‘ইমাম হুসাইনের (আ.) জন্য যদি হাজার বার নিহত হতাম!’
(last modified Mon, 09 Sep 2019 13:53:01 GMT )
সেপ্টেম্বর ০৯, ২০১৯ ১৯:৫৩ Asia/Dhaka
  •  ‘ইমাম হুসাইনের (আ.) জন্য যদি হাজার বার নিহত হতাম!’

আজ হতে ১৩৮০ বছর আগে ৬১ হিজরির ৮ মহররম কারবালায় ইমাম শিবিরে পানির সংকট দেখা দেয়। আগের দিন মানবতার শত্রু  ইয়াজিদ বাহিনী ফোরাতের পানি নিষিদ্ধ করে ইমাম শিবিরের জন্য। পরের দিন অর্থাৎ নয়ই মহররম কুফায় ইয়াজিদের নিযুক্ত কুখ্যাত গভর্নর ইবনে জিয়াদ ইমাম হুসাইন (আ.)’র ছোট্ট শিবিরের ওপর অবরোধ জোরদারের ও হামলার নির্দেশ দেয়।

কারবালার মরুময় ও উষ্ণ আবহাওয়ায় হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) এবং তাঁর সঙ্গীরা তীব্র তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়েন।

ইমাম মাটি খোঁড়ার  জন্য কোদাল জাতীয় একটি যন্ত্র এনে নিজ শিবিরের তাবুগুলো থেকে ১৯ কদম পেছনে যান। মাটি খুঁড়তে থাকলে স্বচ্ছ ও সুপেয় পানি বের হয়ে আসে। ফলে সবাই পানি পান করেন এবং মশক ভরে পানি নিয়ে যান নিজ নিজ তাবুতে। এরপরই পানি অদৃশ্য হয়ে যায় এবং পানির কোনো চিহ্নও আর দেখা যায়নি। এ ঘটনার খবর পৌঁছে যায় ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদের কাছে। সে ওমর সাদের কাছে এক কর্মচারী পাঠায় একটি বার্তাসহ:

“আমি খবর পেলাম হুসাইন কুয়া খনন করে পানি সংগ্রহ করেছে। এই চিঠি তোমার কাছে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গেই আগের চেয়েও বেশি সতর্ক হয়ে যাবে যাতে ওরা পানির নাগাল না পায়।  হুসাইন ও তার সঙ্গীদের ব্যাপারে কঠিনভাবে তৎপর থাকবে।”

ওমর ইবনে সাদ ওই নির্দেশ বাস্তবায়ন করে।

এ ছাড়াও এই দিনে ইমামের সঙ্গী ইয়াজিদ বিন হুছাইন হামেদানি (রা.) ওমর সাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য ইমামের অনুমতি নেন। তিনি তাঁকে অনুমতি দিলেন।  হামেদানি (রা.) কোনো সালাম দেয়া ছাড়াই ওমর সাদের কাছে উপস্থিত হন।

ওমর সাদ: কেন আমায় সালাম করলে না? আমি কি মুসলমান নই?

হামেদানি (রা.): তুমি যদি নিজেকে মুসলমান মনে কর তাহলে কেন নবী(স.)’র পরিবারের সঙ্গে শত্রুতা করছ এবং তাঁদেরকে হত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছ ও ফোরাতের পানি তাঁদের জন্য নিষিদ্ধ করেছ, অথচ এ অঞ্চলের পশু-পাখীর জন্যও তা নিষিদ্ধ নয়?

