তুরস্কের সাথে কি ইসরাইলের যুদ্ধের আশঙ্কা আছে?
-
বাম: রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান ডান: বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু
পার্সটুডে-কাতারের ওপর ইহুদিবাদী ইসরাইলের আক্রমণ তুরস্ক ও ইসরাইলের মধ্যে উত্তেজনা বাড়িয়ে দিয়েছে এবং আঙ্কারা ও তেলআবিবের মধ্যে সরাসরি সংঘর্ষের আশঙ্কাও বাড়িয়ে দিয়েছে।
পার্সটুডে আরও জানায়, ইহুদিবাদী বিশ্লেষকরা দাবি করেছেন ৭ অক্টোবর, ২০২৩ তারিখে অপারেশন আল-আকসা স্টর্মের পর থেকে, ইহুদিবাদী সরকার তার জাতীয় নিরাপত্তা নীতি পরিবর্তন করে সম্ভাব্য সকল হুমকির মোকাবেলায় প্রতিক্রিয়া স্থগিত করার পরিবর্তে তাৎক্ষণিকভাবে হুমকির মোকাবেলা করেছে। ৭ অক্টোবরের পর থেকে দুই বছরে, ইহুদিবাদীরা প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর অসংখ্য এবং অভূতপূর্ব আক্রমণ চালিয়ে আক্রমণাত্মক আচরণের একটি ধরণ প্রদর্শন করেছে।
দুই বছরের গাজা যুদ্ধের সময় ইসরাইল এখন মধ্যপ্রাচ্যের ছয়টি দেশ-ফিলিস্তিন (গাজা), লেবানন, সিরিয়া, ইয়েমেন, ইরান এবং তারপর কাতারকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। প্রকৃতপক্ষে, কাতারের উপর আক্রমণ তুরস্ক এবং পাকিস্তানের মতো দেশগুলোর জন্য শঙ্কার ঘণ্টা বাজিয়েছে।
এ নিয়ে ইসরাইলি এবং তুর্কি সরকারের নেতাদের মধ্যে একে অপরের ওপর মৌখিক আক্রমণও বেড়েছে। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর এক বক্তব্যে বলেন: আমরা এখানে (জেরুজালেম) আছি। এটা আমাদের শহর। মি. এরদোয়ান, এটা আপনার শহর নয়। এটা আমাদের শহর। এটা সবসময় আমাদের শহর থাকবে। এটা আর কখনও বিভক্ত হবে না।
জেরুজালেম সর্বদা ইসরাইলের থাকবে-নেতানিয়াহুর এমন দাবির জবাবে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোয়ান বলেন: “আমরা পবিত্র শহর জেরুজালেমকে কখনোই অনুমোদনহীন হাত দিয়ে দূষিত হতে দেব না!” তিনি জোর দিয়ে বলেন যে “আদর্শগতভাবে, নেতানিয়াহু হিটলারের আত্মীয়দের একজনের মতো।”
কাতারের রাজধানী দোহায় সাম্প্রতিক হামলা ইঙ্গিত দেয় যে ইসরাইলি আগ্রাসনের পরিধি নতুন নতুন দেশগুলোতে সম্প্রসারিত হচ্ছে, যে দেশগুলোকে আগে সরাসরি লক্ষ্যবস্তু করা হয় নি। আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন এই পদক্ষেপ এ অঞ্চলে গুরুতর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। কাতারে হামাস নেতাদের ওপর হামলা করে ইসরাইল তুরস্ককে একটি বার্তা পাঠিয়েছে: হামাসের শেষ আশ্রয়স্থল তুরস্ক হতে পারে পরবর্তী লক্ষ্যবস্তু।
অনেক পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষক মনে করেন যে ন্যাটোতে তুরস্কের সদস্যপদ ইসরাইলি আক্রমণের বিরুদ্ধে সুরক্ষা প্রদান করে না। সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ইসরাইলি আক্রমণকে বৈধ আত্মরক্ষা হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
ইহুদিবাদী সংবাদপত্র হারেৎজের বিশ্লেষণ থেকে জানা যায় যে হামাসের প্রতি সমর্থন এবং সিরিয়ায় সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধির কারণে তুরস্ক ইসরায়েলের পরবর্তী লক্ষ্য হতে পারে। সিরিয়ায় দুই পক্ষের মধ্যে ক্রমবর্ধমান প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং নেতানিয়াহুর আর্মেনীয় গণহত্যার স্বীকৃতিসহ উভয় পক্ষের দেওয়া প্রতিকূল বক্তব্যের মাধ্যমে এই সম্ভাবনা আরও জোরদার হয়েছে।
