মাদুরোর বিরুদ্ধে মার্কিন নতুন পদক্ষপের লক্ষ্যগুলো কী?
https://parstoday.ir/bn/news/world-i151046
পার্সটুডে-ওয়াশিংটন ঘোষণা করেছে যে ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোকে গ্রেপ্তারে সহায়তাকারী তথ্যের জন্য তারা ৫০ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার নির্ধারণ করেছে।
(last modified 2025-08-09T12:18:16+00:00 )
আগস্ট ০৯, ২০২৫ ১৫:৪১ Asia/Dhaka
  • ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো
    ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো

পার্সটুডে-ওয়াশিংটন ঘোষণা করেছে যে ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোকে গ্রেপ্তারে সহায়তাকারী তথ্যের জন্য তারা ৫০ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার নির্ধারণ করেছে।

পার্স টুডে জানিয়েছে, মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল পাম বান্ডি বৃহস্পতিবার সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি বার্তায় লিখেছেন: "নিকোলাস মাদুরো মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। আমেরিকা মাদুরোর সাথে সম্পর্কিত ৭০০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি সম্পদ জব্দ করেছে যার মধ্যে রয়েছে দুটি বিমান এবং নয়টি যানবাহন।" ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে তার অভিযোগে তিনি দাবি করেছেন: "মাদুরো বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ মাদক পাচারকারী এবং তার সন্ত্রাসী শাসন অব্যাহত রয়েছে, তিনি ট্রেন ডি আরাগুয়া ও সিনালোয়া কার্টেলের মতো গোষ্ঠীগুলোর সাথে সহযোগিতা করে চলেছেন।" বান্ডি তার হুমকির শেষাংশে বলেছেন, "মাদুরোকে বিচারের মুখোমুখি করা হবে এবং তার জঘন্য অপরাধের জন্য তাকে জবাবদিহির আওতায় আনা হবে ও শাস্তি দেয়া হবে।"

এর আগে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ঘোষণা করেছিল যে মাদুরোর সাথে সম্পর্কিত যেকোনো তথ্যের জন্য তারা ২৫ মিলিয়ন ডলার পুরস্কারের প্রস্তাব দিয়েছে। মাদুরোর বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন পদক্ষেপ ভেনেজুয়েলাকে তীব্র ক্ষুব্ধ করেছে। ভেনেজুয়েলার কর্মকর্তারা মাদুরোকে গ্রেফতারের সহায়ক তথ্য দেয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথিত ৫০ মিলিয়ন ডলার পুরস্কারে নির্ধারণের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছেন, এটি রাজনৈতিক প্রচারণা এবং 'ল্যাটিন আমেরিকান দেশটির সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন'। তারা এই পদক্ষেপকে "হাস্যকর," "নির্লজ্জ" এবং "জাতীয় সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন" বলে উল্লেখ করেছেন।

ভেনেজুয়েলার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইভান খেল শুক্রবার টেলিগ্রামে একটি নোটে লিখেছেন: "মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল পাম বান্ডির সংকীর্ণমনা পুরষ্কার হল সবচেয়ে অর্থহীন প্রতারণা যা উদ্বেগ সৃষ্টি করে।" ভেনেজুয়েলা যখন মার্কিন সন্ত্রাসের চক্রান্ত ফাস করেছে, তখন এই মহিলা ভেনেজুয়েলার পরাজিত অতি-ডানপন্থীদের জন্য একটি সার্কাস তৈরি করেছেন।

ভেনেজুয়েলার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেছেন, এই নাটকটি আমেরিকার অভ্যন্তরীণ সমস্যা থেকে মনোযোগ অন্যদিকে সরানোর উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। তিনি এই পুরস্কারের নিন্দা জানিয়ে বলেন, এটি "নির্লজ্জ রাজনৈতিক প্রচারণা" এবং ভেনেজুয়েলার মর্যাদা বিক্রি করা সম্ভব নয়।

অন্যদিকে ভেনেজুয়েলার অ্যাটর্নি জেনারেল তারিক উইলিয়াম সাবও মাদুরোকে গ্রেপ্তারের জন্য কথিত "হাস্যকর এবং নির্লজ্জ" মার্কিন পুরষ্কার ঘোষণার নিন্দা জানিয়ে বলেছেন: "এই নির্লজ্জ কাজ আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন, আমাদের সার্বভৌমত্বের উপর আক্রমণ এবং একটি সার্বভৌম দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে স্পষ্ট হস্তক্ষেপ।"

এটা স্পষ্ট মার্কিন এই পদক্ষেপের লক্ষ্য একাধারে রাজনৈতিক ও একাধারে সামরিক। একদল বিশ্লেষক মনে করেন যে এই পদক্ষেপটি আমেরিকার অভ্যন্তরীণ সমস্যা থেকে মনোযোগ সরিয়ে তার সমর্থকদের মধ্যে ট্রাম্পের ভাবমূর্তি বৃদ্ধির একটি রাজনৈতিক প্রদর্শনী।

এই ধরনের পুরষ্কার নির্ধারণের মাধ্যমে ট্রাম্প প্রশাসন আশা করে যে মাদুরো সম্পর্কে তথ্য জানে এমন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানগুলো পুরষ্কারের জন্য আবেদন করবে। আর এভাবে তারা আশা করছে যে মাদুরোর গোপন সম্পর্ক বা যোগাযোগগুলো সম্পর্কে তথ্য বেরিয়ে আসবে।

