ঘনিয়ে এলো নির্বাচন: কে হতে পারেন ইরানের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট?
ড. সোহেল আহম্মেদ: আগামী ১৮ জুন শুক্রবার ইরানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। দেশজুড়ে এখন সম্ভাব্য প্রার্থীদের নিয়ে জল্পনা চলছে। ইরানে মূলত দু'টি রাজনৈতিক ধারা সক্রিয় রয়েছে। একটি 'রক্ষণশীল' আর অপরটি 'সংস্কারকামী' নামে পরিচিত। দুই পক্ষেরই নানা প্রার্থীর নাম শোনা যাচ্ছে।
ইরানের পত্রপত্রিকায় এ পর্যন্ত অর্ধশতাধিক সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম এসেছে। তবে শেষ পর্যন্ত প্রার্থী হিসেবে ক'জন নাম নিবন্ধন করবেন তা এখনও স্পষ্ট নয়। নিবন্ধনের পর যাচাই-বাছাই শেষ হলে চূড়ান্ত প্রার্থীদের নাম জানা যাবে। ইরানের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান গার্ডিয়ান কাউন্সিল বা অভিভাবক পরিষদ প্রার্থী যাচাই-বাছাইয়ের মূল দায়িত্ব পালন করে। সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকা সামনে আসায় তারা নিশ্চয় প্রাথমিক কাজ শুরু করে দিয়েছে। ইরানের সংবিধানে বর্ণিত প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ও সক্ষমতার মানদণ্ডে প্রার্থীদের যাচাই-বাছাই করা হয়। এরপর তুলনামূলক নিখুঁত প্রার্থীদেরকে জনগণের সামনে উপস্থাপনের চেষ্টা করে এই প্রতিষ্ঠান। এ কারণে নাম নিবন্ধনই শেষ কথা নয়। চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকায় নাম উঠাতে অভিভাবক পরিষদের অনুমোদন প্রাপ্তি বাধ্যতামূলক।
গার্ডিয়ান কাউন্সিল বা অভিভাবক পরিষদ এমন প্রার্থীকে জনগণের সামনে উপস্থাপনের চেষ্টা চালায় যারা পরবর্তীতে ইসলামী বিপ্লব ও বিদ্যমান গণতন্ত্রের জন্য হুমকি হয়ে উঠবে না। ইসলামী বিপ্লব পরবর্তী একটি তিক্ত অভিজ্ঞতা আজও গোটা জাতিকে এ বিষয়ে সতর্ক সংকেত দিয়ে যায়। ১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লব সফল হওয়ার পর প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হন আবুল হাসান বানি সাদ্র। কিন্তু প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি বিপ্লবী আদর্শে অটল থাকতে পারেননি। বিপ্লববিরোধী চক্রের স্বার্থ রক্ষায় সোচ্চার হন। ইরানের ইসলামী বিপ্লবের ঘোর শত্রু নিষিদ্ধ সংগঠন এমকেও'র সঙ্গে তার যোগসাজশ ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে পড়ে। সে সময় ইরান-ইরাক যুদ্ধ চলছিল। সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়কের দায়িত্বও তাকে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রেও তার মধ্যে আন্তরিকতার অভাব পরিলক্ষিত হয়। বিলাসিতার মতো বিপ্লবের চেতনাবিরোধী নানা দোষ বানি সাদ্রের মধ্যে প্রবল হয়ে দেখা দেয়। এর ফলে ১৯৮১ সালের জুনে বানি সাদ্রকে প্রথমে সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়কের পদ থেকে সরিয়ে দেন ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের তৎকালীন সর্বোচ্চ নেতা ইমাম খোমেনী (রহ.) এবং পরবর্তীতে জাতীয় সংসদ তাকে প্রেসিডেন্টের পদের জন্যও অযোগ্য ঘোষণা করে। এক পর্যায়ে তিনি ইরান থেকে পালিয়ে যান। এরপর প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন মোহাম্মাদ আলী রাজায়ি। এক মাসের মাথায় তাকে হত্যা করে বানি সাদ্রের ঘনিষ্ঠ নিষিদ্ধ সংগঠন এমকেও। এই ছিল ইরানের প্রথম প্রেসিডেন্ট সংক্রান্ত তিক্ত ইতিহাস। প্রথম প্রেসিডেন্ট গোটা জাতির বহু বছরের সাধনার ফসল ইসলামী বিপ্লবকে প্রায় অঙ্কুরেই বিনাশ করে দিয়েছিলেন। ঐ ঘটনার পর ইরানে প্রার্থী বাছাইয়ে স্পর্শকাতরতা বেড়েছে।
