ইমাম হাসানের (আ)’র শোকাবহ শাহাদাত-বার্ষিকী
ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন (আ) কি পৃথক নীতির অনুসারী ছিলেন?
২৮ সফর ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে শোকাবহ দিন। কারণ দশম হিজরির এই দিনে দুনিয়া থেকে বিদায় নেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) এবং চল্লিশ বছর পর ৫০ হিজরির একই দিনে শাহাদত বরণ করেন তাঁরই প্রথম নাতি হযরত ইমাম হাসান (আ)। এ উপলক্ষে গভীর শোক ও সমবেদনা জানাচ্ছি সবাইকে।
ইমাম হাসান (আ) জন্ম গ্রহণ করেছিলেন তৃতীয় হিজরির ১৫ ই রমজানে। বিশ্বনবী (সা.) মহান আল্লাহর নির্দেশে প্রিয় প্রথম নাতীর নাম রাখেন হাসান। হাসান শব্দের অর্থ সবচেয়ে ভাল বা উত্তম, পছন্দনীয় ইত্যাদি। ইমাম হাসান (আ.)'র সাত বছর বয়স পর্যন্ত মহানবী (সা.) বেঁচে ছিলেন। রাসূল (সা.) বহুবার প্রিয় এই নাতিকে কাঁধে নিয়ে বলেছেন, “হে প্রভু, আমি ওকে ভালবাসি, আপনিও তাকে ভালবাসুন।“তিনি আরও বলতেন, “যারা হাসান ও হুসাইনকে ভালবাসবে তারা আমাকেই ভালবাসল। আর যারা এ দুজনের সঙ্গে শত্রুতা করবে তারা আমাকেই তাদের শত্রু হিসেবে গণ্য করল।
”বিশ্বনবী (সা.) হাসান ও হুসাইন (আ.)-কে “বেহেশতের যুবকদের নেতা”ও “মুসলিম উম্মাহর দুই সুবাসিত ফুল”বলে উল্লেখ করেছেন এবং তিনি আরও বলেছেন,
“আমার এই দুই নাতি উভয়ই মুসলমানদের ইমাম বা নেতা, তা তারা তাগুতি শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াক বা না দাঁড়াক।”বিশ্বনবী (সা.) এই দুই নাতির শৈশবে তাঁদের সঙ্গে খেলতেন, তাদের বুকে চেপে ধরতেন, চুমু খেতেন এবং তাদের ঘ্রাণ নিতেন। তারা বিশ্বনবী (সা.)’র নামাজের সময় নানার গলায় বসে পড়লে নানা সিজদা থেকে উঠতেন না যতক্ষণ না তারা নিজেরাই উঠে যেতেন।
বিশ্বনবী (সা.) ইমাম হাসান ও হুসাইনকে তাঁদের শৈশবেই অনেক চুক্তিপত্রের সাক্ষী হিসেবে মনোনীত করেছেন। মহানবী (সা.) নাজরানের খ্রিস্টানদের সঙ্গে মুবাহিলার সময় তথা যারা সত্য ধর্মের বিরোধী তারা আল্লাহর অভিশাপে সপরিবারে ধ্বংস হবে - যৌথভাবে এমন ঘোষণা দেয়ার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে মহান আল্লাহর নির্দেশেই সঙ্গে নিয়েছিলেন হযরত ইমাম হাসান ও হুসাইন এবং ইমাম আলী (আ.) ও ফাতিমা (সালামুল্লাহি আলাইহা)-কে। আর সে সময়ই আলী (আ.)সহ নবী-পরিবারের এই সদস্যরা যে পবিত্র সে বিষয়ে কুরআনের আয়াত নাজেল হয়েছিল।
ইমাম হাসান (আ.) ছিলেন তাঁর নানা ও পিতার অনুসারী এবং তিনি তাঁদের মতই অত্যাচারীদের সমালোচনা করতেন ও মজলুমদের সমর্থন দিতেন। তিনি জামাল ও সিফফিন যুদ্ধে পিতার পক্ষে অংশ নিয়ে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। জামাল যুদ্ধের আগুন নেভানোর জন্য তিনি পিতার নির্দেশে হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসিরকে সঙ্গে নিয়ে কুফায় গিয়ে সেখানকার জনগণকে পিতার পক্ষে সংঘবদ্ধ করে তাদেরকে বসরায় নিয়ে এসেছিলেন।
আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ.) নিজের ইন্তিকালের সময় ইমাম হাসান (আ.)-কে তার খেলাফতের উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করেন। বিশ্বনবী (সা.)ই তা করার জন্য ইমাম আলী (আ.)-কে নির্দেশ দিয়েছিলেন নিজের জীবদ্দশায়।
ইমাম হাসান (আ.) যখন ওজু করতেন তখন আল্লাহর ভয়ে তাঁর চেহারা বিবর্ণ হয়ে যেত এবং তিনি কাঁপতে থাকতেন। মৃত্যু ও পুনরুত্থানের কথা যখন স্মরণ করতেন তখন তিনি কাঁদতেন ও বেহাল হয়ে পড়তেন। তিনি পায়ে হেঁটে এবং কখনও নগ্ন পায়ে ২৫ বার মদিনা থেকে মক্কায় গিয়ে হজ্ব বা ওমরাহ করেছেন। ইমাম হাসান (আ.) তিনি জীবনে তিনবার তাঁর যা কিছু ছিল,এমন কি জুতো পর্যন্ত দু’অংশে ভাগ করে আল্লাহর পথে দান করে দিয়েছিলেন। নিষ্পাপ ইমাম হওয়া সত্ত্বেও তিনি আল্লাহর দরবারে নিজেকে পাপী বলে অভিহিত করে আল্লাহর ক্ষমা ও দয়া ভিক্ষা করতেন। কোনো প্রার্থীকে বিমুখ করতেন না ইমাম হাসান (আ.)। তিনি বলতেন, “আমি নিজেই যখন আল্লাহর দরবারে ভিখারি (ও তাঁর অনুগ্রহ প্রার্থনা করি) তখন কোনো প্রার্থীকে বিমুখ করতে আমার লজ্জা হয়।”
মানুষের সমস্যা সমাধানে তিনি এত উদগ্রীব ও ব্যস্ত থাকতেন যেন এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজের কথা তাঁর জানা ছিল না। তিনি নিজেই এ ব্যাপারে বিশ্বনবী (সা.)’র একটি বাণী তুলে ধরে বলতেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, ইমাম হাসান (আ.) খলিফা হওয়ার পর মুয়াবিয়া তা মেনে নেয়নি। আলী (আ.)'র বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও ষড়যন্ত্রের যে ধারা মুয়াবিয়া সূচিত করেছিল এই নতুন ইমামের বিরুদ্ধেও সেই একই ধারা অব্যাহত রাখে। ইমাম হাসান (আ.) মুয়াবিয়ার কাছে এক দীর্ঘ চিঠি লিখে তাকে সুপথে আনার চেষ্টা করেছিলেন। সেই চিঠির একাংশে তিনি লিখেছিলেন, “তুমিও অন্যদের মতই আমার হাতে বাইয়্যাত গ্রহণ কর। তুমি নিজেই ভাল করে জান যে আমি তোমার চেয়ে বেশি যোগ্যতার অধিকারী। আল্লাহকে ভয় কর এবং অত্যাচারী জালিমদের মধ্যে গণ্য হয়ো না।”
কিন্তু মুয়াবিয়া চিঠির উত্তরে নিজেকে বেশি অভিজ্ঞ বলে দাবি করে। অবশ্য সে প্রলোভন দেখানোর জন্য বলে যে, ইমাম হাসান (আ.) তাকে খলিফা হিসেবে মেনে নিলে পরবর্তী খলিফা ইমামকেই করা হবে।
মুয়াবিয়া ইমাম হাসানকে গোপনে হত্যার জন্য কিছু লোককে নিয়োজিত করে। খলিফা হিসেবে ইমাম হাসান (আ.)-কে মেনে না নেয়ার কারণ হিসেবে ইমামের বয়সের স্বল্পতার অজুহাত দেখানো সত্ত্বেও মুয়াবিয়া নিজের চরিত্রহীন কম বয়স্ক যুবক সন্তান ইয়াজিদকে পরবর্তী খলিফা হিসেবে মনোনীত করে। এছাড়াও মুয়াবিয়া ইমামের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য লোকজন জড় করে তাদেরকে ইরাকে পাঠায়।
এ অবস্থায় ইমাম হাসানও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হন ও যুদ্ধের প্রথম দিকে সাফল্যও লাভ করেন। কিন্তু মুয়াবিয়ার নানা চক্রান্তের মুখে একদল সহযোগীর বিশ্বাসঘাতকতা ও জনগণের ধৈর্যহীনতার কারণে ইমাম শেষ পর্যন্ত মুয়াবিয়ার সঙ্গে সন্ধি করতে বাধ্য হন। ইমাম বেশ কিছু কঠিন শর্ত দিয়ে সন্ধি-চুক্তি করেন।