ওমর ইবনে সাদ মাথা নিচু করে বলল: আমি জানি যে নবী(সা.)’র পরিবারকে কষ্ট দেয়া হারাম, কিন্তু আমি এখন এমন এক স্পর্শকাতর অবস্থায় আছি যে কি করব বুঝতে পারছি না। আমি কি রেই শহরের (আধুনিক তেহরানের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত) শাসনভার - যার জন্য আমি অধীর- তা ত্যাগ করব নাকি আমার হাত হুসাইনের রক্তে রঞ্জিত করব? অথচ আমি জানি যে এর শাস্তি হচ্ছে জাহান্নাম। হে হামেদানি! রেই শহরের শাসনভার আমার নয়নের আলো! আমি তা ছাড়তে পারব বলে মনে হয় না।

হামেদানি (রা.) ফিরে এসে ঘটনা বললেন ইমামের কাছে: ওমর ইবনে সাদ রেই শহরের শাসনভার পাওয়ার লোভে আপনাকে হত্যা করতে প্রস্তুত হয়েছে।

ইমাম তাঁর এক সঙ্গীকে সাদের কাছে পাঠান। রাতের বেলায় উভয়ের সেনা অবস্থানের মধ্যবর্তী স্থানে বৈঠকের প্রস্তাবে রাজি হয় সাদ। ইমাম হুসাইন (আ.) বিশ জন সঙ্গী নিয়ে আসেন এবং সাদও বিশ জন সঙ্গী নিয়ে আসে। ইমাম তাঁর সৎ ভাই হযরত আবুল ফজল আব্বাস (রা.) ও পুত্র হযরত আলী আকবর (রা.) ছাড়া অন্য সবাইকে তাবুতে ফিরে যেতে বলেন। সাদও তার পুত্র হাফস ও এক চাকর ছাড়া অন্য সবাইকে চলে যেতে বলেন।

এই সাক্ষাতে ইমাম যতবারই সাদকে বলছিলেন, ‘তুমি কি আমার সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাও?’-সাদ ততবারই অজুহাত বা ওজর দেখায়। যেমন, একবার সে বলছিল,

- আমি ভয় পাচ্ছি (ইয়াজিদ সরকার বা তার গভর্নর) আমার ঘর ধ্বংস করে দেবে!

ইমাম বললেন, আমি তোমার ঘর তৈরি করে দেব।

আরেকবার সে বলে, আমি ভয় পাচ্ছি আমার সব মালামাল ও সম্পদ নিয়ে যাবে (ইয়াজিদ সরকার)!

-আমি তোমার কাছে যা আছে তার চাইতেও উত্তম সম্পদ তোমাকে দেব যা আমার কাছে হিজাজে আছে।

-(সাদ বলে) কুফায় আমার পরিবার ইবনে জিয়াদের ক্রোধের শিকার হতে পারে। তাদেরকে হত্যা করা হতে পারে বলে আমি ভয় পাচ্ছি।  

ইমাম হুসাইন (আ.) বুঝতে পারলেন যে সাদ তার সিদ্ধান্ত বদলাবে না, অর্থাৎ ইমামের সঙ্গে যুদ্ধ করবেই। এ অবস্থায় তিনি নিজ স্থান থেকে উঠে দাঁড়ানোর সময় বললেন: তোমার কী হল? আল্লাহ শয্যার মধ্যেই তোমার জীবন নেবেন এবং কিয়ামতের দিন তোমায় ক্ষমা করবেন না। আল্লাহর শপথ! আমি জানি যে ইরাকের গম তুমি খেতে পারবে না।  

-(ইবনে সাদ বিদ্রূপ করে বলে) যবই আমার জন্য যথেষ্ট।

এই ঘটনার পর ওমর সাদ ইবনে জিয়াদ কাছে এক চিঠি পাঠায়। চিঠিতে সে লিখেছিল, হুসাইনকে ছেড়ে দেয়া হোক, কারণ, তিনি নিজেই বলেছেন হিজাজে চলে যেতে চান, অথবা অন্য কোনো দেশে চলে যেতে চান। ইবনে জিয়াদ তার সঙ্গীদের সামনে এই চিঠি পড়ে। এইসব প্রস্তাব শুনে শিমার বিন জিল জৈশান ফুঁসে উঠে।  ইবনে জিয়াদ ওমর ইবনে সাদের প্রস্তাব মেনে নিতে চাইলেও শিমারের চাপের মুখে বেঁকে বসে। উল্লেখ্য, শিমারও সেনাপতিত্ব বা রেই শহরের কর্তৃত্ব পাওয়ার জন্য লালায়িত ছিল এবং এক্ষেত্রে সাদ ছিল তার প্রতিদ্বন্দ্বি।