এইসব পদক্ষেপকে ট্রাম্প প্রশাসনের মাদুরোর বিরোধীদের সমর্থন এবং ভেনেজুয়েলায় শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের প্রচেষ্টার পূর্ববর্তী নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলেও দেখা হচ্ছে। এই ক্ষেত্রে ট্রাম্প প্রশাসনের আরেকটি লক্ষ্য হল মাদুরোর উপর রাজনৈতিক চাপ বৃদ্ধি করা। উল্লেখ্য, ভেনিজুয়েলা ইসলামী ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র। তাই ইরান-কেন্দ্রীক প্রতিরোধ-অক্ষ ও  এ অঞ্চলে ইরানের মিত্রদের ওপর চাপ সৃষ্টিও এইসব পদক্ষেপের অন্যতম উদ্দেশ্য। 

কিন্তু মার্কিন এইসব পদক্ষেপ হতে পারে মাদুরোর জন্য শাপে বর। ট্রাম্পের প্রত্যাশার বিপরীতে মাদুরোর প্রতি তার দেশের সশস্ত্র বাহিনী ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলোর আনুগত্য আরও বেড়ে যাবে। সাধারণত বিদেশী হুমকির মুখে দেশীয়দের এক্য জোরদার হয়। মাদুরো সরকার "সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের" ডিসকোর্সকে শক্তিশালী করার জন্যও এই পদক্ষেপটি ব্যবহার করেছে এবং এটিকে "ভেনিজুয়েলার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে স্পষ্ট আমেরিকান হস্তক্ষেপের" প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেছে।

অন্যদিকে এমন পরিস্থিতিতে যেখানে ভেনেজুয়েলার জনগণ অর্থনৈতিক সমস্যা ও নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হচ্ছে, তখন তারা এই মার্কিন পদক্ষেপকে এক ধরণের "জাতীয় অবমাননা" বলে মনে করেন এবং মাদুরোকে আরও বেশি সমর্থন করছেন।এদিকে, মাদুরো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন ওয়ান্টেড ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠার সাথে সাথে ভেনেজুয়েলার অভ্যন্তরে ওয়াশিংটনপন্থী আন্দোলনগুলোর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর আরও বেশি বিধি-নিষেধের আরোপ করা হবে। মোটকথা এসব মার্কিন শত্রুতা মাদুরোকে নিজ দেশে দুর্বল তো করেইনি বরং তাকে করেছে আরও বেশি শক্তিশালী। 

এইসব মার্কিন পদক্ষেপ ভেনেজুয়েলা ও আশপাশের দেশগুলোতে অস্থিরতাসহ নানা সংকট সৃষ্টি করতে পারে। যেমন, ব্রাজিল ও কলম্বিয়াসহ আশপাশের দেশেগুলোতে অভিবাসীদের আগমন বৃদ্ধি এবং এর ফলে তাদের নিরাপত্তা ও সামাজিক কাঠামোতে চাপ পড়া। ভেনিজুয়েলায় ক্ষমতার শূন্যতা দেখা দিলে দৌরাত্ম বাড়বে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর ও মাদক চোরাকারবারিদের। ফলে গোটা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বে নিরাপত্তার সংকট। এ ছাড়াও গোটা অঞ্চল মাদুরোর সমর্থক ও মার্কিন সমর্থক এ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়তে পারে। ফলে আঞ্চলিক সহযোগিতার কাজগুলো মুখ থুবড়ে পড়বে। 

এইসব একতরফা মার্কিন পদক্ষেপ UNASUR এবং CELAC-এর মতো আঞ্চলিক জোটগুলোর উপর আস্থা নষ্ট করতে পারে। অথচ এই জোটগুলো রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা সংকট সমাধানের লক্ষ্যে গড়ে উঠেছে। কিন্তু এক্ষেত্রে এইসব দুর্বলতা আঞ্চলিক দেশগুলোকে অভিন্ন হুমকির মোকাবেলায় কার্যকর সমন্বয়ে বাধা সৃষ্টি করবে।

এছাড়াও সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতে রাশিয়া, ইরান, কিউবা ও চীনের মতো দেশগুলো মাদুরোকে সমর্থন করতে এগিয়ে আসতে পারে। ওদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা মাদুরোর বিরোধীদের সমর্থন করে। এই ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা আঞ্চলিক নিরাপত্তাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। বহুকেন্দ্রিক মেরুকরণও ব্যহত হতে পারে এই একই প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে। 

এই ধরনের একতরফা পদক্ষেপের মাধ্যমে ট্রাম্প জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক আইনি সংস্থাগুলির মতো প্রতিষ্ঠানগুলিকে উপেক্ষা করেছেন এবং সরাসরি চাপের উপর বেশি নির্ভর করেছেন। এই পদ্ধতি আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার উপর বিশ্বব্যাপী আস্থা হ্রাস করবে।

এই প্রেক্ষাপটে আরেকটি বিষয় হল মার্কিন পররাষ্ট্র নীতিতে জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি শক্তিশালী হওয়া। মাদুরোর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ "আমেরিকা ফার্স্ট বা আমেরিকা প্রথম " নীতির কাঠামোর মধ্যে পড়ে যা বহুপাক্ষিক শক্তির মধ্যে লেনদেনের চেয়েও মার্কিন জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়। ফলে মার্কিন মিত্ররাও ওয়াশিংটনের আন্তরিকতা নিয়ে সন্দিহান হবে। 

মাদুরোকে গ্রেফতারের সহায়ক তথ্য দেয়ার বিনিময়ে ৫০ মিলিয়ন ডলারের পুরস্কার ঘোষণা গোটা বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য বিরোধী নেতাদের কাছে এ স্পষ্ট বার্তা দেয় যে, ওয়াশিংটনের নীতির বিরোধিতা করলে তাদেরকেও হয়ত একই ধরণের পদক্ষেপের মুখোমুখি হতে হবে। #

 

পার্সটুডে/এমএএইচ/০৯

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।