জানুয়ারি ১৮, ২০২৪ ১৯:০০ Asia/Dhaka

সম্প্রতি ইরানের কুদস ফোর্সের সাবেক প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল কাসেম সোলাইমানির শাহাদাতের চতুর্থ বার্ষিকী পালিত হলো। এ সম্পর্কে রেডিও তেহরানের আলাপন অনুষ্ঠানে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং বর্তমানে লন্ডনের স্থানীয় সরকারের কর্মকর্তা শামস রহমান। তিনি বলেছেন, শহীদরা কখনও মরেন না, শহীদ জেনারেল কাসেম সুলাইমানি একইভাবে জীবিত। উনি ইরানিদের হিরো। উনি জেগে আছেন ইরানিসহ সবার মনে। শাহাদাতের পর ওনার ওপর ন্যাস্ত মিশন আরও বেগবান হয়েছে।

সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো। এটি গ্রহণ করেছেন সিরাজুল ইসলাম এবং উপস্থাপনা ও তৈরি করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।

রেডিও তেহরান: জনাব শামস রহমান, ইরানের কুদস ফোর্সের সাবেক প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল কাসেম সোলাইমানির শাহাদাতের চার বছর পার হলো। তবে এখনো মনে হয় তিনি আগের মতোই সমুজ্জ্বল। আপনার মুল্যায়ন কী?

শামস রহমান: সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর। তাঁর রসুলের প্রতি দরুদ এবং আপনার ও আপনার শ্রোতাদের সালাম জানিয়ে আমার বক্তব্য শুরু করছি। দেখুন, শহীদরা কখনও মরেনা বরং তাঁরা জীবিত এবং আল্লাহর কাছ থেকে রিযিক পেয়ে থাকে। শহীদ কাসেম সুলাইমানিও একইভাবে জীবিত। বরং তার শাহাদাতের মাধ্যমে তাঁর ওপর ন্যাস্ত মিশন আরও বেগবান হয়ে উঠেছে।

আমি এখানে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দু একটা কথা বলতে চাই। দেখুন, আমরাও কিন্তু বাংলাদেশে শহীদদেরকে সম্মান করি কিন্তু আমার কাছে মনে হয় কেন জানি ইরানিরা শাহাদাতকে আরও বেশি প্রাধান্য দেয়, তাঁরা শাহাদাতকে লালন-পালন করে। আর এ বিষয়ে আমি দুটো ঘটনা বলব।

আমি অনেক দিন থেকে শিয়া মতবাদ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছি। সুযোগ পেলেই তাঁদের মজলিসে আমি মাঝেমধ্যে যাই। ইউটিউবেও তাঁদের বক্তাদের লেকচার আমি শুনি। তাঁদের আলোচনা যে বিষয়েই হোক না কেন প্রায়শ তারা একটা কাজ করে। সেটি হচ্ছে-আলোচনা তাঁরা শেষ করে কারবালা দিয়ে। আর যদি সময় থাকে দুই একমিনিট তাহলে ইমাম হোসাইন (আ.) এর স্মরণে কান্নাকাটি করে এবং বুক চাপড়ায়। তো দেখুন তাঁরা কীভাবে ইমাম হুসাইন আ. শাহাদাতকে লালন পালন করে আসছে। তাঁরা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই এটি ব্যবহার করে।