আসলে মুসলমানদের মধ্যে নানা দোষ-ত্রুটি প্রবল হয়ে গিয়েছিল উমাইয়া শাসনামলে। খাঁটি মুসলমানের সংখ্যা হয়ে পড়েছিল মুষ্টিমেয়। আর তাদের বেশিরভাগই ছিল ভীরু ও আপোষকামী। অন্যদিকে মুনাফিকদের অবস্থান শক্তিশালী হচ্ছিল স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.)’রই জীবদ্দশায়। ফলে সুরা বাকারা, সুরা নিসা, সুরা মুনাফিক ও সুরা তওবায় রাসূল (সা.)-কে মুনাফিকদের ব্যাপারে সতর্ক করছিলেন মহান আল্লাহ। ইসলাম যাতে ভেতর থেকেই ক্ষতির বা ধ্বংসের শিকার না হয় সে জন্য ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে বার বার সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে কুরআনের বহু আয়াতে। রাসূল (সা.) নিজেও বলতেন, আমি কাফিরদের চেয়েও মুনাফিকদের নিয়ে বেশি চিন্তিত। বিশেষ করে তাঁর জীবনের শেষের দিকে মুনাফিকদের সম্পর্কে কুরআনে আয়াত নাজিল হচ্ছিল ক্রমবর্ধমানহারে।

সৎ কাজের আদেশ ও অসত কাজে নিষেধের মত ইসলামী নৈতিকতাগুলো শিথিল হতে থাকায় শাসকরাই হয়ে পড়ছিল দুর্নীতিপরায়ণ। তাই ইসলামের মূল নীতিতে অবিচল-অটল নবী-পরিবারের ওপর মহাপ্রলয়ের মত কষ্ট নেমে আসা হয়ে পড়েছিল অনিবার্য এবং খাঁটি ইসলামকে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে ও মুসলমানদের বিবেককে জাগিয়ে তোলার জন্য  নবী-পরিবারের (তাঁদের মুষ্টিমেয় সঙ্গীসহ) পক্ষ থেকে চরম আত্মত্যাগে পরিপূর্ণ বিপ্লব ঘটানোর আর কোনো বিকল্প ছিল না।

৯ মহররমের ঘটনা 

৯ মহররম কুফায় ইয়াজিদের নিযুক্ত কুখ্যাত গভর্নর ইবনে জিয়াদের নির্দেশে শিমার কারবালায় আসে। শিমার জিয়াদের একটি চিঠি হস্তান্তর করে তাদের সেনাপতি ওমর ইবনে সাদের কাছে। ওই চিঠিতে ইমাম হুসাইন (আ.)’র ছোট্ট শিবিরের ওপর অবরোধ জোরদারের ও হামলার নির্দেশ দেয়া হয়। ইয়াজিদপন্থী সেনা সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে থাকে কারবালায়।

ফলে ইমামের শিবির ঘেরাও করে ফেলে ইয়াজিদ সেনারা। ইবনে জিয়াদ ও ওমর ইবনে সাদ তাদের সেনা সংখ্যার আধিক্য দেখে নিশ্চিত হয় যে সম্ভাব্য যুদ্ধে ইমাম হুসাইন (আ.)ই পরাজিত হবেন এবং নানা ধরনের বাধা-বিপত্তির পাহাড় ডিঙ্গিয়ে ইরাকিরা বা অন্য কেউই ইমামকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে না। ( কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে দূরবর্তী কোনো কোনো অঞ্চল থেকে ইমাম ও আহলে বাইতের  উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বা কয়েক শত সমর্থক যখন অবরূদ্ধ ইমাম আ. এবং তাঁর পরিবার ও সঙ্গীদেরকে সাহায্যের জন্য কারবালার কাছাকাছি পৌঁছেন ততক্ষণে ঘটে যায় আশুরার  মহাট্র্যাজেডি বা বিয়োগান্তক ঘটনা।)

