'জালিমের উপর মজলুমের বিজয় প্রত্যাশা করি'
(last modified Sat, 03 Feb 2024 08:59:43 GMT )
ফেব্রুয়ারি ০৩, ২০২৪ ১৪:৫৯ Asia/Dhaka
  • 'জালিমের উপর মজলুমের বিজয় প্রত্যাশা করি'

আসসালমু আলাইকুম। রেডিও তেহরান বাংলা পরিবারের সকলের প্রতি রইল একরাশ প্রীতি ও শুভেচ্ছা। আশা ও প্রার্থনা করি আপনারা সকলে ভালো ও সুস্থ আছেন। ইসলামী বিপ্লবের ৪৫তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ইরানসহ বিশ্বের সকল মজলুম, মুক্তিকামী মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা ও সালাম জ্ঞাপন করে আজকের লেখাটি শুরু করছি। 

১৯৭৯ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি বিশ্বের ইতিহাসে একটি আলোকোজ্জ্বল স্মরণীয় দিন। যেদিন এই শোষিত-বঞ্চিত পৃথিবীর বুকে নতুন করে ইসলামের অমিয় ধারায় আপ্লুত হয়ে ইরানের আপামর জনতা জেগে উঠেছিল, এক নতুন জীবনের, নতুন পরশে। মহান আল্লাহ তাঁর ইচ্ছাকে এভাবেই কার্যকরী করেন পৃথিবীতে। যারা এতোদিন তাগুতি শক্তির মোকাবেলায় হীনবল ও অসহায় হয়ে জীবন যাপন করছিল, তারা আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের মাধ্যমে পুনরায় ধন্য হয়ে উঠবে, এটাই মহান আল্লাহর ইচ্ছা। 

"আমি ইচ্ছা করলাম, সে জমিনের বুকে যাদেরকে হীনবল করা হয়েছিল, তাদের প্রতি অনুগ্রহ করতে, তাদেরকে নেতৃত্ব দান করতে ও দেশের অধিকারী করতে এবং তাদেরকে দেশে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করতে।" ( সরা কাসাস: ৫- ৬)।

আল্লাহ তায়ালার সীমাহীন রহমত ও করুণায় ইরানের ইসলামী বিপ্লব তার যাত্রাপথের সাড়ে চার যুগ সময় অতিক্রম করে সম্মুখে এগিয়ে চলেছে। এটা সত্য যে, ইসলামী বিপ্লবের বিজয় কোনো কুসুমাস্তীর্ণ পথ পরিক্রমার মধ্য দিয়ে অর্জিত ও সফল হয়নি। দীর্ঘদিনের ধারাবাহিক সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং অসংখ্য আত্মত্যাগী মানুষের শাহাদাতের ফল ছিল এই মহান বিপ্লব।

এই পৃথিবীতে অতীতে অনেক বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে; অনেক রাষ্ট্রীয় পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু ১৯৭৯ সালের ১১ ই ফেব্রুয়ারির এই মহান বিপ্লব এসেছে আল্লাহর পথে, আল্লাহর দ্বীনের বিজয়ের জ্যোতিতে ভাস্বর হয়ে এবং যুগ যুগ ধরে জাহেলিয়াতের কঠিন পর্দাকে বিদীর্ণ করে। আর তাই পৃথিবীর তাগুতি শক্তিগুলো এই বিপ্লবকে নস্যাৎ করতে নানা অপকর্মে লিপ্ত হয়েছে দশকের পর দশক ধরে। এসব শক্তি সবসময় বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছার কাছে তাদের সে ষড়যন্ত্র সে অপরাধকর্ম ব্যর্থ হতে বাধ্য হয়েছে। মহান আল্লাহ'র ভাষায়,  "অর্থাৎ এটা এজন্য যে, তিনি (আল্লাহ) সত্যকে সত্য এবং অসত্যকে অসত্য প্রতিপন্ন করেন, যদিও অপরাধীগন এ পছন্দ করেনা।" (সূরা আনফাল:৮)

ইসলামী বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনী (রহ.), ঐতিহাসিক এই দিনটিকে মহান 'আল্লাহর দিনগুলোর মধ্যে একটি দিন' বলে উল্লেখ করেছেন। ইরানি ২২ বাহমান, ইরানের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। এই দিনটি ছিল সেই দিন যেদিন রিক্ত, নিঃস্ব, অসহায় একটি মুসলিম জাতি, বিদেশি কোনো শক্তির সাহায্য ছাড়াই একমাত্র আল্লাহ তা'আলার উপর ভরসা করে ইরানের বুক থেকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদদপুষ্ট পুতুল সরকারকে উৎখাত করে ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল।  ঐতিহাসিক এই দিনে ইরানের বুকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ইসলামী প্রজাতন্ত্র।  এর আগে অবশ্য ইসলামী প্রজাতন্ত্র নামধারী অনেক রাষ্ট্র ছিল, কিন্তু সেসব রাষ্ট্র শুধু নামেই ইসলামিক ছিল। বাস্তবে ইসলামী শাসন কোথাও ছিল না। কিন্তু ইরানের ইসলামী বিপ্লব সে দেশের বুকে সত্যিকার অর্থে একটি ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল।

ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রশাসন এখনো পর্যন্ত শুধু টিকেই আছে এমন নয় বরং অত্যন্ত দক্ষতার সাথে উত্তরোত্তর সাফল্য অর্জন করে চলেছে। এটা স্মরণ করা যেতে পারে যে,  ইসলামের দুশমন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বৃহৎ ও শয়তানী শক্তিগুলো ইসলামী বিপ্লবের উজ্জ্বল মশালকে ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে ফেলার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। এ বিপ্লবকে অচিরেই ধ্বংস করতে চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেনি।  তারপরও ওরা ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানকে ধ্বংস করতে পারেনি। এটা স্বীকার করতেই হবে যে আল্লাহর অপার করুণা ও সাহায্য ছাড়া ইরানের এই সাফল্য কখনোই অর্জিত হতো না। ইমাম খোমেনীর নেতৃত্বে ইরানে ইসলামী বিপ্লব এর ঐতিহাসিক বিজয় ছিল পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দর্শন তথা লিবারেল, মার্কসীয় ও অন্যান্য দর্শনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ঐতিহাসিক লড়াইয়ের মহাবিজয়। এ বিপ্লব ব্যাপক লড়াইয়ের কেন্দ্রবিন্দু ও সূচনার স্থান হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। একই সময়ে এটা বিশ্বে একটি মানবিক দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে ইরানের ইসলামী বিপ্লবের বিজয়। এটা এমন একটি বিপ্লব যা বিশ্বকে স্তম্ভিত করেছে আর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের আধিপত্যবাদী শক্তি গুলোকে নিরাশ করে দিয়েছে। কারণ তারা দীর্ঘকাল ধরে বিশ্বের দুর্বল জাতিগুলোকে পদানত করে রাখার জন্য যে অপকৌশল চালিয়ে এসেছিল; হযরত ইমাম খোমেনী (রহ.)-এর নেতৃত্বে পরিচালিত এই মহান বিপ্লব তাকে নস্যাৎ করে দিয়েছিল। তাই তারা মরিয়া হয়ে উঠেছিল এই বিপ্লবকে অঙ্কুরেই বিলীন করে দেওয়ার জন্য। তারা চাপিয়ে দিয়েছিল দীর্ঘস্থায়ী এক যুদ্ধ, চাপিয়ে দিয়েছিল অর্থনৈতিক অবরোধ, কিন্তু সবকিছু উপেক্ষা করে ইসলামী বিপ্লব টিকে রয়েছে এবং শত্রুর শত ভ্রুকুটি উপেক্ষা করেই তা অনাগত কাল ধরে টিকে থাকবে বলে আমরা প্রত্যাশা করি।

আজ ইরানের ইসলামী বিপ্লব এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্র একটি বাস্তব; একটি প্রশ্নাতীত সত্য। জাতি-ধর্ম-বর্ণ এবং দল-মত-নির্বিশেষে পৃথিবীর সবাই একথা স্বীকার করতে বাধ্য। ইরানের ইসলামী বিপ্লব শুধু ইরানি নয়, গোটা বিশ্বের নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের মধ্যে একটি স্বাধিকার চেতনাও সৃষ্টি করেছে। সে বিচারে এ বিপ্লব একটি সত্যিকারের মানবতাবাদি বিপ্লবও বটে।

গোটা বিশ্বে যুগ যুগ ধরে চলে আসা বর্ণবাদ, জায়নবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদের মূলে কুঠারাঘাত হেনেছে এই বিপ্লব।  তাই যায়নবাদী ইজরায়েল- মার্কিন লবি আদা-জল খেয়ে লেগেছে এই বিপ্লব ও বিপ্লবী চেতনাকে শুধু ইরান নয় দুনিয়ার বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে। আর এ কারণেই মার্কিন প্রশাসন স্বতন্ত্র বাজেট বরাদ্দের মতো কাজ করতেও দ্বিধা করেনি। দিনের পর দিন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ইরান কে কোণঠাসা আর দুর্বল করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। তারা ইসলামের বিপ্লবী চেতনা ও উত্থানের নাম দিয়েছে 'মৌলবাদ' বলে। কিন্তু তারা জানে না যে, আল্লাহর ইচ্ছা সকল মানুষের ইচ্ছার উপরেই কার্যকরী হয়ে থাকে এবং সকল প্রকার চক্রান্তের জবাব দানে আল্লাহই যথেষ্ট। পৃথিবীতে যুগে যুগে আল্লাহর এই বিধান কার্যকরী হয়েছে, কিন্তু তবুও জালেম এবং ষড়যন্ত্রকারীরা বোঝেনা। তারা সবসময়ই বিপ্লবের এই চেতনাকে নস্যাৎ করতে নানা অপকৌশল অবলম্বন করে চলেছে প্রতিনিয়ত ।

