ডিসকভার ইরান:
ফার্স: ইরানের গোলাপরাজ্য- যেখানে ঘ্রাণ, ঐতিহ্য ও পর্যটন একসাথে ফোটে
পার্সটুডে: প্রতি বসন্তে সূর্যের উষ্ণ কিরণ যখন ইরানের ফার্সের সমতল ভূমিকে আলিঙ্গন করে, তখন এই প্রদেশটি যেন এক বিশাল গোলাপের সমুদ্রে পরিণত হয়। এখানকার রঙিন দামাস্ক গোলাপের বাগান শুধু চোখকে মুগ্ধ করে না, বরং শতাব্দী প্রাচীন চাষাবাদ ও পাতনের ঐতিহ্য—ফুলের ঘ্রাণকে একাধারে নান্দনিক শিল্প ও জীবিকার উৎসে পরিণত করেছে।
দক্ষিণ ইরানের এই প্রদেশে ৮,৬০০ হেক্টরের বৃষ্টি-নির্ভর ও সেচকৃত গোলাপ ক্ষেত রয়েছে, যা দেশের মোট গোলাপ চাষের প্রায় ৪৬ শতাংশের সমান। বিশেষজ্ঞদের মতে, ফার্স ইরানের প্রধান রোজা দামাস্ক (দামাস্ক গোলাপ) উৎপাদক, যেখানে উপযুক্ত জলবায়ু এবং গ্রামীণ ও উপজাতি সম্প্রদায়ের কৃষি জ্ঞান এই ঐতিহ্যকে শক্তিশালী করছে।
প্রদেশের ৩৭ জেলার মধ্যে ১৮টিতে গোলাপ চাষ হয়। তবে দারাব ও মেইমান্দ সবচেয়ে বড় এবং উৎপাদনশীল এলাকা হিসেবে পরিচিত। শিরাজ থেকে ২৪৫ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত দারাব জেলায় ৫,১০০ হেক্টর বৃষ্টিনির্ভর গোলাপ বাগান এবং ৫০০ হেক্টর সেচযুক্ত বাগান রয়েছে, যা এটিকে বিশ্বের বৃহত্তম বৃষ্টিনির্ভর ডামাস্ক গোলাপের সমতলভূমির একটিতে পরিণত করেছে।
জেলার কৃষি জিহাদ অফিসের প্রধান হাবিবুল্লাহ ফাতেহির মতে, চাষকৃত এলাকা এবং উৎপাদনের পরিমাণ উভয় ক্ষেত্রেই দারাব দেশব্যাপী প্রথম স্থান অধিকার করেছে।
প্রতি বছর এখানে ৭,০০০ টনেরও বেশি পাপড়ি এবং কুঁচি সংগ্রহ করা হয়, যার ৭০ শতাংশ শুকনো পাপড়ি হিসেবে বিক্রি হয়। দারাবের ২,৫০০-এর বেশি পরিবার এই গোলাপ চাষ ও প্রক্রিয়াকরণ থেকে জীবিকা নির্বাহ করে। অন্যান্য গোলাপ উৎপাদনকারী জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে ফিরোজাবাদ, এগুলিদ, নেইরিজ, বাভানাত, এসতাহবান, শিরাজ এবং খোররামবিদ। এর মধ্যে, ফিরোজাবাদে প্রদেশের বৃহত্তম সেচযুক্ত গোলাপ ক্ষেত রয়েছে, যা ১,৯৬০ হেক্টরজুড়ে বিস্তৃত, যার ৮২ শতাংশই মেইমান্দে অবস্থিত। এটি শিরাজ থেকে ৯৫ কিলোমিটার এবং ফিরোজাবাদ থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি শহর।
মেইমান্দ, ইরানের গোলাপজল রাজধানী হিসেবে পরিচিত। এখানে ১১০টিরও বেশি সক্রিয় ওয়ার্কশপ রয়েছে, যা প্রতি বছর ২৫ মিলিয়ন লিটারেরও বেশি গোলাপজল ও ভেষজ বাষ্পীভবনজাত তরল (ডিস্টিলেট) উৎপাদন করে।
ফিরোজাবাদের কৃষি অফিসের প্রধান সাইয়্যেদ কাজেম মুসাভি'র মতে, মেইমান্দ থেকে ৩০০ টনেরও বেশি গোলাপজল যুক্তরাজ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত ও আফগানিস্তানে রপ্তানি করা হয়।
ফার্সের গোলাপ উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণ শিল্প শুধু আঞ্চলিক নয়, এটি দেশের অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। কৃষি বিশেষজ্ঞরা জানান, ইরানে ৩১,০০০ হেক্টর জমিতে দামাস্ক গোলাপ চাষ করা হয়, যা বছরে প্রায় ৬৮,০০০ টন ফুল উৎপাদন করে। কিছু এলাকায় প্রতি হেক্টর উৎপাদন ছয় টনেরও বেশি, যা ইরানকে বিশ্বের প্রধান গোলাপজল ও শুকনো গোলাপ কুঁচি রপ্তানিকারক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
গোলাপ উৎসব
প্রতি বসন্তে ফার্স এক অনন্য ঋতুবিশেষ আয়োজন করে—দামাস্ক গোলাপ উৎসব। এই উৎসব শুধু ফুল কাটার মৌসুম নয়; এটি চাষাবাদ, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির মিলনস্থল। মেইমান্দ এবং শিরাজের আশেপাশের বাগানগুলোতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত দর্শকরা গোলাপ তোলার আনন্দ অনুভব করে এবং তামার বড় পাত্রে ঐতিহ্যবাহী গোলাপজল বিশ্রাবণ প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়।
স্থানীয় বাজারে তাজা গোলাপজল, হার্বাল বিশ্রাবণ এবং হস্তশিল্পের বিক্রি হয়। সঙ্গে থাকে জীবনমুখী সঙ্গীত ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, যা উৎসবকে এক সম্পূর্ণ অভিজ্ঞতা বানায়। ফার্সের গোলাপ উৎসব কেবল একটি প্রাকৃতিক আয়োজন নয়, এটি মানুষের ভূমির সঙ্গে গভীর সংযোগ, প্রাচীন জ্ঞান এবং সম্প্রদায়ের গর্ব উদযাপনের প্রতীক।
গোলাপের সুগন্ধ, মানুষের শিল্প ও ঐতিহ্য—সব মিলিয়ে ফার্স আজ কৃষি ও সাংস্কৃতিক শক্তি হিসেবে বিকশিত হচ্ছে। এটি প্রমাণ করে, যেখানে ফুল ফোটে, সেখানে ঐতিহ্য ও অর্থনীতিও সমানভাবে বিকশিত হয়।#
পার্সটুডে/এমএআর/১৮