স্মরণীয় ইতিহাস-ঐতিহ্য
ইরানের বিশ্ব-বিশ্রুত মনীষী আল-বিরুনি: ইরানি জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অন্যতম পথিকৃৎ
-
ইরানের বিশ্ব-বিশ্রুত মনীষী আবু রায়হান আল বিরুনির একটি কল্পিত প্রতিকৃতি
পার্স টুডে - ইতিহাস জুড়ে, ইরানিরা বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞান ও জ্ঞানের অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। প্রাচীনকাল থেকে ইসলামী যুগ পর্যন্ত, ইরানি বিজ্ঞানীরা গণিত, চিকিৎসা, জ্যোতির্বিদ্যা, রসায়ন, দর্শন এবং প্রকৌশলের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছেন, যার মধ্যে অনেকেই আজকের আধুনিক বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতা।
ইরানের বিশ্ব-বিশ্রুত মনীষী আবু রায়হান আল বিরুনি বিশ্ব-নন্দিত বিজ্ঞানী হিসেবে ইরান ও মুসলিম বিশ্বের গর্ব। বিরুনি ৩৬২ হিজরিতে (৯৭৩ খ্রিস্টাব্দ) খাওয়ারেজমের (বৃহত্তর ইরান) রাজধানী কাথ শহরে জন্মগ্রহণ করেন এবং তাঁর জীবদ্দশায় তিনি তাঁর সময়ের বহুমুখি প্রতিভার অধিকারী সবচেয়ে বড় পণ্ডিতদের একজন হয়ে ওঠেন।
আল-বিরুনি গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, ভূগোল, পদার্থবিদ্যা, ইতিহাস, ঔষধবিদ্যা, নৃবিজ্ঞান এবং ভাষাবিজ্ঞানের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে গবেষণা করেছেন এবং অনেক মূল্যবান বই রেখে গেছেন।
আবু রায়হান বিরুনির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে একটি ছিল তার বৈজ্ঞানিক এবং পরীক্ষামূলক পদ্ধতি। তিনিই প্রথম পাহাড়ের উচ্চতার সঙ্গে যুক্ত কোণ পরিমাপ করে পৃথিবীর ব্যাসার্ধ গণনা করেছিলেন; আর এই পরিমাপ থেকে যে সংখ্যা বেরিয়ে এসেছে তা আজকের নাসার আধুনিক পরিমাপ থেকে মাত্র ১৭ কিলোমিটারের পার্থক্য। আজ থেকে এক হাজার বছর আগে হিজরী চতুর্থ শতকে এই নির্ভুলতা বেশ বিস্ময়কর ও অতুলনীয়।
বিরুনির সবচেয়ে সাড়া-জাগানো বইগুলোর মধ্যে ‘আসার আল বাকিয়া’ অন্যতম। এটি বহু বছর আগে ইউরোপে অনূদিত হয়েছে। বিশ্ব-ইতিহাস বিষয়ে এ বইটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বই হিসেবে বিবেচিত হয়। গবেষকরা মনে করেন, আমরা যদি নানা জাতির পরিচিতি ও ইতিহাস বিষয়ে বিরুনির গবেষণাগুলোকে উপেক্ষা করি, তবুও ইতিহাস বিষয়ে বিরুনির কেবল এই একটি বইই সমসাময়িক যুগের নানা জ্ঞান-বিজ্ঞানে বিরুনির চিন্তাধারার গভীরতার সাক্ষ্য তুলে ধরার জন্য যথেষ্ট হত।
‘আসার আল বাকিয়া’ নামক বইটিতে আলবিরুনি নানা জাতির বিশ্বাস, প্রথা ও সম্প্রদায় এবং তাদের মধ্যকার নানা মিল ও অমিল নিয়ে আলোচনা করেছেন।