শিমার সৌন্দর্যের জন্য বনু হাশিমের চাঁদ নামে খ্যাত আবুল ফজল আব্বাস ও তাঁর ভাইদেরকে ইয়াজিদ সরকারের পক্ষ থেকে নিরাপত্তার গ্যারান্টিসূচক একটি কার্ড দিতে চেয়েছিল এই শর্তে যে তাঁরা ইমামের (আ.) পক্ষ ত্যাগ করবেন। কিন্তু বীরত্ব ও ইমামের প্রতি আনুগত্যের জন্য খ্যাত হযরত আব্বাস (আ.) তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেছিলেন: তোমার ওপর ও তোমার আমিরের ওপর এবং নিরাপত্তা কার্ডের ওপর আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হোক। তুমি আমাদেরকে নিরাপত্তা দিতে চাইছ অথচ আল্লাহর রাসূল (সা.)’র পুত্রকে নিরাপত্তা দিচ্ছ না।

ইমাম হুসাইন (আ.) নয়ই মহররমের বিকালের দিকে এক দিনের জন্য যুদ্ধ পিছিয়ে দেয়ার প্রস্তাব দেন যাতে দশই মহররমের রাতটি শেষবারের মত ইবাদত বন্দেগিতে কাটানো যায়। ইয়াজিদ বাহিনীর প্রধান প্রথমে রাজি না হলেও পরে এ প্রস্তাবে রাজি হয়। বিকালেই হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) নিজ সঙ্গীদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দেন। সঙ্গীরা আবারও তাঁর প্রতি আনুগত্যের অঙ্গীকার করেন।

নয়ই মহররম কালজয়ী কারবালা বিপ্লবের চূড়ান্ত প্রস্তুতি ও পরিণতির দিকে এগিয়ে যাওয়ার দিন। মানব ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার প্রস্তুতি অর্জনের সর্বশেষ দিন। এই পরীক্ষায় সফল হয়েছিলেন  ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর প্রায় ১০০ জন সহযোগী। আর এ জন্যই তাঁরা  ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করেছেন।

আশুরার রাত

ইমাম হুসাইন (আঃ)’র জীবনের সবচেয়ে বড় আকাঙ্ক্ষা ছিল শাহাদত। কারণ, রাসুলে খোদা স্বয়ং বলেছেন, শাহাদাত হচ্ছে সবচেয়ে বড় পুণ্য। মনে পড়ে গেল তাঁর মহান পিতার শাহাদতের সময়কার কথাটি, সেটি হলো, কাবার প্রভুর কসম আমি সফল হয়েছি। তিনি বলেছিলেন খোদার কসম , অনাকাঙ্ক্ষিত কিছুই ঘটেনি। মনে পড়ে গেল  নানাজী রাসূল (সা.)’র কথা। তিনি আধ্যাত্মিক জগতে তাঁর উচ্চ মর্যাদার সুসংবাদ তাঁকে দিয়েছিলেন।

 এসব ভাবতে ভাবতে তাঁর ক্লান্ত অবসন্ন চোখে তন্দ্রা চলে এলো। স্বপ্নে দেখলেন নানাজান রাসুলে খোদাকে, পিতা হযরত আলীকে, স্নেহময়ী মা ফাতিমাকে, আর ভাই ইমাম হাসানকে (তাদের সবার ওপর মহান আল্লাহর অশেষ রহমত ও দরুদ বর্ষিত হোক)। তাঁরা বললেন, হে হুসাইন! তুমি আগামীকালই আমাদের সাথে মিলিত হবে। এর পরপরই তার তন্দ্রা ভেঙ্গে গেল। ইমাম  (আঃ) তাঁর বোন বিবি  জাইনাবকে স্বপ্নের কথা খুলে বললেন। ভাইয়ের নিশ্চিত শাহাদাতের কথা শুনে বোনের মন কি আর মানে ? বোন চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন। ইমাম তাঁকে সান্ত্বনা দিলেন।

