মার্চ ২২, ২০২২ ১৫:৫১ Asia/Dhaka

কৃষি বিজ্ঞানীদের অদম্য প্রচেষ্টা, চাষীদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর কৃষি বিভাগের  অনুকূল সহায়তায় বাংলাদেশে নীরবে ঘটে গেছে আলুর বিপ্লব। গত চার যুগে আলুর উৎপাদন বেড়েছে ২৬ গুণ। আর মাথাপিছু আলু খাওয়ার পরিমাণ বেড়েছে দশগুণ। ভাতের পর এখন দেশের দ্বিতীয় প্রধান খাদ্য ও খাদ্যশক্তির উৎস হচ্ছে আলু।

আলু উৎপাদনে বিস্ময়কর সাফল্যই থেকে এটি এখন দেশের অন্যতম অর্থকরী ফসল। বাংলাদেশে উৎপাদিত আলু দেশের চাহিদা পূরণ করে বর্তমানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ইউরোপের ১১টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। আলু হয়ে উঠেছে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেরও উৎস।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসাবে বাংলাদেশের খাদ্যশক্তির দ্বিতীয় প্রধান উৎস আলু। বাংলাদেশের মানুষ বছরে মাথাপিছু প্রায় ২৩ কেজি করে আলু খায়- যা ভারতের চেয়ে আট কেজি বেশি। আলু খাওয়ার পরিমাণ বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে বলেও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। 

এদিকে, ভর্তা-ভাজি আর তরকারির গণ্ডি ছাড়িয়ে আলু এখন ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, পটেটো চিপস বা পটেটো ফ্লেক্স হিসেবে প্যাকেটজাত হয়ে বিদেশেও পাড়ি দিচ্ছে। গত এক যুগে দেশে ২০টিরও বেশি আলু প্রক্রিয়াজাত পণ্য উৎপাদন কারখানা স্থাপিত হয়েছ। এর মধ্যে অন্তত আটটি কোম্পানি আলু থেকে উৎপাদিত চিপস ও ফ্রেঞ্চ ফ্রাই বিদেশে রপ্তানি করছে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সর্বশেষ আলুর উৎপাদন-বিষয়ক পরিসংখ্যান বলছে, আলু উৎপাদনে বিশ্বে সপ্তম বাংলাদেশ। আর বাংলাদেশের ওপরে আছে চীন, ভারত, রাশিয়া, ইউক্রেন, যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০২০-২১ সালে বাংলাদেশে ১ কোটি ১৩ লাখ টন আলুর উৎপাদন হয়েছে। আর ওই সময়ে দেশের আলুর চাহিদা ছিল ৭৭ লাখ টন।

আলুর বিপ্লব

গত এক যুগে দেশের বিজ্ঞানীরা প্রায় ৭০টি আলুর জাত উদ্ভাবন করেছেন। মূলত ২০০২ সাল থেকে বাংলাদেশে আলু উৎপাদন ব্যাপক হারে বাড়তে থাকে। ইউরোপে যেখানে আলুর সঠিক ফলন পেতে পাঁচ থেকে ছয় মাস লাগে, সেখানে বাংলাদেশে আলু পেতে তিন মাস লাগে। এখানকার মাটি, পানি ও আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে যাওয়ায় আলুর উৎপাদন সময়কাল কমেছে।

আশির দশকে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) বিজ্ঞানীরা নেদারল্যান্ডসের জাতগুলোকে উন্নত করে দেশের আবহাওয়া উপযোগী করার প্রচেষ্টা শুরু করে। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত আলুর জাত নিয়ে কৃষকরা আবাদ শুরু করেন। বর্তমানে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি এলাকা ছাড়া দেশের সব স্থানেই আলুর চাষ হচ্ছে। তবে সবচেয়ে বেশি আলু ফলে মুন্সীগঞ্জ, বগুড়া ও রংপুর অঞ্চলে।

এদিকে, শিল্পকারখানায় ব্যবহার উপযোগী এবং বিদেশে রফতানির উদ্দেশ্যে উন্নত জাতের আলু উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) উদ্যোগে কিশোরগঞ্জের চরাঞ্চলে উদ্যোগে পরীক্ষামূলক ভাবে শুরু হয়েছে বিদেশে রফতানি উপযোগী উন্নত জাতের আলু চাষ।

সেখানে আবাদ হয়েছে জার্মানির সানসাইন, কুইনএ্যানি, নেদারলান্ডসের প্রোডা, সান্তানা, এডিসন, ডায়মন্ড, ফরিদা, অ্যালকেন্ডার, মিউজিকাসহ ২০ জাতের আলু।