আলবিরুনির আরেকটি অমর বই হল ভারতীয় জাতিগুলোর পরিচিতিমূলক বই ‘তাহকিক মালাল আল হিন্দ’। এ বইটি সমাজবিজ্ঞানে মুসলিম গবেষকদের বিস্ময়কর অগ্রগতির স্বাক্ষর বহন করছে। সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে তাদের এই দক্ষতা গড়ে উঠেছিল নানা দেশ সফরের সুবাদে। বিরুনি এই বইয়ে জ্যোতির্বিদ্যা ও গণিত বিষয়ে ভারতীয়দের মতামত এবং হিন্দুদের নানা ধর্ম-বিশ্বাসের পাশাপাশি ভারতের ভৌগলিক ও ভূতাত্ত্বিক নানা বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন। অনেকেই মনে করেন যে অতীত দিনের পশ্চিমা পণ্ডিতরা মূলত এ বইয়ের মাধ্যমেই ভারত সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। বিরুনির এই বই ভারতীয়দের ধর্ম, প্রথা, ইতিহাস ও নানা জ্ঞান সম্পর্কে বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত বই হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই বিরুনিকে তুলনামূলক নৃতত্বের অগ্রপথিকও বলা যায়।
আলবিরুনির আরেকটি অমর বই হল কানুনে মাসুদি। বইটির বিষয়বস্তু হল জ্যোতির্বিদ্যা, ভূগোল ও গণিত। এ বইয়ের রয়েছে ১১টি অধ্যায়। বইটি মুসলিম জ্যোতির্বিদদের সুস্পষ্ট অগ্রগতির সাক্ষ্য বহন করছে। এ বইয়ে গ্রহ-নক্ষত্রের জটিল গতিবিধি তুলে ধরেছেন আল বিরুনি। এ বইয়ে বিরুনি তার উদ্ভাবিত ত্রিকোণমিতির নানা সূত্র তুলে ধেরেছেন। এ বইটিকে আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান ভিত্তিও বলা যায়।
আবু রায়হান বিরুনি সম্পর্কে এটাও বলা হয়ে থাকে যে তিনি পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কথাও বলে গেছেন। তিনি বলেছেন যে এই শক্তির আকর্ষণ বা টানের কারণেই পৃথিবীর বাতাসে নিক্ষিপ্ত বস্তু মহাবিশ্বে ছিটকে পড়ে না ও পৃথিবীর কোনো স্থির বস্তুও মহাশূন্যে পড়ে যায় না।
আল-বিরুনির এই বক্তব্যের শত শত বছর পর নিউটন আপেল পড়ার ঘটনা থেকে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বিষয়টি উপলব্ধি করেন। বিরুনি পশ্চিমা বিজ্ঞানী কোপার্নিক ও গ্যালিলিও’র শত শত বছর আগে সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর ঘূর্ণনের কথা বলে গেছেন।
আল-বিরুনি সন ও তারিখের গণনা তথা পঞ্জিকার গণনায়ও সংস্কার এনেছিলেন। তার সংস্কার-করা পঞ্জিকা ছিল ছয়শত বছর পরে পোপ গ্রেগরির সংস্কার-করা পঞ্জিকার চেয়েও বেশি উন্নত ও শুদ্ধ। তিনি সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর ঘূর্ণন ও নিজ অক্ষকেন্দ্রীক পৃথিবীর ঘূর্ণন,পৃথিবীর গোলাকার হওয়া ও বার্ষিক গতির কথা বলে গেছেন কোপার্নিক,কেপলার ও নিউটনের মত পশ্চিমা বিজ্ঞানীদের ছয়শত বছর আগেই! গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যাসহ বিজ্ঞানের নানা বিষয়ের ওপর অভিধান বা সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যার বইও লিখে গেছেন আলবিরুনি। পরবর্তীকালে তার সেই বই সব সময়ই ব্যবহার করেছেন পশ্চিমা পণ্ডিতরা।
আল-বিরুনি জ্যামিতিক গুণোত্তর ধারার যোগফল গণনার পদ্ধতিসহ নানা ধরনের পরিমাপ পদ্ধতি ও ফোয়ারার পানি উত্তোলন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি পৃথিবীর ব্যাসার্ধ ও সমভূমির বরাবরে সূর্যের অক্ষকেন্দ্রীক কোনের পরিমাপ করেছেন আজ হতে প্রায় হাজার বছর আগে যখন আধুনিক পরিমাপ যন্ত্র বলতে কিছুই ছিল না। বিরুনির হিসেবে সমভূমির বরাবরে সূর্যের অক্ষকেন্দ্রীক কোনের পরিমাপ হয়েছিল ২৩ ডিগ্রি ৩৫ মিনিট। আর আধুনিক পদ্ধতিতে এর পরিমাপ হল ২৩ ডিগ্রি ২৭ মিনিট। বিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্রে এতসব অমূল্য অবদানের জন্য আলবিরুনিকে বলা হয় আধুনিক যুগের মানুষ।