একটি বাস্তব উদাহরণ হচ্ছে-১৯৭৯ সালে যখন ইরানে ইসলামি বিপ্লব হলো তখন তারা বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশ থেকে ইসলামি প্রতিনিধিদের দাওয়াত দিয়েছিলেন ইসলামি বিপ্লব দেখার জন্য। যতটুকু মনে পড়ে হাফেজ্জী হুজুরের নেতৃত্বে একটি দল ইরানে গিয়েছিলেন। সেখানে মাওলানা তাহের নামে আমাদের এক ভাই ছিলেন। তাঁদেরকে ইরানের বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হলো। তারমধ্যে একটি জায়গা হচ্ছে বেহেশেতে যাহরা। সেটি কবরস্থান। সেখানে শহীদরাসহ সাধারণ মানুষের কবর দেয়া হয়। ওখানে তাহের ভাই দেখলেন-ওনাদের থেকে দূরে একটি কবরের পাশে দাঁড়িয়ে একজন মহিলা কান্নাকাটি করছেন। তো দোভাষীর মাধ্যমে তাহের ভাই জানতে পারলেন ঐ মহিলার সন্তান ইসলামের বিপ্লবের সময় শহীদ হয়েছে। তাহের ভাই আলেম মানুষ, মন নরম উনি মহিলার কাছে গিয়ে ভাঙা ভাঙা ফার্সিতে বললেন দেখ তোমার ছেলে তো উচ্চা মাকামে আছে তুমি তাঁর জন্য আর কান্নাকাটি করোনা। তখন ঐ মহিলা ক্ষেপে গিয়ে বললেন, তুমি কি মনে করো আমি আমার ছেলের জন্য জন্য কাঁদছি! আমি কাঁদছি আমি কেন আমার ছেলের মতো শহীদ হতে পারলাম না সেই জন্য। এই গল্পটা বললাম এইজন্য যে, তাঁরা শাহাদাতকে কত উঁচু চোখে দেখে। একইভাবে শহীদ কাসেম সুলাইমানির ব্যাপারটাও তাই। উনি ছিলেন ইরানিদের হিরো। উনি শহীদ হয়েছেন এবং তিনি ইরানিদের মনেপ্রাণে আজও জেগে আছেন। তাঁর মিশন আরও বেগবান হয়েছে বলে আমরা দেখতে পাচ্ছি।

রেডিও তেহরান: জি জনাব শামস রহমান,   আল-কুদস মুক্ত করার লড়াই-সংগ্রাম জোরদার করার বিশেষ দায়িত্ব ছিল জেনারেল সোলাইমানির ওপর। প্রশ্ন হচ্ছে- তাকে শহীদ করার মধ্যদিয়ে কী শত্রুরা সেই সংগ্রাম বন্ধ করতে বা তাতে নেতিবাচক কোনো প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে?

শহীদ জেনারেল কাসেম সোলাইমানি

শামস রহমান: দেখুন, আমি যদি এককথায় আপনার প্রশ্নের উত্তর দেই তাহলে সেটি হবে 'না'। ওরা বন্ধ করতে পারেনি। শহীদ কাসেম সোলাইমানির মিশন আরো জোরেশোরে চলছে।

রেডিও তেহরান: এই যে বললেন এককথায় সুলাইমানিকে শহীদ করার মধ্য দিয়ে শক্ররা আল কুদস মুক্ত করার সংগ্রাম বন্ধ করতে পারেনি। এ বিষয়ে আপনি কি আর কিছু বলবেন?

শামস রহমান: এ ব্যাপারে আমি দুয়েকটা কথা বলতে চাই। দেখুন, মধ্যপ্রাচ্যে তেল বলি, এ বলি ও বলি-যত গন্ডোগোল হচ্ছে তার মূল কারণ হচ্ছে আল কুদসের মালিকানা। আপনি খেয়াল করে দেখবেন যে আরব মুসলিম বিশ্বের সকল রাজা বাদশাদেরকে শক্ররা কিনে ফেলেছে পয়সার বিনিময়ে হোক বা অন্য যেকোনোভাবে হোক। আর এই রাজা বাদশারা কেন যেন ইসরাইলকে খুব বেশি পছন্দ করে এবং তাদেরকে খুব  খোলামেলা সাপোর্ট করে। একটা মাত্র আরব রাষ্ট্র সেই সাপোর্ট করত না সেটা হচ্ছে সিরিয়া। সেই সিরিয়াকে অস্থিতিশীল করার জন্য আইএসআই নামে একটা  একটি জঙ্গি সংগঠন তৈরি করল। নাম দিল  ফ্রি সিরিয়ান আর্মি। আর তারা বাসার আল আসাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করল। কাসেম সুলাইমানি যদিও আল কুদস মুক্ত করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কিন্তু তাঁর প্রথম কাজ ছিল সিরিয়া থেকে আইএসআইএস থেকে মুক্ত করা হয়। উনি আল্লাহর রহমতে সেটি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। শুধু তাই না আইএসআইএসকে নির্মূল করার পথে তিনি রাশিয়ার মতো বিরাট এক পরাশক্তিকে মুসলমানদের বন্ধু বানিয়ে ফেললেন।