ইমাম  (আঃ) পরদিনের মহাকুরবানির জন্য প্রস্তুত হলেন। এই কুরবানি হবে সম্পূর্ণ নিষ্কলুষ ও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। এতে তিল পরিমাণ খাঁদ থাকতে পারবে না। কারণ, আগামীকাল যারা আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হবেন তাঁদের প্রতিটি রক্ত বিন্দু শত সহস্র রক্ত বিন্দুতে নয় বরং লক্ষ-কোটি রক্ত বিন্দুতে পরিণত হয়ে সমাজ-দেহে সঞ্চালিত হবে। শহীদের খুন রক্তশূণ্যতায় আক্রান্ত সমাজ-দেহে নতুন রক্ত প্রবাহ দান করে। তাঁদের ব্যক্তিত্ব ও স্মৃতি যুগযুগ ধরে মানুষকে মুক্তির প্রেরণা যোগায়। তাদেরকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস ও চেতনা দান করে। শহীদরা কিয়ামত পর্যন্ত অমর থাকবেন এবং শেষ বিচারের দিন আল্লাহ তাঁদেরকে এমন জৌলুসসহ হাজির করবেন যে স্বর্গীয় বাহনে উপবিষ্ট নবী-রাসূলরাও তাঁদেরকে সম্মান দেখানোর জন্য নীচে অবতরণ করবেন।

তাই ইমাম তাঁর কাফেলার মধ্যে যাদের নিয়্যতে বিন্দু পরিমাণ গোলমাল আছে তাদের কাছ থেকে মুক্ত হতে চাইলেন। তিনি সবাইকে একস্থানে সমবেত করলেন এবং শাহাদাতের ইতিহাসে সবচেয়ে স্মরণীয় ভাষণ দিলেন। তিনি মহান আল্লাহর প্রশংসা করে বললেন, "আমি আমার সঙ্গী সাথীদের চেয়ে কোন সাথীকে বেশি নেককার এবং আমার আহলে বাইতের চেয়ে কোন পরিবারকে বেশি উত্তম মনে করি না। মহান আল্লাহ তোমাদের সবাইকে উত্তম প্রতিদান দিন।"

ভয়াবহ আশুরার পূর্বাভাস নিয়ে ঘনিয়ে এলো অন্ধকার। ধৈর্য্যের মূর্ত প্রতীক ইমাম হুসাইন (আঃ) সকলকে কাছে ডাকলেন। বললেন, ভায়েরা আমার! জেনে রাখো আজকের এই রাত হবে তোমাদের শেষ রাত। আমার সাথে থাকলে তোমরা কেউ রেহাই পাবে না। আগামীকালই আমাকে ও আমার পরিবার পরিজনকে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হবে। এমনকি আমার দুধের বাচ্চাকেও এরা রেহাই দেবে না। ভাইসব, "তোমরা ইচ্ছে করলে চলে যেতে পারো। আমার হাতে তোমরা যে বায়াত করেছো, তা আমি ফিরিয়ে নিলাম। তোমরা এখন মুক্ত। আমার জন্যে শুধু শুধু তোমরা কেন প্রাণ দেবে? শত্রুরা শুধু আমাকে চায়, তোমাদেরকে নয়। এখন অন্ধকার রাত। যার ইচ্ছা চলে যাও, কেউ দেখতে পাবে না।" ইমাম ভাষণ শেষ করে তাঁর ভাই আব্বাসকে প্রদীপ নিভিয়ে দিতে বললেন।