তিনি ফার্সি, আরবি, সংস্কৃত, গ্রীক ও হিব্রু ভাষায় সাবলীল ছিলেন এবং তাঁর রচনায় তিনি বিভিন্ন জাতির বিশ্বাস ও জ্ঞানকে নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে পরীক্ষা করার চেষ্টা করেছিলেন। আবু রায়হানের এই বৈজ্ঞানিক ও মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই তাকে "নৃবিজ্ঞানের জনক" বলে অভিহিত করা হয়।
আল-বিরুনির জ্ঞান, নির্ভুলতা এবং উন্নতমানের গবেষণা পদ্ধতি ও বিশুদ্ধতাকামী মনোভাব তাকে কেবল ইরানের নয়, একইসঙ্গে গোটা বিশ্বের বৈজ্ঞানিক গর্বের প্রতীক করে তুলেছে। তার বইগুলো এখনও বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে অধ্যয়ন করা হয়। ফলে জ্ঞান বিজ্ঞানের ইতিহাসে তার নাম অমর হয়ে আছে।
অন্য কথায় বিরুনি হলেন একাধারে আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা পদ্ধতির অগ্রপথিক, "নৃবিজ্ঞানের জনক" ও বিশ্ব-ইতিহাসে সর্বকালের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী।
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা এবং গ্রেট সোভিয়েত এনসাইক্লোপিডিয়ার মতো মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক বিশ্বকোষগুলিতে, বিরুনিকে সর্বকালের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় এবং বৈজ্ঞানিক কেন্দ্রগুলোর জন্য বিরুনি অনুপ্রেরণার উৎস:
আবু রায়হান বিরুনির নাম বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়, গ্রন্থাগার এবং বৈজ্ঞানিক কেন্দ্রগুলোতে লিখিতভাবে রেকর্ড করা আছে। কিছু দেশ তাকে "চিরজীবন্ত অধ্যাপক" উপাধিতে চেনে এবং তার কাজ এখনও জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, ইতিহাস এবং দর্শনের মতো ক্ষেত্রে পড়ানো হয়।
আন্তঃসাংস্কৃতিক বৈজ্ঞানিক সংলাপের প্রতীক:
আল-বিরুনি, ফার্সি, আরবি, সংস্কৃত, গ্রীক, হিব্রু এবং সিরিয়াক ভাষায় তার দক্ষতার মাধ্যমে বিভিন্ন সভ্যতার মধ্যে একটি সেতুবন্ধন তৈরি করেছিলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন যে বিজ্ঞান দেশ ও জাতির সীমানা এবং ধর্মমত ও নানা বিশ্বাস অতিক্রম করে মানুষকে একত্রিত করতে পারে।
আল-বিরুনি তাঁর পরবর্তী যুগের বৈজ্ঞানিক প্রজন্মগুলোর জন্যও প্রেরণার অনন্ত উৎস। তিনি সত্য ও বাস্তবতার বিষয়ে নিখুঁত-প্রবণতা, সততা, আন্তরিকতা ও সম্মানের প্রতীক যা বর্তমান বিশ্বেও বেশ জরুরি।
আবু রায়হান আল-বিরুনি তার জীবনের একটি বড় অংশ গজনির সুলতানের দরবারে কাটিয়েছিলেন এবং গজনীর সুলতান মাহমুদের সাথে ভারত ভ্রমণ করেছিলেন। তিনি ৪৪০ হিজরীতে গজনী শহরে মারা যান এবং তাঁর সমাধি সেখানেই অবস্থিত।#
পার্স টুডে/এমএএইচ/০৪
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।
কাজ চলছে