আশির দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর যখন কোল্ড ওয়ার শেষ হয়ে গেল তখন রাশিয়া ধীরে ধীরে খুব দুর্বল একটা রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে গেল। কিন্তু কাসেম সুলাইমানির সাথে সখ্যতার মাধ্যমে রাশিয়া কিন্তু আস্তে আস্তে বিরাট একটা অবস্থানে চলে আসে। বলা চলে রাশিয়া তার শক্তি ফেরত পেয়েছে। তো আসলে সব মিলিয়ে দেখলে কাসেম সুলাইমানিকে হত্যা করে শক্রদের আসলে ক্ষতিই হয়েছে। এই মিশনটা আরো জোরেশোরে মুভ করছে। সেটা আমরা সর্বত্র দেখতে পাচ্ছি।

রেডিও তেহরান: আবারও ফিরে এলাম সাক্ষাৎকারে। জনাব শামস রহমান,  জেনারেল সোলাইমানিকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এরইমধ্যে তিনি দ্বিতীয় মেয়াদের নির্বাচনে হেরেছেন এবং তার আগে পরে নানা ঘটনায় তিনি অপমানিত হয়েছেন। অন্যদিকে, জেনারেল সোলাইমানি কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে স্থান করে আছেন। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?

শামস রহমান: খুব একটা প্রশ্ন করেছেন। দেখুন, ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্সিয়াল ইলেকশনে হেরেছে। শুধু তাই না সে ছোটখাট একটা ক্যু করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু আমেরিকায় ক্যু কখনও সফল হয়নি। তারপর থেকে তার বিরুদ্ধে অনেক মামলা মকদ্দমা হচ্ছে। এমনও হতে পারে সে জেলে যেতে পারে। হয়তো সে আর নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবে না। তার বিরুদ্ধে অলরেডি দুটো স্টেট বলে দিয়েছে যে সে নির্বাচন করতে পারবে না।

আপনার যদি খেয়াল থাকে শহীদ জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার প্রতিশোধ হিসাবে ইরান-ইরাকে অবস্থিত একটা মার্কিন বেসকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল। মেইন স্ট্রিম নিউজে এই খবরটা কিন্তু সেভাবে আসেনি। ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে মার্কিন বেজকে ধ্বংস করা ছিল ইরানের খুব বড় একটা সফলতা। দেখুন, কাসেম সোলাইমানির শহীদ হওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা অনেকেই তাঁর নাম জানতাম না। আমরা জানলাম তাঁর শাহাদাতের পর। তো কাসেম সুলাাইমানি শিয়া সম্প্রদায়ের কাছে তো বটেই যাঁরা মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে একটু জ্ঞান রাখেন তাঁদের কাছে কাসেম সুলাইমানি একটা জনপ্রিয় নাম। তাঁরমতো একজন জেনারেল কীভাবে যে এত নিঁখুত সুন্দরভাবে কাজ করতেন।তাঁর আচার আচরণ, কথাবার্তায় মনে হতো যেন আপনার একজন খুব কাছের মানুষ। তো আল্লাহ যেন আমাকে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করার তৌফিক দেন পরকালে।

রেডিও তেহরান: তো জনাব শামস রহমান। শহীদ জেনারেল কাসেম সোলাইমানির শাহাদাত বার্ষিকী সম্পর্কে রেডিও তেহরানের সাথে কথা বলার জন্য আপনাকে আবারও অশেষ ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

শামস রহমান: আপনাকে ধন্যবাদ।

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/১৮

ট্যাগ