কিন্তু আশুরার রাতে কেউই ইমামকে ত্যাগ করেননি বলে বেশিরভাগ ঐতিহাসিকরাই উল্লেখ করেছেন। অবশ্য বলা হয় ইমামের সঙ্গীদের সংখ্যা  ছিল একশো জনেরও কম।

আত্মত্যাগের আদর্শে বলীয়ান বিশুদ্ধ অন্তরের এই মর্দে মুমিনদের দিকে তাকিয়ে ইমামের প্রশান্ত মুখটা উজ্জ্বল দীপ্তিমান হয়ে উঠল। মহাকালের মহাত্যাগের জন্যে এরকম বিশুদ্ধ হৃদয়গুলোই তাঁর প্রয়োজন ছিল। তবুও তিনি তাঁর সাথীদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কেন গেলে না? এ প্রশ্ন শুনে আহলে বাইতের সদস্যরা বলে উঠলেন, একি বলছেন হযরত! আমরা আপনাকে একা ফেলে কিভাবে চলে যাবো? লোকের কাছে গিয়ে কীভাবে মুখ দেখাবো? আমরা কি বলব মহানবী (সঃ) এর সন্তানকে আমরা একা ফেলে চলে এসেছি। তা কখনো হবে না। নিজের জীবন দিয়ে দেব তবুও আপনাকে ছেড়ে যাব না। আপনার সাথে থেকে শহীদ হব।

 মুসলিম বিন আউসাজা দাঁড়িয়ে বললেন, প্রিয় ইমাম একি বলছেন আপনি! আপনাকে দুশমনদের হাতে ফেলে রেখে পালিয়ে যাবো? খোদা আপনার পরে যেন আমাদের জীবিত না রাখেন। আমরা যুদ্ধ করবো । গায়ে শক্তি থাকা পর্যন্ত দুশমনের গায়ে তলোয়ার চালাবো, বর্শা চালবো। ওগুলো ভেঙ্গে গেলে পাথর মেরে মেরে যুদ্ধ করবো।

সাঈদ বিন আবদুল্লাহ হানাফী বললেন, প্রিয় ইমাম ! খোদার কসম আপনাকে রেখে আমরা কোথাও যাবো না। আপনার জন্যে যদি নিহত হই ও জীবন্ত দগ্ধ হই এবং তা যদি ৭০ বারও হয় তবুও আমি আপনাকে ছেড়ে যাব না। আপনি মরে যাবেন আর আমরা বেঁচে থাকব এ কি করে হয় ! যুহাইর ইবনে কাইন উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, হে মহানবীর প্রিয় সন্তান, আপনি ও আপনার পরিবারকে রক্ষার জন্যে আমাকে যদি হাজার বারও মেরে ফেলা হয় তাহলেও আমি আপনাকে রক্ষার জন্য যুদ্ধ করব। অর্থাৎ আপনার জন্য আমার এ নগণ্য জীবনকে মাত্র একবার কুরবান করা খুবই তুচ্ছে!  এভাবে ইমামের বিভিন্ন সঙ্গী সাথী ইমামকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন, নিজেদের আন্তরিকতা প্রকাশ করতে লাগলেন।

সঙ্গী-সাথীদের এরকম দৃঢ়তা দেখে ইমামের চেহারা মুবারক এক অভূতপূর্ব প্রফুল্লতায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। তিনি মহান আল্লাহকে ধন্যবাদ জানালেন। ইমাম হুসাইন (আঃ)’র ভাষণের পর সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে মশগুল হলেন ইবাদতে। কেউ সিজদায়, কেউ নামাজে, কেউ মুনাজাতে। কারবালার প্রান্তর সিক্ত হয়ে উঠল বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শহীদদের অশ্রুতে। দুনিয়ার সব ফেরেশতা যোগ দিলেন তাঁদের এই প্রার্থনায়।#

পার্সটুডে/এমএএইচ/৯

ট্যাগ