উল্লেখ্য, বিদ্রোহী মুয়াবিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে উৎসাহিত করার জন্য হযরত ইমাম হাসান মুজতাবা (আ.) খেলাফতের দায়িত্ব নেয়ার পর পরই যোদ্ধাদের বেতন শতকরা ১০০ ভাগ বৃদ্ধি করেছিলেন। তাই এ ধারণা ঠিক নয় যে ইমাম হাসান (আ.) সাহসী ও জিহাদপন্থী ছিলেন না।
মিথ্যা প্রচারে অভ্যস্ত উমাইয়ারাই ইমামকে ভীরু ও বিলাসী হিসেবে ইতিহাসে তুলে ধরতে চেয়েছে। তিনি যদি জিহাদকে ভয় পেতেন তাহলে বাবার সঙ্গে জামাল ও সিফফিন যুদ্ধে অংশ নিতেন না।
এ ছাড়াও হাসান (আ.) জানতেন যে মুসলমানদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে এই সুযোগে বাইজান্টাইন সম্রাট ‘চতুর্থ কন্সতান্তিন’ মুসলমানদের প্রথম কিবলা অধ্যুষিত বায়তুল মোকাদ্দাস শহরটি দখলের পদক্ষেপ নেবে। তাই ইমাম শান্তি ও কূটনৈতিক পন্থার মাধ্যমে প্রিয় নানার ধর্মের বার্তা তথা খাঁটি মুহাম্মদী ইসলামকে রক্ষার জন্য ও ইসলামকে দূষণমুক্ত করার যে কাজ পিতা হযরত আলী (আ.) শুরু করেছিলেন সেই মিশনকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে এবং মুয়াবিয়ার আসল চেহারা প্রকাশ করে দেয়ার লক্ষ্যে তার সঙ্গে সন্ধি তথা যুদ্ধ-বিরতির সিদ্ধান্ত নেন। মূলত সমর্থকদের নিষ্ক্রিয়তা ও আদর্শিক বিচ্যুতির কারণেই ইমাম হাসান (আ.)-কে যুদ্ধ-বিরতির পথ বেছে নিতে হয়েছিল।
ইমাম হাসান (আ.) এও জানতেন যে তিনি রাজনৈতিক ক্ষমতা বা শাসন-ক্ষমতা হাতে না পেলেও মুসলমানদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত ইমামই থেকে যাবেন। তাই মুয়াবিয়ার আসল চেহারা জনগণের কাছে তুলে ধরার জন্য তথা তার নোংরা কাজগুলো ঘটতে দেয়ার অবকাশ দেয়া জরুরি হয়ে পড়েছিল। অন্যদিকে এ সন্ধির ফলে মুসলমানদের রক্তপাত বন্ধ করা সম্ভব হয়েছিল।
মুয়াবিয়া ইমাম হাসান (আ.)’র সঙ্গে স্বাক্ষরিত সন্ধি-চুক্তির অপব্যবহার করেছিল যদিও ইমাম সন্ধির শর্তেই এটা উল্লেখ করেছিলেন যে তিনি মুয়াবিয়াকে আমিরুল মু’মিনিন বলবেন না। এরই আলোকে তিনি কখনও মুয়াবিয়ার হাতে বাইয়্যাত হননি এবং মুয়াবিয়ার কোনো নির্দেশই মান্য করতেন না। যেমন, মুয়াবিয়া খারেজিদের বিদ্রোহ দমনে ইমামের সহায়তা চান এবং তাঁকে খারিজিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নির্দেশ দেন। কিন্তু ইমাম হাসান (আ.) তাঁর কথাকে কোনো গুরুত্বই দেননি।
কেউ কেউ মনে করেন ইমাম হুসাইন ও ইমাম হাসান দুই ভিন্ন নীতির অনুসারী ছিলেন। কিন্তু কথাটা সত্য নয়। ইমামদের কর্মপদ্ধতির মধ্যে পার্থক্য ছিল কিন্তু সেটি তার পরিবেশ ও পরিস্থিতির দাবিতেই ছিল, কখনই তা তাদের বৈশিষ্ট্যগত তফাত থেকে উদ্ভূত ছিল না যে বলা যাবে যে যদি ইয়াজিদের সময় ইমাম হাসান জীবিত থাকতেন তবে তিনি সন্ধির নীতি গ্রহণ করতেন। মৌলিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন উভয়েই একরূপ ছিলেন এবং নীতির ক্ষেত্রেও তাঁদের মধ্যে অভিন্নতা ছিল।
