শিশুদের প্রতি যৌননির্যাতন ও সহিংসতার কারণ : প্রতিরোধে বিভিন্ন মহলের পরামর্শ
(last modified Wed, 23 Feb 2022 12:00:20 GMT )
ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২২ ১৮:০০ Asia/Dhaka

বাংলাদেশে শিশুদের প্রতি যৌননির্যাতনসহ নানা সহিংসতার ঘটনা ক্রমশ বাড়ছে। দেশে গত বছর (২০২১ সালে ) ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৮১৮ শিশু। ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ৯৪ শিশুকে। আর ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৪ শিশুকে। এ ছাড়া নানাভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১১০ শিশু।

এমজেএফের বিশ্লেষণ অনুযায়ী শিশুরা নিজের বাসায়ও নিরাপদ নয়। শিশু ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি বন্ধ করার জন্য সবাইকে এখনই জোটবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে, নতুবা এই হার বাড়তেই থাকবে।

সাম্প্রতিক সময়ে শিশুদের প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধির কারণ সামাজিক  ও পারিবারিক পর্যায়ে নৈতিক শিক্ষার অভাব, করোনা পরিস্থিততে  অলস সময়ে  ফেসবুক আসক্তি, মোবাইল ফোনের মাধ্যমে নানাবিধ আপত্তিকর  বিষয়বস্তু  ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া- এ সবকে দায়ী  করেছেন সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (সামাজিক নিরাপত্তা) মোসাঃ উম্মে হাবিবা আকতার। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন বিস্তারিত পরসিংখ্যান তুলে ধরে জানিয়েছে, গত বছর (২০২১)  আত্মহত্যা করেছে ৭৮ শিশু, যা আগের বছরের দ্বিগুণেরও বেশি। আর হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে ১৮৩ শিশু। এই সময়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করতে গিয়ে আহত হয়েছে ২৩ শিশু। আগের  বছর  ২০২০ সালে আত্মহত্যাকারী শিশুর সংখ্যা ছিল ৩৪।

মূলত পরীক্ষায় ফল বিপর্যয়, পরিবারের ওপর রাগ, উত্ত্যক্ত হওয়া, ধর্ষণ বা ধর্ষণের চেষ্টার শিকার, ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানির বিচার না পাওয়া এবং সাইবার ক্রাইম বা ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়ে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে।

এ ছাড়া গত বছর ১৮৩ শিশুকে হত্যার পাশাপাশি ১৩৫ শিশুকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। ২০২০ সালে হত্যার শিকার হয় ১৪৫ শিশু। এর বাইরে গতবছর  নানা ধরনের নির্যাতনে আহত হয়েছে ২৫৪ শিশু। নিখোঁজ  হয়েছে ৩৮ শিশু। পানিতে ডুবে মারা গেছে ৫৭০ শিশু।

আগের বছর ২০২০ সালে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৬৫ এবং নিখোঁজ ও অপহরণের শিকার হয়েছিল  ২২ জন। অপহরণের কারণ হিসেবে বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান, প্রতিশোধ গ্রহণ, পাচার ও মুক্তিপণ দাবি করার বিষয় প্রকাশ পেয়েছে।  এ ছাড়া সড়ক দুর্ঘটনায় ২০২১ সালে নিহত হয়েছে ৬৯ শিশু। এর আগের বছর (২০২০ সালে)  এই সংখ্যা ছিল ১৫৮।

২০২১ সাল  শিশুদের শারীরিকভাবে  নির্যাতনের ঘটনা পকাশ পেয়েছে ৫৬টি আর ২০২০ সালে শিশু নির্যাতনের ঘটনা প্রক্সশ পেয়েছে ১৬টি। নির্যাতনকারী হিসেবে গৃহকর্তা, মা-বাবা, শিক্ষক, উত্ত্যক্তকারী, স্থানীয় চেয়ারম্যান, চাকরিদাতা ও প্রতিবেশীর নাম উঠে এসেছে। তাছাড়া, ২০২১ সালে অপরামুলক কর্মকান্ডে  সংশ্লিষ্ট হওয়া শিশুর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১২০, যা ২০২০ সালে ছিল দু’টি।

সংবাদ সম্মেলনে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (শিশু ও সমন্বয় উইং) মুহিবুজ্জামান বলেন, পত্রিকা থেকে প্রাপ্ত তথ্য হচ্ছে অপরাধপ্রবণতার একটা ধারণা মাত্র। ১০৯ নম্বরে হটলাইনে প্রতিদিন অসংখ্য ফোন আসে।

