অথবা কষ্টের স্মৃতি থাকলে তা আমাদের শ্রোতাবন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারেন।
আপনার স্মৃতিটা সত্যিই কষ্টের। মহান আল্লাহ আপনার বাবাকে বেহেশতবাসী করুন আমরা সে দোয়াই করছি। তো বন্ধুরা, আপনারা অবগত আছেন যে, এবারও ঈদুল ফিতর উদযাপন করা হচ্ছে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের মহাসংকটের মধ্যে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে যেসব মানুষ দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন আমরা তাদের জন্য মহান আল্লাহর ক্ষমা ও দয়া কামনা করছি। বিশেষ করে করোনা মোকাবেলা করতে গিয়ে যেসব স্বেচ্ছাসেবী, ডাক্তার ও নার্স জীবন দিয়েছেন তাদেরকে যেন মহান আল্লাহ শহীদ হিসেবে গণ্য করেন সেই দোয়া করছি।
বন্ধুরা, ঈদ কেবল আনন্দের জন্য আসে না, ঈদ আসে পরস্পরের কল্যাণ কামনার জন্য। তাইতো ঈদের দিন দেখা যায় সবাই নিজ পরিবার, পাড়া প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধবসহ বিশ্বের শান্তির জন্য দোয়া করে থাকে। আমাদের সবারই উচিত ফিলিস্তিন, ইয়েমেন, সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, কাশ্মির, রাখাইনসহ বিশ্বের সকল নির্যাতিত মুসলমানের জন্য দোয়া করা, তাদের আর্থিকভাবে সহযোগিতা করা এবং তাদের অধিকারের প্রতি সমর্থন জানানো।
মুসলমানদের পবিত্র ঈদগুলো তখনই পুরোপুরি সফল হবে যখন তারা ঈমানের জোরে ভেতর থেকে এতটাই শক্তিশালী হবে যে একদিকে তারা সব ধরনের পাপের প্রলোভনকে নাকচ করতে পারবে এবং অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদী ও তাগুতি শক্তির হুমকিকে উপেক্ষা করে মুক্ত করতে পারবে সবগুলো মজলুম জাতিকে। ঈদুল ফিতর আমাদের সেই শিক্ষাই দেয়ার জন্য প্রতি বছর হাজির হয়। কবি গোলাম মোস্তফার কথায়-
এনেছে নব-গীতি, এনেছে সুখ-স্মৃতি, এনেছে প্রেম-প্রীতি-পুণ্য,
এনেছে নব-আশা, একতা ভালোবাসা, নিবিড় মিলনের জন্য,
ভ্রাতৃ-প্রণয়ের মহান দৃশ্য!
মিলন-কলগানে মুখর বিশ্ব!
বিভেদ-জ্ঞান যতো আজিকে সব হত
ধন্য ঈদ তুমি ধন্য!
হৃদয়ের সব পাপ-কালিমা মুছে দিতে ঈদে এসেছে। আমরা সবাই মহান আল্লাহর কাছে গুণাহ মাফের জন্য দোয়া করব এবং ঈদের আনন্দ সবার মাঝে ভাগ করে দেবো। আর তাহলেই গরিব-দুঃখীরাও ঈদ আনন্দে হাসতে পারবে।
বন্ধুরা, আমরা সবাই সব ভেদাভেদ, শত্রু-মিত্র ও হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে এক আল্লাহর বান্দা হিসেবে ঈদের জামায়াতের ভ্রাতৃত্বও সহমর্মিতার বাস্তব দৃষ্টান্ত স্থাপন করব- এ প্রত্যাশা রেখে শেষ করছি আজকের এই বিশেষ অনুষ্ঠান।
পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/২২
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।