ইসলামী ইরানের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল দীর্ঘ আট বছরের ভয়াবহ যুদ্ধ। কিন্তু এই যুদ্ধে ইরান সম্মানজনক বিজয় অর্জন করেছে কোন বিদেশি সাহায্য ছাড়াই। সম্পূর্ণ নিজস্ব শক্তি আর আল্লাহর সাহায্যের ওপর নির্ভর করে আগ্রাসনের মোকাবেলা করেছে। বীর ইরানি জাতির মনোবল ও ঈমানের জোর ছিল বলেই দুশমনরা ইরানের মোকাবেলায় পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল। ইরানি জাতি এই যুদ্ধে জয়লাভ করা ছাড়াও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে দক্ষতার সঙ্গে পুনর্গঠনও করেছে। দেশ গড়ার এই সংগ্রামে, ইসলামী ইরান কোন বিদেশি সাহায্যের পরোয়া করেনি। চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের সময় শত্রুরা ইরানের শিল্পকারখানা, হোটেলগুলোর মারাত্মক ক্ষতিসাধন করেছিল। কিন্তু যুদ্ধের পর ইরানের ইসলামি জাতি পুনর্গঠন-জিহাদের মাধ্যমে এ সকল কল-কারখানাগুলো অতি অল্প সময়ের মধ্যেই মেরামত করে উৎপাদনমুখী করে তুলেছে।  শুধু তাই নয়,  যুদ্ধের পর নতুন নতুন কল কারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনসহ দেশব্যাপী উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জোয়ার শুরু হয়। যার ফলশ্রুতিতে হাজারো বাধা অতিক্রম করে ইসলামী ইরান মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। 

ইউরোপের বুক থেকে কমিউনিস্ট প্রশাসনের দ্রুত পতন এবং আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে মৌলিক পরিবর্তন ইসলামী বিপ্লবেরই প্রভাবের ফল বলা হয়। ইসলামী বিপ্লব শুধু ইরানের নয়, গোটা বিশ্বব্যাপী এক নতুন পরিবর্তনের জোয়ার এনেছে।

এবছর ইরানের জনগণ মহান ইসলামী বিপ্লবের ৪৫তম বার্ষিকী পালন করছে। প্রতিবছরের মতো এবারও ইরানি জনগণ বিপ্লবের নতুন উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করে যাবার প্রত্যয়ে তেহরানের আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করবে "আল্লাহু-আকবর" ধ্বনিতে। কারণ তারা এ ব্যাপারে সচেতন যে, তাদের এই বিপ্লবের বাণী বিশ্বের নির্যাতিত-নিপীড়িত জনগণের কাছে পৌঁছে গেছে। এই সত্যও উপলব্ধি করেছে যে,  স্বৈরাচারী ও লোভী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কবল থেকে মুক্তি পেতে হলে ইসলাম ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এই সত্য মুসলমানরা যেমন স্বীকার করেছে, তেমনি বিশ্বের অন্যান্য জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগ জনগণই তা উপলব্ধি করতে পারছে। আসলে ইরানের ইসলামী বিপ্লব বিশ্বের নির্যাতিত-নিপীড়িত জাতিসমূহের মুক্তি ঘোষণা করেছে। আমরা প্রত্যাশা করি, সেদিন খুব বেশি দূরে নয় যেদিন বিশ্বের নির্যাতিত জাতিগুলো সেই বিপ্লবী চেতনায় জাগ্রত হবে, যে চেতনায় ইরানের জনগণ জেগে উঠেছিল ৪৫ বছর আগে। আশা করি মহান আল্লাহর রহমতে নির্যাতিত-নিপীড়িত জাতিগুলো সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী ও তাদের তল্পিবাহকদেরকে দেশ থেকে বিতাড়িত করে নিজেদের ভাগ্য গড়ার অধিকার নিজেরা ফিরে পাবে। এই শুভ মুহূর্তে আমরা জালিমের উপর মজলুমের বিজয় প্রত্যাশা করি।

 

এস এম নাজিম উদ্দিন,

পশ্চিম বঙ্গ, ভারত।

 

পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/৩

 

ট্যাগ