রক্ষণশীল সামাজিক রীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর পরামর্শ ইউনিসেফের

জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংগঠন ইউনিসেফ  বলছে, বিশ্বজুড়েই শিশুরা নানা ধরনের সহিংসতার শিকার হয়। যৌন হয়রানি, সহিংস আক্রমণ, শারীরিক শাস্তি, মানসিক নির্যাতন ও অবহেলা-এর যে কোনোটা ঘটতে পারে তার সঙ্গে।

বাংলাদেশেও শিশুরা এমন অনাচারের শিকার হয়। ব্যক্তিগত বা সরকারি অফিসে, বাড়িতে, স্কুলে, রাস্তায়, কর্মস্থলে ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তাদের সঙ্গে এমন আচরণ করা হয়ে থাকে। সহিংসতা, যৌন নিপীড়ন, শিশু শ্রম, বাল্যবিয়ে এবং মানসিকভাবে হয়রানি এখনও অহরহই ঘটছে। শিশুর প্রতি সহিংসতার ক্ষেত্রে দারিদ্র্য একটি বড় ভূমিকা রাখে।

ইউনিসেফ  বলছে, বাংলাদেশে শিশুর সুরক্ষা আইন এখনও পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। শিশুদের জন্য যেসব সেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে সেগুলোতে মান ও সমতার ঘাটতি রয়ে গেছে। শিশুর সুরক্ষায় যেসব প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কথা সেগুলোতেও পর্যাপ্ত লোকবল ও অর্থ বরাদ্দ হয় না। বাংলাদেশে শিশুদের এখনও দেখা হয় রক্ষণশীল সামাজিক রীতি ও দৃষ্টিভঙ্গিতে, যাতে গুরুতর অধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটতে পারে।

বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে আইন আছে। তবে তা যৌন হয়রানির ঘটনাকে আমলে নেয় না। অথচ যৌন হয়রানির প্রবণতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। অনেক ক্ষেত্রে কিশোরীরা আত্মহত্যা করে অথবা আরও সহিংসতার শিকার হয়।

ইউনিসেফ মনে করে বিশ্বজনীন শিশু অধিকার সনদের বেঁধে দেওয়া আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করতে বাংলাদেশের শিশু আইনের সংস্কার করা দরকার। একই সাথে  শিশুদের  সুরক্ষায়  আইন প্রয়োগের মাধ্যমে সমাজে শক্তশালী বার্তা পৌঁছে দিতে হবে যে, সহিংসতা, শোষণ-বঞ্চনা এবং কোনোভাবে শিশুর প্রতি অবহেলা মেনে নেওয়া হবে না।

শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের সুরক্ষায় শিশু আইন ২০১৩ বাস্তবায়নে কৌশলগত প্রচারণার পাশাপাশি কারিগরি সহযোগিতা দেয় ইউনিসেফ। শিশু শ্রম কমাতে বিদ্যালয় থেকে তাদের ঝরে পড়া রুখতে সহায়তামূলক পদক্ষেপ নিয়েছে ইউনিসেফ।  চা বাগান, পার্বত্য চট্টগ্রাম, শরণার্থী অধ্যুষিত এবং দুর্যোগপ্রবণ এলাকাসহ দুর্গম অঞ্চলের শিশুদের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া হচ্ছে।

শিশু সুরক্ষা ব্যবস্থা জোরদারে তৎপরতার পাশাপাশি যেসব ক্ষতিকর সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে শিশুরা সহিংসতার শিকার হয় সেগুলোরও পরিবর্তনেও কাজ করছে ইউনিসেফ। যে সব উপজেলায় শিশুর প্রতি সহিংসতার মাত্রা খুব বেশি সেগুলো শনাক্ত করে ওয়ার্ড ও কমিউনিটি পর্যায়ে বিশেষ কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। শহর এলাকা, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রবণ অঞ্চল ও দুর্গম এলাকা যেখানে নাজুক পরিস্থিতিতে থাকা শিশুর সংখ্যা অনেক বেশি সে সব এলাকা খুঁজে খুঁজে বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।

শিশুরা যাতে নিজেরাই মানসম্মত সেবা খুঁজে নিতে পারে এবং সহিংসতার ঘটনা ঘটলে সে বিষয়ে অভিযোগ জানাতে পারে সে বিষয়ে উৎসাহিত করছে ইউনিসেফ। হেল্পলাইন ১০৯৮-এ ফোন করে তারা এসব সেবা গ্রহন করতে পারে।#

পার্সটুডে/আবদুর রহমান খান/বাবুল আখতার/২৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

 

 

ট্যাগ