লেবানন-ইরাকে সাম্প্রতিক সহিংসতা: ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে যারা
(last modified Sat, 09 Nov 2019 14:18:31 GMT )
নভেম্বর ০৯, ২০১৯ ২০:১৮ Asia/Dhaka
  • লেবানন-ইরাকে সাম্প্রতিক সহিংসতা: ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে যারা

ইরাক ও লেবাননে নতুন করে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে এবং সহিংস ঘটনা ঘটেছে। এই দুই দেশে ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ের লক্ষ্যে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের ডাক দেয়া হলেও তা এক পর্যায়ে সহিংসতায় রূপ নেয়।

বিভিন্ন সাক্ষ্য প্রমাণে দেখা গেছে, ইরাক ও সিরিয়ায় অস্থিতিশীলতার পেছনে ভেতরে ও বাইরের কিছু মহলের ইন্ধন ও ষড়যন্ত্র রয়েছে।

গত ১৭ অক্টোবর থেকে লেবাননে এবং এরপর ইমাম হোসেন(আ.)এর চল্লিশা বা আরবাইন পালনের পর ইরাকে সরকার বিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়। ইরাকে আরবাইনের কিছুদিন আগ থেকে বিক্ষোভ শুরু হলেও আরবাইন উপলক্ষে বিক্ষোভ স্থগিত রাখা হয়েছিল। এরপর ইরাকে ফের বিক্ষোভ শুরু হয়। এই দুই দেশে সরকারবিরোধী বিক্ষোভের কারণ প্রায় একই। দু'দেশেই দরিদ্রতা রয়েছে, রয়েছে বেকারত্ব ও প্রশাসনের ব্যাপক দুর্নীতি। এ কারণে জনগণ ক্ষুব্ধ। ইরাকে সেবামূলক কার্যক্রম দুর্বল হয়ে পড়ায় সরকার বিরোধী ব্যাপক বিক্ষোভ হয় এবং জনগণ তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের দাবি জানায়। তারা প্রশাসনে দুর্নীতি রোধের জন্য সংস্কারের দাবি জানায়।

ইরাক ও লেবাননের সরকার ও কর্মকর্তারা অধিকার আদায়ের জন্য প্রচেষ্টার প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলেছেন, জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী অবশ্যই এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া হবে। এ ব্যাপারে ইরাক সরকার সংসদে পাঁচটি প্যাকেজ প্রস্তাব তুলে ধরেছে। এ প্রচেষ্টা সত্বেও সরকার বিরোধী বিক্ষোভ থামেনি বরং তা ক্রমেই রাজপথের সহিংসতার দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

বিভিন্ন সাক্ষ্য প্রমাণে দেখা যায়, ইরাক ও সিরিয়ায় সরকার বিরোধী বিক্ষোভকে সহিংসতায় রূপ দেয়ার ক্ষেত্রে এ অঞ্চলের প্রতিরোধ শক্তির বিরোধী মহলের হাত রয়েছে। পশ্চিম এশিয়ায় বর্তমানে  যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাতে আমেরিকা, সৌদি আরব ও দখলদার ইসরাইলের হাত থাকার বিষয়টি চিহ্নিত হয়ে পড়েছে। এ কারণে বর্তমান অবস্থা তাদের স্বার্থের অনুকূলে নেই। ইয়েমেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সৌদি আরব পরাজিত হয়েছে এবং রিয়াদ ইয়েমেন যুদ্ধের চোরাবালিতে আটকা পড়েছে। অন্যদিকে আমেরিকার ইরান বিরোধী নীতিও ব্যর্থ হয়েছে। ওয়াশিংটন ব্যাপক চেষ্টা চালিয়েও তেহরানকে আলোচনার টেবিলে ফিরিয়ে আনতে পারেনি। অপরদিকে, ইহুদিবাদী ইসরাইল নজিরবিহীন অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকটের সম্মুখীন। বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সরকার গঠনে কঠিন সংকটে পড়েছেন। এ অবস্থায় কোনো কারণে যদি মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল বিরোধী প্রতিরোধ সংগ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ইসরাইল ও সৌদি আরব নিজেদের সংকট কমিয়ে আনার সুযোগ পাবে। অন্যদিকে আমেরিকার লক্ষ্য বাস্তবায়নের পথও সুগম হবে।

লেবাননের আল আহাদ ওয়েব সাইটে এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক বিক্ষোভের পেছনে বৈরুতে অবস্থিত সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত দূতাবাসের ভূমিকা ছিল। এই দুই দূতাবাস প্রতিটি বিক্ষোভকারীর পেছনে গড়ে ১০০ ডলার ব্যয় করেছে। সরকার বিরোধী প্রতিবাদ কর্মসূচি ধরে রাখতে বিক্ষোভকারীদের জন্য খাদ্য, তাবু, চাদর ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধার যোগান দেয়া হত। এছাড়া প্রত্যেক যুবকের হাতে নগদ ১৫০ ডলার  ধরিয়ে দেয়া হত যাতে তারা বিক্ষোভ অব্যাহত রাখে।

এদিকে, ইসরাইলের কোনো কোনো গণমাধ্যম দাবি করেছে, লেবাননের অর্থনৈতিক সংকটের জন্য হিজবুল্লাহ দায়ী। কারণ সেদেশের বাজেটের বিরাট অংশ ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে ব্যয় হয়। এমন সময় হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে এ অভিযোগ তোলা হল যখন সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের ব্যাপক ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচার সত্বেও গত বছর মে মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ইসরাইল বিরোধী প্রতিরোধ জোট পার্লামেন্টের ১২৮টি আসনের মধ্যে ৬৮টি আসন পেতে সক্ষম হয়। অর্ধেকের বেশি আসন পাওয়ায় প্রমাণিত হয় হিজবুল্লাহর প্রতি ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে।