তাঁরা উভয়েই একদিকে অত্যন্ত সাহসী ও অন্যদিকে বীর যোদ্ধা ছিলেন। নাহজুল বালাগার ২০৭ নং খুতবায় হজরত আলীর বক্তব্য থেকে বোঝা যায় যে, তিনি সিফফিনের যুদ্ধে ইমাম হাসানের দুঃসাহসিকতায় এতটা শঙ্কিত হন যে নিজ সঙ্গীদের বলেন : ‘হাসানকে এভাবে মরিয়া হয়ে যুদ্ধ করা থেকে নিবৃত কর আমি তাকে হারানোর আশঙ্কা করছি।’ তাই নিঃসন্দেহে বলা যায় মুয়াবিয়ার সাথে তিনি সঙ্গীদের অসহযোগিতার কারণে সন্ধি করতে বাধ্য হন, ভীরুতার কারণে নয়।
ঐতিহাসিক মাসউদী তার ‘ইসবাতুল ওয়াসিয়া’ গ্রন্থে ইমাম হাসানের যে বক্তব্যটি উল্লেখ করেছেন তাতে তিনি বলেছেন : ‘আমি যদি উপযুক্ত সঙ্গী পেতাম তবে খেলাফত লাভের জন্য এমন বিপ্লব ও আন্দোলন করতাম যে কেউ তার নজির দেখেনি।’
মুয়াবিয়ার বাহ্যিক ধার্মিকতার কারণে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার বৈধতাকে জনগণের সামনে স্পষ্ট করা ইমাম হাসান (আ)'র জন্য বেশ কঠিন ছিল। এ কারণে আমরা দেখি ইমাম হাসানের মৃত্যুর পর মুয়াবিয়া দশ বছর জীবিত থাকলেও ইমাম হুসাইন (আ) তার বিরুদ্ধে আন্দোলনের আহ্বান জানাননি। এর বিপরীতে ইয়াজিদের সময় যেভাবে অধার্মিকতা প্রকাশ্য রূপ লাভ করেছিল ইমাম হাসানের জীবদ্দশায় এরূপ অবস্থার সৃষ্টি হলে সেক্ষেত্রে তিনিও বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে ইমাম হুসাইনের মতই বিদ্রোহ করতেন।–
ইমাম হাসান (আ) যে কোন্ পরিস্থিতিতে মুয়াবিয়ার সঙ্গে সন্ধি করতে বাধ্য হন তা বোঝার জন্য জানা দরকার যে তার অন্যতম প্রধান সেনাপতি ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ইবনে আব্বাস মুয়াবিয়ার কাছ থেকে ৮ লাখ বা ৭ লাখ রৌপ্যমুদ্রা ঘুষ নিয়ে প্রায় ৮ হাজার যোদ্ধাসহ মুয়াবিয়ার দলে যোগ দেন। ইবনে আছির বর্ণনা করেছেন:ইমাম হাসান মুয়াবিয়ার সন্ধির প্রস্তাব শুনে জনগণের উদ্দেশে বলেন:‘শোন! মুয়াবিয়া আমাদের এমন এক প্রস্তাব দিয়েছে যার মধ্যে কোন সম্মানও নেই এবং কোন ইনসাফও নেই। যদি তোমরা মৃত্যুকে চাও আমি তার প্রস্তাবকে ফিরিয়ে দিব এবং তরবারির তীক্ষ্ণতা দিয়ে তার ওপর মহান আল্লাহর বিধান জারি করব। আর যদি তোমরা জীবনকে বেছে নাও তবে আমি তোমাদের সন্তুষ্টির জন্য তা গ্রহণ করব।'তখন লোকেরা সভার সকল প্রান্ত থেকে চীৎকার করে বলতে লাগল : আমরা বেঁচে থাকতে চাই। আমরা বেঁচে থাকতে চাই। তুমি সন্ধিকে মেনে নাও।
ইমাম হাসান (আ.)সমর্থকদের নিষ্ক্রিয়তা দেখে মুয়াবিয়ার হাতে দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে লোকদের উদ্দেশে দেয়া বক্তব্যে বলেছিলেন: হে লোকেরা! নিশ্চয় আমরাই হলাম তোমাদের আমির ও নেতা। আমরা হলাম তোমাদের নবীর সেই আহলে বাইত যাদের থেকে আল্লাহ অপবিত্রতা দূর করেছেন ও পূর্ণরূপে পবিত্র করেছেন। এ কথাটি তিনি এতবার পুনরাবৃত্তি করলেন যে, সভায় উপস্থিত এমন কেউ রইল না যে ক্রন্দন করেনি এমনকি তাঁর বুকের ভেতরের শব্দও শোনা যাচ্ছিল। অতঃপর তারা সন্ধির জন্য মুয়াবিয়ার কাছে গেল এবং আমরা পূর্বে যেরূপ উল্লেখ করেছি তার ভিত্তিতে তার সাথে সন্ধি করল। এভাবেই হাসান তার নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করলেন। (ইবনে আছির, আলকামিল ফিত তারিখ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৪০৬; উসদুল গাবা ফি মারিফাতিস সাহাবা, ইবনে আছির, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৩-১৪)
দুঃখজনক বিষয় হল জনগণ যুদ্ধ করতে চায়নি বলে ইমাম যখন মুয়াবিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ-বিরতি করেন তখন ইমামের একজন ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি উপহাস করে ইমাম হাসানকে ' লাঞ্ছিতদের নেতা' বলে উপহাস করার স্পর্ধা দেখিয়েছিল।
মুয়াবিয়া ইমাম হাসানের (আ.) সঙ্গে সন্ধির পর যখন সব কিছুর ওপর নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয় তখন সে প্রকাশ্যেই ঘোষণা দিয়ে সন্ধির শর্তগুলো লঙ্ঘন করবে বলে জানিয়ে দেয়। মুয়াবিয়া ইমামকে মদীনায় সব ধরনের কষ্ট দেয়ার চেষ্টা চালায় এবং মদীনায় নিয়োজিত তার গভর্নররাও একই কাজে মশগুল ছিল। ফলে ইমাম মদীনায় দশ বছর অবস্থান করা সত্ত্বেও তার অনুসারীরা এই মহান ইমামের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতের সুযোগ খুবই কম পেত। তাই ইমাম হাসান (আ.)’র মত মহাজ্ঞানের উৎস থেকে খুব কম সংখ্যক অনুসারীই উপকৃত হতে পেরেছে। এই মহান ইমাম থেকে বর্ণনার সংখ্যাও তাই খুব কম দেখা যায়।
মুয়াবিয়া নিজের মৃত্যু আসন্ন এটা বুঝতে পেরে ছেলে ইয়াজিদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে থাকে। সে এটাও বুঝতে পেরেছিল যে, ইমাম হাসান (আ.) বেঁচে থাকলে জনগণ সহজেই তার লম্পট ছেলেকে খলিফা হতে দেবে না। তাই মুয়াবিয়া বেশ কয়েকবার ইমামকে শেষ করে দেয়ার চেষ্টা করে। অবশেষ মুয়াবিয়া অত্যন্ত কূট-কৌশলে ইমামের (আ.) এক স্ত্রীকে বিভ্রান্ত করে তাঁকে দিয়ে বিষ-প্রয়োগের মাধ্যমে ইমামকে শহীদ করে। পঞ্চদশ হিজরির সফর মাসের ২৮ তারিখে ৪৭ বা ৪৮ বছর বয়সে শাহাদতের অমৃত পান করেন ইমাম হাসান (আ.)। বলা হয় ইমাম হাসান (আ.)-কে তাঁর প্রিয় নানার কবরের পাশে দাফন করার উদ্যোগ নিয়েছিল নবী-পরিবার। কিন্তু বিশ্বনবী (সা.)'র আহলে বাইতের এই উদ্যোগকে বাধা দেয় বিশ্বনবী (সা.)'র পবিত্র আহলে বাইতের বিদ্বেষী প্রভাবশালী মহলগুলো। ফলে রাসূল (সা.)'র রওজা থেকে বেশ কিছু দূরে জান্নাতুল বাকি গোরস্তানে দাফন করা হয় এই মহান ইমামকে।
ইমাম হাসান (আ.) দেখতে প্রায় নানার মত তথা বিশ্বনবী (সা.)’র মত ছিলেন। তাঁর আচার-আচরণও ছিল সে রকম। তাঁকে দেখলেই রাসূল (সা.)’র স্মৃতি চাঙ্গা হত দর্শকদের মনে।
ইমাম হাসান (আ.) বলেছেন- “আমি বিস্মিত হই তার ব্যাপারে যে তার খাদ্যের মান নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে বা চিন্তিত অথচ নিজের চিন্তার খোরাক নিয়ে ভাবে না। অর্থাৎ সে তার পাকস্থলীর জন্য ক্ষতিকর খাবার বর্জন করলেও তার চিন্তার জগতে এমন কিছুকে প্রবেশ করতে দেয় যা তাকে ধ্বংস করে।”
সবাইকে আবারও গভীর শোক ও সমবেদনা জানাচ্ছি। ভিন্ন কণ্ঠ: যারা এতক্ষণ সঙ্গ দিলেন তাদেরকে জানাচ্ছি অনেক ধন্যবাদ। #
পার্সটুডে/এমএএইচ/২৫
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।