আইন-আদালত
দাঙ্গা উস্কে দেয়ায় যুক্তরাষ্ট্রকে ২২০০ কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে ইরানি আদালতের নির্দেশ
-
ইরানে ২০২২ সালে পশ্চিমা মদদে পরিচালিত দাঙ্গার একটি দৃশ্য
২০২২ সালে হত্যাকাণ্ড ও সহিংসতায় ভরপুর ভয়াবহ দাঙ্গা বাধাতে মদদ ও উস্কানি দেয়ার দায়ে তেহরানের একটি আদালত ক্ষতিপূরণ হিসেবে ইরানকে ২ হাজার দুইশ কোটি ডলারেরও বেশি অর্থ দিতে মার্কিন সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে।
আকস্মিক ওই দাঙ্গায় জড়িত থাকার দায়ে বস্তুগত, নৈতিক এবং শাস্তিমূলক ক্ষতিপূরণ হিসেবে মার্কিন সরকারকে এই অর্থ প্রদানের নির্দেশ দিয়েছে তেহরানের ওই আদালত।
ইরানের বিচার বিভাগের মুখপাত্র আসগার জাহাঙ্গির গতকাল (মঙ্গলবার) এক সংবাদ-সম্মেলনে বলেছেন দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত ৬০৭টি ইরানি পরিবারের দায়ের করা একটি মামলার তদন্তের পর এই রায় দিয়েছে তেহরানের ওই আদালত। ২০২২ সালের ওই দাঙ্গায় এই পরিবারগুলোর বহু সদস্য হতাহত হন।
"এই মামলার রায়টি ওই অস্থিরতা উস্কে দেয়া ও সমর্থন করার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালনকারী মার্কিন সরকার, ঊর্ধ্বতন আমেরিকান রাজনৈতিক ও সামরিক কর্মকর্তা, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিদের লক্ষ্য করে করা হয়েছে," বলে জনাব আসগার ব্যাখ্যা করেন।
শহীদ বেহেশতি বিচারালয় কমপ্লেক্সের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক দেওয়ানি আদালতের ৫৫ নম্বর শাখা থেকে ঘোষিত রায় অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইচ্ছাকৃতভাবে দাঙ্গাবাজদেরকে আর্থিক সম্পদ, উৎসাহ এবং বস্তুগত ও নৈতিক সমর্থন প্রদান করেছে, আদালত এই পদক্ষেপগুলোকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সার্বভৌমত্বের স্পষ্ট লঙ্ঘন এবং আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী বলে মনে করেছে।
আদালত বলেছে যে ওয়াশিংটনের কর্মকাণ্ড বাদীদের এবং তাদের পরিবারের উপর অপূরণীয় শারীরিক আঘাত, গুরুতর মানসিক ক্ষতি এবং ব্যাপক আর্থিক ও মানসিক ক্ষতি করেছে। এই রায়ে আদালত একাধিক ইরানি আইনি কাঠামোর প্রয়োগ করেছে যার মধ্যে রয়েছে সিভিল কোড (দেওয়ানিআইন), সিভিলদায়বদ্ধতা আইন, মার্কিন সরকারের হাতে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং আঞ্চলিক হঠকারি পদক্ষেপ মোকাবেলা সংক্রান্ত আইন, বিদেশী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জনগণের দাবির বিষয়ে এখতিয়ার প্রদানকারী আইন, মার্কিন সন্ত্রাসী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আইন এবং আমেরিকান কর্মকাণ্ডের ফলে সৃষ্ট ক্ষতির জন্য ক্ষতিপূরণ বাধ্যতামূলক করার বিধান ইত্যাদি।
২০২২ সালের ইরানের অস্থিরতা ঘটানো হয়েছে পূর্ববর্তী দশকগুলোতে ঘটানো ধারাবাহিক প্যাটার্ন অনুসরণ করে যেসভ ঘটনায় পশ্চিমা ও ইসরায়েলি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে জনসাধারণের বিক্ষোভকে সহিংসতায় রূপান্তরিত করা হয়েছিল।