এ বিষয়ে কিশোরগঞ্জ জেলা বিএডিসির উপ-পরিচালক (বীজ বিপনন) মো. রুহুল আমিন জানান, দেশে প্রতি হেক্টর জমিতে প্রচলিত জাতের আলু উৎপাদিত হয় ২০ থেকে ২৫ মেট্রিক টন। আর নতুন জাতের আলু উৎপাদিত হয় ৪০ থেকে ৫০ মেট্রিক টন। দেশে প্রতিবছর চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি আলু উৎপাদিত হলেও, রফতানি এবং শিল্পে ব্যবহার উপযোগী আলু না থাকায় কৃষককে লোকসান গুনতে হয়। তাই বিদেশে রফতানি উপযোগী উন্নত জাতের আলু চাষের এ উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বিএডিসির এই শীর্ষ কর্মকর্তা।

রপ্তানি পণ্য আলু

আলু রপ্তানিতে সম্পৃক্ত ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে আলুর উৎপাদন বছরে ৫ দশমিক ১৯ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে এক কোটি টন ছাড়িয়েছে। আলুর বার্ষিক অভ্যন্তরীণ চাহিদা প্রায় ৭০ লাখ টনের মতো। সে হিসাবে দেশে প্রায় ৩০ লাখ টন আলু অতিরিক্ত থাকছে। রপ্তানি উপযোগী আলু উৎপাদনে উন্নতমানের বীজের ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে বাংলাদেশ থেকে স্থায়ীভাবে বৃহৎ পরিসরে আলু রপ্তানির সুযোগ রয়েছে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এক লাখ দুই হাজার টন আলু রপ্তানি হয়। সেটি কমতে কমতে সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে মাত্র ৫৬ হাজার টনে নেমেছে।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, এক সময় বেশি রপ্তানি হতো মালয়েশিয়ায়। এ ছাড়া রাশিয়া, সিঙ্গাপুর, শ্রীলংকা, ব্রুনাই, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশে আলুর চাহিদা ছিল।

সম্প্রতি ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেই বাংলাদেশ থেকে আলু আমাদনিতে পূর্বের নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নিয়েছে রাশিয়া।

বাংলাদেশের আলুতে ‘ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া’ পাওয়ার কথা তুলে ২০১৫ সালের মে থেকে আলু আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা দেয় রাশিয়া।

এ নিয়ে দু’দেশের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে চলা আলোচনা ও দেনদরবারের মধ্যে ইউক্রেইনে সামরিক অভিযান চলার মধ্যে বাংলাদেশি আলু আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিল রাশিয়া।

বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেছেন, ২০২০ সালে চাষিরা ভালো দাম পেয়েছিলেন। তাই পরের বছর বেশি চাষ করেছেন। কিন্তু গত বছরের মতো এবারও আলুর দাম একেবারে নিম্নমুখী। গত বছর প্রায় ২০ লাখ টন আলু কোল্টস্টোরেজে উদ্বৃত্ত থেকে গেছে। এবারও সংরক্ষিত আলু বাজারজাত না করতে পারলে বিপুল পরিমাণ আলু অবিক্রীত থেকে যাবে। ন্যায্যমূল্য না পেলে চাষিরা আগামীতে আলু চাষে নিরুৎসাহিত হবেন। আলুর বাজারমূল্যে এই বিপর্যয় ঠেকাতে প্রক্রিয়াজাত কারখানার সংখ্যা বৃদ্ধি ও রপ্তানির উদ্যোগ দরকার।

ইতোমধ্যে, আলুর মূল্য সংকট দূর করতে ২০২৫ সাল নাগাদ আড়াই লাখ টন আলু রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে খসড়া রোডম্যাপ তৈরি করেছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)। রোডম্যাপে বলা হয়, নিম্নমানের আলু উৎপাদন, যথোপযুক্ত প্রত্যয়ন ও অ্যাক্রিডিটেড ল্যাবের অভাব, পরিবহন সমস্যা, আলু রপ্তানিতে উচ্চ হারে ভ্যাট ও ট্যাক্স আদায় এবং কুলিং চেম্বার, কোল্ডস্টোরেজ ও কুলিং ভ্যানের অপ্রতুলতার কারণে উৎপাদনের সঙ্গে সংগতি রেখে পণ্যটির রপ্তানি বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। #

পার্সটুডে/আবদুর রহমান খান/আশরাফুর রহমান/২২

ট্যাগ