পাক-ভারত যুদ্ধ বন্ধে আমেরিকা কেন এগিয়ে এলো?
(last modified Tue, 13 May 2025 11:22:47 GMT )
মে ১৩, ২০২৫ ১৭:২২ Asia/Dhaka
  • পাক-ভারত যুদ্ধ বন্ধে আমেরিকা কেন এগিয়ে এলো?

সাইফুল খান: বর্তমান বিশ্বে যুদ্ধ মানে কেবল রণক্ষেত্রে সংঘর্ষ নয় বরং এটি প্রযুক্তি, অর্থনীতি, কূটনীতি এবং সমরাস্ত্র শিল্পের মঞ্চেও সমান গুরুত্বপূর্ণ। ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে নতুন করে উত্তেজনার পরে আমেরিকা মোটামুটি নিশ্চিত ছিল যে, ভারতের কাছে পাকিস্তান শোচনীয়ভাবে হারবে। তাদের গোয়েন্দা তথ্য সেরকমই ছিল।

ফলে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে ভারতের প্রতি লজ্জা ছুড়ে দিয়ে চুপচাপ থাকে। এর বেশি কিছু নয়। কিন্তু যুদ্ধের পারদ বাড়তেই যুক্তরাষ্ট্র সরব হয়ে ওঠে যুদ্ধ ঠেকাতে। বিশেষ করে পাকিস্তানের ধুন্দুমার Kill box doctrine এপ্লাই, পশ্চিমা সমরবিদদের কপালে ভাঁজ ফেলে দিয়েছে। সত্যি বলতে কী! পাকিস্তানের কাউন্টার অ্যাটাক এতটা তীব্র ও কার্যকর হবে এ ধারনাই কারো ছিল না। বরং পাকিস্তান নাস্তানুবাদ হলে পশ্চিমা জোট ভারতকে বগলে নিয়ে কাঠগড়ায় পাকিস্তানকে রেখে চীনকে দমন করতে পারত। সেসব কিছুই ঘটেনি বরং উল্টো ঘটনা ঘটেছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্রুত মধ্যস্ততা করে যুদ্ধ থামিয়ে দিয়েছে। কোন মুসলিম দেশ বা পশ্চিমের স্বার্থবিরোধী বিজয়ের কাছে গেলে পশ্চিম এভাবেই থামায়। ড. নাজমুদ্দিন এরবাকানের তুরস্ককে একইভাবে ১৯৭৪ সালে না থামালে আজ পুরো সাইপ্রাস থাকতো তুরস্কের মানচিত্রে।

যাক প্রসঙ্গে আসি, প্রশ্ন হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের এই মধ্যস্থতার পেছনে কি কেবল মানবিক দায়বদ্ধতা নাকি বৃহৎ ভূ-রাজনৈতিক ও সামরিক কৌশলও রয়েছে? বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের মানবিক দায়ের আমলনামার নথিপত্র যা আমাদের হাতে আছে। তাতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকায় আশাবাদী হওয়ার কিছু নেই।

যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান: ভারতঘেঁষা বাস্তবতা

গত ১৫ বছরে ভারতকে যুক্তরাষ্ট্র ‘সাউথ এশিয়ার পিভট’ হিসেবে দেখেছে।

QUAD (ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র) জোটের সদস্য হিসেবে ভারতকে সমুদ্র নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার বানানো হয়েছে।

২০২২ সালে “Initiative on Critical and Emerging Technology (iCET)” চুক্তির মাধ্যমে ভারতকে AI, কোয়ান্টাম প্রযুক্তি এবং সেন্সর সিস্টেম সরবরাহের কথা বলা হয়।

LEMOA, COMCASA, BECA-এর মতো প্রতিরক্ষা চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে উচ্চ প্রযুক্তির মিলিটারি নেটওয়ার্কে সংযুক্ত করেছে।

এই প্রেক্ষাপটে, পাকিস্তানের বিপক্ষে ভারতের যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র স্বভাবতই ভারতের পাশে দাঁড়াবে। কিন্তু বাস্তবতা আজ অনেক জটিল।

চীনের ভূমিকাই কি যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের মূল কারণ?

চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের সামরিক সম্পর্ক কেবল অস্ত্র কেনাবেচা নয়- এটি যৌথ প্রযুক্তি উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ ও গোয়েন্দা আদান-প্রদান পর্যন্ত বিস্তৃত।

JF-17 যুদ্ধবিমান, VT-4 ট্যাংক, HQ-9B মিসাইল, WL-2 ড্রোন ইতোমধ্যে পাকিস্তানের হাতে।

যুদ্ধ শুরু হলে এইসব অস্ত্র battle-tested হিসেবে প্রমাণিত হয় এবং হবে, যা আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে চীনা অস্ত্রের বিশ্বস্ততা বাড়িয়ে তুলবে। চীনের Beidou স্যাটেলাইট পাকিস্তান ব্যবহার করে; এটি GPS-এর বিকল্প।

যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর চীন পাকিস্তানকে নির্ভরযোগ্য স্যাটেলাইট ইন্টেলিজেন্স দেয়। যা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অস্বস্তিকর বিষয়। সাথে যুক্ত হয়েছে চীনের সাইবার সক্ষমতা। ভারত বা তার মিত্রদের কমিউনিকেশন ব্লক বা বিভ্রান্ত করতে খুবই কার্যকর।

ইউক্রেন ও ভারত দুই ফ্রন্টে ভারসাম্য অসম্ভব

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলারের সরাসরি সহায়তা দিয়েছে ইউক্রেনকে, যার মধ্যে রয়েছে HIMARS রকেট সিস্টেম, Abrams ট্যাংক, Raytheon এবং Lockheed Martin-এর সরঞ্জাম।

যদি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ লার্জ স্কেলে বাধে এবং যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সামরিকভাবে সমর্থন দিতে চায়, তবে অস্ত্র সরবরাহ ও ইন্টেলিজেন্স শেয়ারে বিভাজন হবে।

ইউক্রেনে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে রাশিয়া লাভবান হবে। অন্যদিকে ভারতের পাশে দাঁড়ালে যুক্তরাষ্ট্র মুসলিম বিশ্বে (বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে) বৈরী বার্তা দিতে পারে। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র এক ধরণের ভূরাজনৈতিক ফাঁদে পড়েছে।

গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজিক স্টেক: যুদ্ধ হলে কার কী লাভ বা ক্ষতি?

লার্জ স্কেলে লং রান যুদ্ধ হলে চীনের লাভ হবে। অস্ত্রশক্তির বৈধতা ও দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারে। পাকিস্তান যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক মোড় ঘোরাতে পারবে।

কেবলমাত্র জাতীয়তাবাদী আবেগে উজ্জীবিত ভারত চীন-নির্ভর পাকিস্তানকে চ্যালেঞ্জ করতে পারবে না সঠিকভাবে। মোদ্দা কথা চীন-পাকিস্তান দুই ফ্রন্টে যুদ্ধ আমেরিকার জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র যদি যুদ্ধ থামাতে পারে, তবে চীনের মিলিটারি ওয়েপনস ফিল্ড টেস্ট রুখে দিতে পারবে। আর থামাতে না পারলে মার্কিন বৈশ্বিক প্রভাব হ্রাস পাবে নিশ্চিত।

যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল: প্রকাশ্যে মানবিক উদ্বেগ, ভেতরে শক্তির হিসাব

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ার সম্ভাব্য যুদ্ধ পরিস্থিতিতে প্রকাশ্যে যা বলছে, তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু ঘটছে পর্দার আড়ালে। মুখে ‘মানবিক বিপর্যয়’, ‘পারমাণবিক হুমকি’ ও ‘সন্ত্রাসবাদের পুনরুত্থান’ রোধের কথা বললেও, তাদের মূল উদ্বেগ আসলে চীনের সামরিক সক্ষমতা বিশ্বমঞ্চে বৈধতা পাওয়ার সম্ভাবনা।

যদি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে, পাকিস্তান চীনা অস্ত্রে ধারাবাহিক  সাফল্য দেখাতে থাকে। তবে তা হবে চীনের অস্ত্রশিল্পের জন্য বাস্তব যুদ্ধের সার্টিফিকেট। JF-17 ব্লক III, Wing Loong-2 ড্রোন, VT-4 ট্যাংক, HQ-9B SAM-এর মতো অত্যাধুনিক চীনা অস্ত্র ব্যবহার করে, পাকিস্তান যদি ভারতের ইউরোপীয় আধুনিক অস্ত্রকে অকার্যকর করে ফেলে। তাহলে বৈশ্বিক প্রতিরক্ষা বাজারে চীনের গ্রহণযোগ্যতা ভীষনভাবে বাড়বে। রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র-ফ্রান্স নির্ভর অস্ত্রবাজারে চীন হবে একটি কম খরচে কার্যকর বিকল্প।

যুক্তরাষ্ট্র চায় না পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের এই ঘনিষ্ঠতা যুদ্ধের ময়দানে দৃশ্যমান হোক। কারণ এতে চীনের সঙ্গে অন্যান্য দেশ যেমন ইরান, মিয়ানমার, ইথিওপিয়া বা ভেনেজুয়েলার সম্পর্কও দৃঢ় হবে। যা অন্যান্য দেশকে প্রলুব্ধ করবে। যুক্তরাষ্ট্র চায়, দক্ষিণ এশিয়া হোক একটি "নিয়ন্ত্রিত জিও-পলিটিক্যাল জোন"। যেখানে সংঘাত থাকবে, কিন্তু তা যেন তার প্রতিপক্ষের জন্য বিজ্ঞাপন না হয়ে দাঁড়ায়।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে হারাতে চায় না। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মার্কিন সেনেট ও প্রশাসনের ভেতরে এমন একটি বাস্তব সংকট তৈরি হয়েছে। যেখানে একসঙ্গে ইউরোপ ও এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি ধরে রাখা কঠিন। যদি ভারত ক্ষুব্ধ হয়। তবে সে হয়তো রাশিয়ার দিকে আরও ঝুঁকবে, নয়তো চীনের সঙ্গে নতুন 'ব্রিকস প্লাস' গোষ্ঠীতে সক্রিয় ভূমিকা নিতে পারে। উভয় পথই যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক প্রভাবের জন্য হুমকি।

এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ থামাতে চায়, তবে এমনভাবে যেন কোনো পক্ষকেই একেবারে দায়ী বা ক্ষুব্ধ না করা হয়। তাদের বক্তব্যে তাই চীনের নাম নেই, নেই পশ্চিমা অস্ত্রনীতির সমালোচনা। তারা সামনে আনছে 'নিরপেক্ষ' শব্দ মানবিক বিপর্যয়, পারমাণবিক যুদ্ধের ভয়, সন্ত্রাসবাদের আশঙ্কা। এগুলোর আড়ালে যুক্তরাষ্ট্র মূলত চায়, তারা যেন পরবর্তী সময়ে বিশ্বকে বলতে পারে "আমরাই সংঘাত থামিয়েছিলাম"। এতে তারা একদিকে নৈতিক প্রভাব ধরে রাখতে পারবে, অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের সামরিক-রাজনৈতিক জয়ের সম্ভাবনাও রুদ্ধ হবে।

সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের উপগ্রহ প্রযুক্তি দিয়ে পাকিস্তানের বালুচিস্তানে সেনা চলাচল, চীন-সাপোর্টেড সামরিক সরঞ্জামের মুভমেন্ট ও সাইবার যুদ্ধের প্রস্তুতির আলামত ধরেছে। এমন রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন সামরিক বিশ্লেষণ সাইটে। পাকিস্তান-চীন ইন্টেলিজেন্স শেয়ারিং এখন আগের চেয়ে আরও গভীর। চীনের GPS বিকল্প Beidou পাকিস্তানের যুদ্ধজাহাজে অ্যাকটিভ আছে যা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি লাল সংকেত। GPS জ্যামিং করা গেলেও Beidou জ্যামিং করা ভারতের পক্ষে সম্ভব না।

এই সমস্ত উপাদান বিবেচনায় রেখে বোঝা যায়, যুক্তরাষ্ট্র যা বলছে তা শুধু "মানবিকতার" জন্য নয় বরং এটি একটি পরিপূর্ণ সামরিক, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্ট্র্যাটেজির প্রকাশ, যার মাধ্যমে তারা দক্ষিণ এশিয়ায় শক্তির ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়।

এশিয়া-কেন্দ্রিক পাওয়ার হাউজের উত্থান: একটি বি/পজ্জনক ভবিষ্যৎ

যুক্তরাষ্ট্র যদি ভারসাম্য রাখতে ব্যর্থ হয়, তবে পরিণতি হতে পারে:

১. চীন-রাশিয়া-ইরান একত্রে সামরিক ব্লক গঠন করবে, যেখানে পাকিস্তান ফ্রন্টলাইন পার্টনার হবে। উল্লেখ্য ইরান ড্রোন ও মিসাইল টেকনোলজিতে পৃথিবীর অন্যতম। একমাত্র তাদেরই আন্ডারগ্রাউন্ড সিটি আছে শুধু মিসাইল এবং ড্রোনের। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন ইরানে পঞ্চাশের বেশি সমরাস্ত্রের আন্ডারগ্রাউন্ড সিটি আছে।

২. ভারতে যুক্তরাষ্ট্র আস্থা হারাতে পারে, বিশেষ করে যদি যুদ্ধ শুরুর পরেও স্পষ্ট সমর্থন না আসে।

৩. যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বাজার চীনের কাছে হেরে যাবে, যেহেতু ব্যাটলফিল্ড-প্রমাণিত চীনা অস্ত্র। এছাড়া ‘কস্ট ইফেকটিভ’ তাই উন্নয়নশীল দেশ চীনের দিকেই ঝুকবে।

পরিশেষ :

এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র যা করছে, তা হলো ভারতকে শান্ত রাখা, পাকিস্তানকে আংশিক সহযোগিতার বার্তা দিয়ে চীন থেকে পুরোপুরি সরিয়ে রাখার চেষ্টা এবং চীনকে পরোক্ষভাবে বার্তা দেওয়া। যদি তুমি পাকিস্তানকে উসকে দাও, তবে ফলাফল বৈশ্বিক যুদ্ধেও গড়াতে পারে।

এই জটিলতার ভেতরেই যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ থামায় , কারণ একটি অঞ্চলিক যুদ্ধ চীনের অস্ত্রশক্তিকে বৈধতা দেবে এবং আমেরিকান প্রভাবকে ধাক্কা দেবে ভবিষ্যতের বহু ফ্রন্টে।

লেখক: ইতিহাস, রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক।