আন্তর্জাতিক চাপেই কি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মুখ খুলল মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর?
https://parstoday.ir/bn/news/world-i151148
পার্সটুডে : মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সাম্প্রতিক বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি সহিংসতা ও দমন-পীড়নের বিষয়টি স্বীকার করা হয়েছে।
(last modified 2025-08-13T13:01:58+00:00 )
আগস্ট ১৩, ২০২৫ ১৭:৪২ Asia/Dhaka
  • ইসরায়েলি সেনাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন ফিলিস্তিনি নারী
    ইসরায়েলি সেনাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন ফিলিস্তিনি নারী

পার্সটুডে : মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সাম্প্রতিক বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি সহিংসতা ও দমন-পীড়নের বিষয়টি স্বীকার করা হয়েছে।

পার্স টুডে'র প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ২০০৫ সালের পর পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের সহিংসতা প্রতিদিনের গড়ে হিসেবে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এতে আরও বলা হয়েছে, ইসরাইল বা তার এজেন্টদের হাতে ফিলিস্তিনিদের গুম হওয়ার খবরও পাওয়া গেছে, যাদের বেশিরভাগই গাজায় সামরিক অভিযানে গ্রেফতারের পর ইসরাইলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

আল জাজিরা এই প্রতিবেদনের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করেছে এবং এটিকে ওয়াশিংটনের ইসরায়েল-সংক্রান্ত অবস্থানে পরিবর্তনের ইঙ্গিত হিসেবে দেখেছে। অপরদিকে, কিছু ইসরায়েলি গণমাধ্যম এই বিষয়টিকে উপেক্ষা করেছে, আবার কিছু গণমাধ্যম এটিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্কের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করেছে। অন্যদিকে, হামাস ও ইসলামিক জিহাদসহ ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলো এই প্রতিবেদনকে নিজেদের সংগ্রামের বৈধতা প্রমাণের জন্য গণমাধ্যমে ব্যবহার করছে।

এই প্রতিবেদন এমন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে যখন জাতিসংঘের সহকারী মুখপাত্র ফারহান হক জানিয়েছেন, জাতিসংঘের মানবিকবিষয়ক সমন্বয় অফিস (ওসিএইচএ) পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি সেনা ও অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতা অব্যাহত থাকার কথা জানিয়েছে, যেখানে বসতি স্থাপনকারীদের হামলার ঘটনা বাড়ছে। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, গত সপ্তাহে অন্তত ২৪টি ঘটনায় বসতি স্থাপনকারীরা ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা চালিয়েছে, যাতে হতাহত ও আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। জাতিসংঘ পশ্চিম তীর, বিশেষ করে জেরুজালেমে বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেছে।

মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কেন এবার ফিলিস্তিনিদের দমন-পীড়নের বিষয়টি স্বীকার করল—এর কয়েকটি কারণ রয়েছে।

প্রথমত, পশ্চিম তীরে সহিংসতা ব্যাপকভাবে বেড়েছে; দৈনিক সহিংসতার মাত্রা ২০০৫ সালের পর সর্বোচ্চ।

দ্বিতীয়ত, ফিলিস্তিনিদের গুম ও গ্রেফতারের তথ্যপ্রমাণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে; সামরিক অভিযানের সময় গ্রেফতার করে ইসরায়েলে স্থানান্তরের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে।

তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক সংস্থার চাপ; জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো বহুবার ইসরায়েলি সেনা ও বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতার বিষয়ে সতর্ক করেছে। এমনকি জাতিসংঘ মহাসচিব ইসরায়েলি কারাগারে যৌন সহিংসতার সম্ভাবনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

চতুর্থত, বৈশ্বিক জনমত; স্বাধীন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রসারের ফলে বিশ্ব জনমত ফিলিস্তিনিদের পরিস্থিতি নিয়ে আরও সংবেদনশীল হয়েছে এবং সরকারগুলো বাধ্য হয়েছে প্রতিক্রিয়া জানাতে। এই স্বীকৃতি যদিও অনেক দেরিতে এসেছে, তবুও দখলকৃত ফিলিস্তিনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জবাবদিহিতার জন্য ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক চাপের প্রতিফলন।

এই প্রতিবেদনের প্রভাব কয়েকটি দিক থেকে লক্ষণীয়:

যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে কংগ্রেসের কিছু সদস্য ও মানবাধিকার সংগঠন সামরিক ও কূটনৈতিক সহায়তা পুনর্বিবেচনার দাবি তুলেছে। সাম্প্রতিক বিবৃতিগুলোতে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভাষা আরও সতর্ক ও সমালোচনামূলক হয়েছে, বিশেষ করে বসতি স্থাপন ও বেসামরিক জনগণের ওপর হামলার বিষয়ে।

আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে, এই প্রতিবেদনের পর ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন বেড়েছে। জাতিসংঘ যৌন সহিংসতার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে। জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদ ইসরায়েলের গুম, নির্বিচার গ্রেপ্তার ও যৌন সহিংসতার তদন্তে সত্য-উদ্ঘাটন কমিটি গঠনের দাবি জানিয়েছে। ইরান, তুরস্ক ও কাতারসহ বিভিন্ন দেশ এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে ইসরায়েলের মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ তুলে ধরেছে।

এছাড়া, কিছু দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা ইসরায়েলের সহিংসতার ওপর স্বাধীন তদন্তের দাবি তুলেছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতিকে সমর্থন করেছে এবং ইসরায়েলের মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিন্দা জানিয়েছে। কিছু ইউরোপীয় দেশ পশ্চিম তীর ও গাজার সহিংসতা নিয়ে স্বাধীন তদন্তের দাবি জানিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বেসামরিকদের অধিকার রক্ষার ওপর জোর দিয়েছে এবং বসতি স্থাপন ও বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। ইউরোপীয় সংসদের কিছু বামপন্থি দল ইসরায়েলের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা, বিশেষত অস্ত্র রপ্তানি পুনর্বিবেচনার দাবি তুলেছে। এটি প্রমাণ করে যে, ইউরোপের ঐতিহ্যগত মিত্ররাও জনমত ও মানবাধিকার প্রতিবেদনের চাপে আর নীরব থাকতে পারছে না।

বিশ্বব্যাপী, এই প্রতিবেদন পশ্চিমা দেশগুলোর জনমতকে ফিলিস্তিনিদের অবস্থা নিয়ে আরও সচেতন করেছে। মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়ের সংগঠনগুলো যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে সরকারগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করছে যাতে তারা ইসরায়েলকে নিঃশর্ত সমর্থন বন্ধ করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সহমর্মিতার ঢেউ উঠেছে এবং #FreePalestine হ্যাশট্যাগ আবার ট্রেন্ড হয়েছে।

যদিও এই স্বীকৃতি স্বচ্ছতার দিক থেকে ইতিবাচক বলে ধরা হচ্ছে, তবুও অনেক আঞ্চলিক পক্ষ এখন যুক্তরাষ্ট্রকে নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারী মনে করছে না এবং তাদের মধ্যস্থতার ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ করছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো যুক্তরাষ্ট্রকে শুধু প্রতিবেদন প্রকাশে সীমাবদ্ধ না থেকে বাস্তব পদক্ষেপ নিতে বলছে—যেমন সামরিক সহায়তা বন্ধ করা বা স্বাধীন তদন্তকে সমর্থন করা। যুক্তরাষ্ট্র এখন পশ্চিম এশিয়ায় প্রভাব ধরে রাখতে তুলনামূলক ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান নিতে বাধ্য হচ্ছে এবং কিছু ক্ষেত্রে ইসরায়েলকে যুদ্ধবিরতি মেনে চলার কথা বলছে।

সব মিলিয়ে, এই স্বীকৃতি শুধু কূটনৈতিক পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করেনি, বরং যুক্তরাষ্ট্রকে এমন অবস্থানে দাঁড় করিয়েছে যেখানে তাকে ইসরায়েলের প্রতি ঐতিহ্যগত সমর্থন ও মানবাধিকার রক্ষার বৈশ্বিক দাবি—এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে হচ্ছে। যদিও ট্রাম্প প্রশাসনের প্রথম মেয়াদ ও দ্বিতীয় মেয়াদের অবস্থান থেকে বোঝা যায়, পশ্চিম এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের নীতির কেন্দ্রবিন্দু এখনো ইসরায়েলকে নিঃশর্ত ও সর্বাত্মক সমর্থন দেওয়া।#

পার্সটুডে/এমএআর/১২