লেবাননের দৈনিক আল-আখবার পত্রিকা ইরাকের আদেল আব্দুল মাহদি সরকারের পতন ঘটানোর জন্য আমেরিকা, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করে লিখেছে, "আমিরাত ইরাকের সরকারবিরোধী আন্দোলনে মদদদানের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা তাতনুন বিন জায়েদ আল নাহিয়ান এবং তার ফিলিস্তিন বিষয়ক উপদেষ্টা ও ইসরাইলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষাকারী মোহাম্মদ দেহলানের মতো ব্যক্তিরা ইরাকে সরকারবিরোধী বিক্ষোভে মদদ দেয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছেন। ইরাকে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ ধরে রাখার জন্য সৌদি আরব ১৫ কোটি ডলার বরাদ্দ দিয়েছে। সৌদি-আমিরাতি পরিকল্পনা অনুযায়ী ইরাকে সরকারবিরোধী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ময়দানে থাকবে দেশটির নাগরিক আন্দোলনের কর্মীরা এবং তারা অর্থ সহায়তা পাবে আমেরিকার দূতাবাসের মাধ্যমে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে, শুধু চলতি বছর ইরাকে সরকার বিরোধী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এ পর্যন্ত ব্যয় করা হয়েছে ৭০ কোটি ১০ লাখ ডলার।"

এদিকে, গত অক্টোবর থেকে ইরাকে সরকারবিরোধী বিক্ষোভে আমেরিকাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে আমেরিকাও ইরাক সরকারের দুর্নীতির বিষয়টি জোরেসরে তুলে ধরছে অথচ এই আমেরিকা গত ১৬ বছর ধরে ইরাকে অবস্থান করছে এবং ইরাকের কোটি কোটি ডলারের তেল সম্পদ লুট করেছে। ব্যাপক আর্থিক সংকটে সরকার যখন হাবুডুবু খাচ্ছে তখন জনগণের মধ্যে সৃষ্ট অসন্তোষকে ব্যবহার করছে আমেরিকা যাতে ইরাক সরকারের পতন ঘটানো যায়। কারণ ইরাকের বর্তমান সরকার প্রতিরোধকামী সংগঠনগুলোকে সমর্থন দিচ্ছে।

বাইরে থেকে ইরাকে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ ও সহিংসতায় উস্কানি দিয়ে যাচ্ছে আমেরিকা ও সৌদি আরবের নিয়ন্ত্রিত প্রচার মাধ্যমগুলো। এমনকি তারা জনপ্রিয় ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় শীর্ষ ধর্মীয় নেতাদের ও বিভিন্ন ইসলামি সংগঠনের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে জনগণকে তাদের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। মিথ্যা ও বানোয়াট ছবি ও প্রতিবেদন তুলে ধরে জনগণকে নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত হতেও উস্কানি দিচ্ছে এসব প্রচার মাধ্যম।

মার্কিন টিভি চ্যানেল আল হোররা দাবি করেছে, বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলার জন্য জনপ্রিয় হাশদ আশ্‌ শাবি সংগঠন ও তাদের নিরাপত্তা বাহিনীর একটি অংশ দায়ী। এ ধরণের অপপ্রচারের প্রতিক্রিয়ায় আন্‌ নুজবা আন্দোলনের মুখপাত্র নাসরুল শামরি বলেছেন, "ইরাকের জাতীয় ঐক্য এবং জাতিগত ও ধর্মীয় সম্প্রীতি বিনষ্ট করা আমেরিকার প্রধান উদ্দেশ্য। এ ছাড়া ইরাকিদেরকে ইরানের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলাও তাদের অন্যতম লক্ষ্য। তবে ইরাকের সরকার বিদেশি মিডিয়ার অপপ্রচারের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে।"

প্রকৃতপক্ষে, লেবানন ও ইরাকের ভেতরেও বিভিন্ন মহল সৌদি আরব ও আমিরাতের সমর্থন নিয়ে সরকারবিরোধী বিক্ষোভে উস্কানি ও নেতৃত্ব দিচ্ছে এবং তারা এ বিক্ষোভকে সহিংসতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ইরাকের নিষিদ্ধ ঘোষিত বাথ পার্টি ও আল সারখিয়ের মতো গ্রুপের সদস্যরা এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। সাদ্দামের কন্যা সাম্প্রতিক সহিংসতায় নিহতদেরকে বীর হিসেবে অভিহিত করেছেন। এমনকি তারা অপপ্রচারের আশ্রয় নিয়েছে। ইরাকের কর্মকর্তারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে বলেও তারা প্রচার চালাচ্ছে।

বিক্ষোভের সময় গোপন হত্যাকাণ্ডের সঙ্গেও এ মহলটি জড়িত যাতে হত্যার দায় সরকারের ওপর চাপানো যায়। অনুপ্রবেশকারীরা বিক্ষোভকারীদের হত্যা করে তার দায় চাপাচ্ছে সরকারের নিরাপত্তা বাহিনী ও হাশদ আশ্‌ শাবি সংগঠনের ওপর। এ অবস্থায় বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমের ভিডিওতে হত্যাকাণ্ডের সময় বিক্ষোভকারীদেরকে সরকারি নিরাপত্তাবাহিনীর কাছে গিয়ে আশ্রয় নিতে দেখা গেছে। এসব থেকে বোঝা যায় ইরাকের অভ্যন্তরীণ সংকটকে কাজে লাগিয়ে দেশটির ভেতরে ও বাইরের বিভিন্ন মহল তাদের স্বার্থ হাসিল করার চেষ্টা করছে।#

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/৯