২০২১ সালের আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকায় যাদের নাম রয়েছে তাদের কয়েকজন হলেন বর্তমান ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট ইসহাক জাহাঙ্গিরি, বিচার বিভাগের প্রধান সাইয়্যেদ ইব্রাহিম রায়িসি, সাবেক সংসদ স্পিকার আলী লারিজানি, ইরানের জ্বালানী বিষয়ক সংসদীয় কমিশনের প্রধান ফেরেইদুন আব্বাসি, তেহরান সিটি কাউন্সিলের প্রধান মোহসেন হাশেমি, ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি'র সাবেক কমান্ডার মোহসেন রেজায়ি।
ইসহাক জাহাঙ্গিরি সংস্কারপন্থী ধারার একজন সম্ভাব্য প্রার্থী। টানা আট বছর ধরে ইরানের ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মাদ খাতামির আমলে আট বছর মন্ত্রী ছিলেন। ইস্ফাহান প্রদেশের গভর্নর হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। এক সময় প্রভাবশালী সংসদ সদস্য হিসেবেও ভূমিকা রেখেছেন। ২০১৭ সালের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হলেও শেষ মুহূর্তে হাসান রুহানির প্রতি সমর্থন জানিয়ে সরে দাঁড়ান। ঐ নির্বাচনে রক্ষণশীল ধারার মূল প্রার্থী ইব্রাহিম রায়িসিকে পরাজিত করে প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হন হাসান রুহানি।
এ বছরের নির্বাচনেও রক্ষণশীল ধারার প্রধান প্রার্থী হয়ে উঠতে পারেন সাইয়্যেদ ইব্রাহিম রায়িসি। বর্তমানে ইরানের বিচার বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এই বিজ্ঞ আলেম। এর আগে ইরানের প্রসিকিউটর জেনারেলের দায়িত্বে ছিলেন। টানা ১০ বিচার বিভাগের উপ-প্রধান হিসেবে কাজ করেছেন। জাতীয় নিরীক্ষণ দপ্তরের চেয়ারম্যান ছিলেন। দুই বছর আগে বিচার বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি এমন কিছু বিপ্লবী পদক্ষেপ নিয়েছেন যা গোটা দেশেই আলোড়ন তুলেছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কারণে আগের চেয়ে তার ভাবমর্যাদা ও জনপ্রিয়তা বেড়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। তিনি ইরানের বিশেষজ্ঞ পরিষদ বা অ্যাসেম্বলি অব এক্সপার্টেরও সদস্য। গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তার প্রতি সমর্থন জানিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন রক্ষণশীল ধারার আরেক প্রভাবশালী প্রার্থী বাকের কলিবফ। তিনি এখন ইরানের জাতীয় সংসদের স্পিকার।
আরেক সম্ভাব্য প্রার্থী হচ্ছেন সাবেক সংসদ স্পিকার আলী লারিজানি। তিনি টানা ১২ বছর সংসদ স্পিকারের দায়িত্বে ছিলেন। সংস্কৃতিমন্ত্রী হিসেবে কাজ করেছেন। ইরানের জাতীয় সম্প্রচার সংস্থা আইআরআইবি'র প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন দীর্ঘ ১০ বছর। কান্টের দর্শন নিয়ে পিএইচডি করেছেন এই বিজ্ঞ রাজনীতিক। এর আগেও প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হয়েছেন,কিন্তু জেতেননি।
সংস্কারপন্থী ধারার প্রধান প্রার্থী হিসেবে মনে করা হচ্ছিল বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মাদ জাওয়াদ জারিফকে। তিনি আট বছর ধরে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১৫ সালে ইরানের পরমাণু বিষয়ক সমঝোতা 'জেসিপিওএ’ সইয়ের আগে ও পরে বিশ্বব্যাপী আলোচিত মুখ ছিলেন তিনি। এর আগে জাতিসংঘে ইরানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আন্তর্জাতিক আইন ও নীতিমালা বিষয়ে তার পিএইচডি ডিগ্রি রয়েছে। এতো দিন সংস্কারপন্থী ধারার মূল প্রার্থী হিসেবে তাকেই বিবেচনা করা হচ্ছিল। কিন্তু সম্প্রতি মোহাম্মাদ জাওয়াদ জারিফের একটি গোপন অডিও টেপ প্রকাশ হয়ে পড়ার পর তিনি আর প্রার্থী হননি। ঐ অডিও টেপে ইরানের কুদস ফোর্স নিয়ে কিছু বিরূপ মন্তব্য রয়েছে।