ন্যাটো সদস্য হিসেবে তুরস্ক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং অস্ত্র উৎপাদনসহ তার সামরিক অবকাঠামো শক্তিশালী করে ইসরাইলি হুমকি মোকাবেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সিরিয়ায় তুর্কি রাডার সরঞ্জামের ওপর ইসরাইলের সাম্প্রতিক আক্রমণ, যার ফলে বেশ কয়েকজন তুর্কি সৈন্য নিহত হয়েছে, এবং ইসরাইলের বিরুদ্ধে স্থানীয় গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন করার জন্য আঙ্কারার ইচ্ছা এই সংঘর্ষের স্পষ্ট লক্ষণ।
তুরস্ক ও ইসরাইলের মধ্যে দুর্ঘটনাজনিত সংঘর্ষ রোধে এপ্রিল মাসে আজারবাইজান প্রজাতন্ত্রের মধ্যস্থতা ছিল কেবল একটি অস্থায়ী সমাধান, উত্তেজনার মৌলিক সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছিল। অন্যদিকে, সিরিয়ায় তুরস্ক ও কাতারের ক্রমবর্ধমান সহযোগিতা, বিশেষ করে বাশার আল-আসাদের পতনের পর, ইসরাইলি উদ্বেগকে আরও তীব্র করে তুলেছে।
সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে, উন্নত প্রযুক্তি, বিমান বাহিনী এবং পারমাণবিক অস্ত্রাগারের ক্ষেত্রে ইসরািইলের প্রাধান্য রয়েছে, তবে ন্যাটোর অন্যতম বৃহত্তম বাহিনী হিসেবে তুর্কি সামরিক বাহিনী গুরুতর চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে সক্ষম। তুরস্কের কাছে F-35 যুদ্ধবিমান বিক্রি বন্ধ করার জন্য ইসরাইলের প্রচেষ্টা আঙ্কারার সামরিক শক্তি বৃদ্ধির বিষয়ে তেল আবিবের উদ্বেগকে প্রতিফলিত করে।
তুরস্ক সম্প্রতি ক্ষেপণাস্ত্র এবং বিমান প্রতিরক্ষা সক্ষমতায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি করেছে। চলতি বছরের শুরুতে নতুন ব্যালিস্টিক এবং ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা উন্মোচন করেছে। এরদোগান প্রতিরক্ষা ঠিকাদার আসেলসানের জন্য ১.৫ বিলিয়ন ডলারের একটি গবেষণা কেন্দ্রও খুলেছেন, যা স্টিল ডোম ব্র্যান্ড নামের রাডার, ইলেকট্রনিক যুদ্ধ এবং বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করে।
এর মধ্যে রয়েছে SİPER বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, যা ১৫০ কিলোমিটার রেঞ্জের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে পারে। তুরস্কের বিমান বাহিনীর মেরুদণ্ড F-16 যুদ্ধবিমানের বহরটি পুরাতন হয়ে আসছে এবং F-35 কর্মসূচিতে পুনরায় যোগদানের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আলোচনা স্থগিত হয়ে গেছে। এর ফলে আঙ্কারা ২০৩০ সালে নির্মিত হতে যাওয়া খান পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান এবং কিজিল আলমা স্টিলথ ড্রোনের মতো দেশীয় প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে বাধ্য হয়েছে।
তুর্কি বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইসরাইল কর্তৃক তুরস্কের আকাশসীমা লঙ্ঘনের ফলে আঙ্কারা তাৎক্ষণিক এবং কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখাবে। ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ তুরস্ক এবং তার কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বারবার হুমকি দেওয়া সত্ত্বেও, তুরস্ক এবং ইসরাইলের মধ্যে সামুদ্রিক বাণিজ্য অব্যাহত রয়েছে। তুরস্ক এবং ইসরায়েলের মধ্যে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক থাকার পরও সেই দেশে হামাস কর্মকর্তা এবং নেতাদের নির্মূল করার অজুহাতে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তুরস্কে আক্রমণ করতে কোনও দ্বিধা নেই বলে মনে হচ্ছে। বিশেষ করে যেহেতু ডোনাল্ড ট্রাম্প এই অঞ্চলের দেশগএলাতে আক্রমণ করার জন্য তেল আবিবের সমস্ত অপরাধমূলক পদক্ষেপকে কার্যত সবুজ সংকেত দিয়েছেন।#
পার্সটুডে/এনএম/১৮
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।