দাঙ্গার অনুঘটকটি ছিল ২২ বছর বয়সী মাহসা আমিনির মৃত্যু যাকে পোশাকবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে নৈতিকতা নজরদারির টহল-পুলিশ দল আটক করেছিল। আমিনিকে তেহরানের একটি দিক-নির্দেশনামূলক বা সংশোধনকামী প্রশিক্ষণ স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হয়। স্টেশনের ফুটেজে দেখা যাচ্ছে যে তিনি একজন মহিলা অফিসারের কাছে হেঁটে যাচ্ছেন, তার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলছেন এবং অফিসার চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাচ্ছেন।
কয়েকদিন পর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আমিনী মারা যান অতীতের শারীরিক সমস্যার প্রভাবে তথা শৈশবে তার মস্তিষ্কের অস্ত্রোপচারজনিত দুর্বলতার কারণে। সরকারি তদন্তে নৈতিকতা-পুলিশের কোনও অপরাধ বা দোষের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আমিনির বাবার বিছানার পাশে-বসা ভিডিও সাক্ষ্য এবং তার ভাইয়ের ফোন কল রেকর্ড যেখানে তিনি "আবার অজ্ঞান হয়ে গেছেন" উল্লেখ করা হয়েছে-এইসব সাক্ষ্য-প্রমাণসহ নানা সাক্ষ্য-প্রমাণ যাচাই করে দেখা হয়েছে এ ব্যাপারে।
প্রাথমিকভাবে, তেহরানের বিক্ষোভগুলো নীতিগত টহল ইউনিটকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়েছিল, যা কর্তৃপক্ষ শেষ পর্যন্ত ভেঙে দেয়। কিন্তু পশ্চিমা ও ইসরায়েলি শক্তির সরাসরি হস্তক্ষেপে, যেমনটি পরে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সহিংস দাঙ্গা ছড়িয়ে দেয়া হয় ব্যাপক মাত্রায় যার ফলে নিরাপত্তা বাহিনীর ৭৫ জন কর্মীসহ কমপক্ষে ২০০ জন নিহত হয়।
সহিংসতার একটি মূল চালিকাশক্তি ছিল কতগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তথা সোশ্যাল মিডিয়ার প্রচারণা (প্রাথমিকভাবে মেটা-মালিকানাধীন ইনস্টাগ্রাম) যা পরিকল্পিতভাবে কিশোর ও তরুণদের লক্ষ্য করে তৈরি করা হয়েছিল - দাঙ্গার সময় তাদের বেশিরভাগকেই গ্রেপ্তার করা হয়। এই তরুণদের অনলাইনে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল কীভাবে ঘরে বসে বিস্ফোরক তৈরি করতে হয়, নিরাপত্তা বাহিনীর কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নিতে হয় এবং জনসাধারণের অবকাঠামোতে আগুন ধরিয়ে দিতে হয়।
সোশ্যাল মিডিয়া প্রচারণাটি ছিল একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রচেষ্টার অংশ যেখানে পশ্চিমা কর্মকর্তারা নিয়মিতভাবে দাবি করতেন যে তারা "ইরানি নারীদের পাশে আছেন"। তাদের মন্তব্যগুলো গাজায় সর্বশেষ ইসরায়েলি যুদ্ধের সাথে সাংঘর্ষিক ও পরিহাসমূলক হয়েছিল যেখানে চলমান গণহত্যায় ইহুদিবাদী ইসরায়েল ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে সম্পূর্ণ পশ্চিমা মদদে ৩০,০০০ এরও বেশি নারী ও মেয়েকে হত্যা করেছে। পশ্চিমা গণমাধ্যম এবং রাজনৈতিক নেতারাও গত দুই বছরে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার ধর্ষণের ঘটনার বিষয়ে নীরব রয়েছেন।
গত জুনে ইরানে ইসরায়েলি শাসকগোষ্ঠীর বোমা হামলার সময় পশ্চিমারা ইসরায়েলকে আবারও সমর্থন দিয়েছিল। এই আগ্রাসনের ফলে প্রায় ১,১০০ ইরানি নিহত হয়েছিল, যাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন নারী ও শিশু। #
পার্স টুডে/এমএএইচ/০৩
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।