ইরানের জ্বালানী বিষয়ক সংসদীয় কমিশনের প্রধান ফেরেইদুন আব্বাসিও এবারের নির্বাচনে প্রার্থী হবেন বলে জানা গেছে। তিনি ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। মাহমুদ আহমাদিনেজাদের আমলে ইরানের আণবিক শক্তি সংস্থার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বর্তমান সংসদের এই সদস্য। শিক্ষাবিদ হিসেবে তার সুনাম রয়েছে। ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি’র ইমাম হোসেইন (আ.) বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন। পিএইচডি করেছেন পরমাণু নিয়ে। তাকেও রক্ষণশীল ধারার একজন রাজনীতিক হিসেবেই গণ্য করা যায়।
প্রার্থী হতে পারেন আইআরজিসি’র সাবেক প্রধান কমান্ডার মোহসেন রেজায়িও। তিনি বর্তমানে ইরানের নীতি নির্ধারণী পরিষদের সচিবের দায়িত্বে রয়েছেন। অর্থনীতিতে ডক্টরেট করেছেন। তিন বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন, তবে আশানুরূপ ফল পাননি। মোহসেন রেজায়ি রক্ষণশীল ধারার মানুষ।
ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট আয়াতুল্লাহ হাশেমি রাফসানজানির বড় ছেলে মোহসেন হাশেমিও সংস্কারপন্থীদের পক্ষ থেকে প্রার্থিতা ঘোষণা করতে পারেন। তিনি বর্তমানে তেহরান সিটি কাউন্সিলের চেয়ারম্যান। এর আগে হাশেমি রাফসানজানির আমলে তিনি প্রেসিডেন্টের দপ্তরের প্রধান এবং একজন উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
এসব সম্ভাব্য প্রার্থীর বাইরে নতুন মুখও দেখা যেতে পারে এবারের নির্বাচনে। রক্ষণশীলদের পক্ষ থেকে নতুন মুখ সামনে এনে চমক তৈরির রেকর্ড রয়েছে। ২০০৫ সালের নির্বাচনে তুলনামূলক কম পরিচিত মাহমুদ আহমাদিনেজাদকে সামনে এনে সফল হয়েছিল তারা। এবারও এমন কিছু ঘটতে পারে। কারণ রক্ষণশীলদের পরিচিত মুখগুলোর বেশিরভাগই এর আগের কোনো না কোনো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে গেছেন।
ইরানের সাম্প্রতিক কয়েক দশকের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের রেকর্ড বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়,আট বছর পরপর সংস্কারপন্থী ও রক্ষণশীলদের মধ্যে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। টানা দুই নির্বাচনে সংস্কারপন্থীরা জয় পেলে পরের দুই নির্বাচনে রক্ষণশীলরা জেতে। জনগণ এই রীতির ব্যত্যয় না ঘটালে এবার রক্ষণশীলদের পালা। সংস্কারপন্থী প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি দুই মেয়াদে ৮ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। দ্বিতীয় মেয়াদে তাকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কঠোর নিষেধাজ্ঞা মোকাবেলা করতে হয়েছে। এ কারণে ইরানিদের ওপর অর্থনৈতিক চাপ বেড়েছে যা সংস্কারপন্থীদের জনপ্রিয়তায় কিছুটা ভাটা এনেছে। গত বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে ভালো করতে পারেনি সংস্কারপন্থীরা। ঐ নির্বাচনে রক্ষণশীলরা সংসদের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসনে জিতেছে। তবে বর্তমান সংস্কারপন্থী প্রেসিডেন্ট রুহানির প্রশাসন বিদায়ের আগ মুহূর্তে মার্কিন কঠোর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করে নতুন চমক সৃষ্টির সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছেন। এই প্রচেষ্টা সফল হলে সংস্কারপন্থীদের জনপ্রিয়তাও আবার বেড়ে যেতে পারে এবং আসন্ন নির্বাচন অনেক বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে#
ড. সোহেল আহম্মেদ: লেখক ও সাংবাদিক