জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কি ভেটো ফাঁদে আটকা পড়েছে?
-
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কি ভেটো ফাঁদে আটকা পড়েছে?
পার্সটুডে–জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের ক্ষমতার ক্ষেত্রে ভেটো হল সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয়গুলির মধ্যে একটি।
পার্সটুডে আরও জানায়, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য দেশ (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্য) ভেটো ক্ষমতা ধারণ করে। ওই ক্ষমতার মাধ্যমে তাদের প্রত্যেককে কাউন্সিলের যে-কোনো প্রস্তাব বা কার্যকরী সিদ্ধান্তকে ব্লক করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। যদিও এর সমর্থকরা এটিকে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার এবং বৃহৎ শক্তির মধ্যে সংঘাত রোধ করার একটি হাতিয়ার হিসেবে দেখে, তবে অনেকগুলো জোরালো কারণ রয়েছে যেগুলো প্রমাণ করে ভেটো শক্তি অন্যায্য। রাষ্ট্রের সমতা, জবাবদিহিতা এবং আইনের শাসনের মৌলিক নীতিগুলির পরিপন্থী। সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা করে দেখা যাক।
১. রাষ্ট্রগুলোর সমান সার্বভৌমত্বের নীতির লঙ্ঘন
জাতিসংঘ সনদের ভিত্তি "সকল সদস্যের সমান সার্বভৌমত্ব" এর উপর ভিত্তি করে গঠিত। তবে, ভেটো মৌলিকভাবে এই নীতির লঙ্ঘন। এই বিশেষ অধিকার বিশ্বকে দুটি দলে বিভক্ত করে: পাঁচটি "প্রথম শ্রেণীর" দেশ যাদের আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ আটকানোর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা রয়েছে এবং অন্যান্য ১৮৮টি জাতিসংঘ সদস্য দেশের সার্বভৌমত্ব ওই পাঁচ শক্তির তুলনায় অসম্পূর্ণ এবং সীমিত। এই ব্যবস্থা বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রস্থলে একটি অলিগার্কি কাঠামো তৈরি করেছে, যেখানে পাঁচটি দেশের জাতীয় স্বার্থ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছা এবং ইচ্ছার চেয়ে অগ্রাধিকার পায়। অলিগার্কি বলতে বোঝায় মুষ্টিমেয় লোকের শাসনকে।
২. সংকটকালে প্রয়োজনীয় আন্তর্জাতিক পদক্ষেপকে পঙ্গু করে দেওয়া
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ইতিহাস প্রমাণ করে যে অনেক ক্ষেত্রে, নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যরা মানবিক বিপর্যয় রোধ, যুদ্ধ বন্ধ করা বা অপরাধীদের বিচারের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ থেকে কাউন্সিলকে বিরত রাখতে তাদের ভেটো ক্ষমতা ব্যবহার করেছেন। ঐতিহাসিক উদাহরণ এই অবিচারের চিত্র তুলে ধরে। নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের মধ্যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অন্য যে-কোনো সময় বা দেশের চেয়ে তার ভেটো ক্ষমতা বেশি ব্যবহার করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৫ থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ৮৯ বার নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবগুলোতে ভেটো দিয়েছে, যার মধ্যে ৪৫টি ইহুদিবাদী ইসরাইলের সাথে সম্পর্কিত ছিল।
ফিলিস্তিন সংকট: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার কৌশলগত মিত্র ইসরাইলকে রক্ষা করার জন্য ধারাবাহিকভাবে তার ভেটো ক্ষমতা ব্যবহার করেছে এবং বসতি স্থাপন কার্যক্রম বন্ধের জন্য নিন্দা বা আহ্বান জানানোর যে-কোনো প্রস্তাব আটকে দিয়েছে। এদিকে, দুই বছরের গাজা যুদ্ধের সময়, ওয়াশিংটন বারবার ইহুদিবাদী ইসরাইলের নিন্দা বা এই যুদ্ধের অবসানের আহ্বান রোধ করার জন্য তার ভেটো ক্ষমতা ব্যবহার করেছে।
রুয়ান্ডা সংকট: ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডা গণহত্যার সময়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শান্তিরক্ষা মিশনকে শক্তিশালী করার এবং হত্যাকাণ্ড রোধ করার জন্য প্রস্তাব পাস করতে অস্বীকৃতি জানায়, যার ফলে বিপর্যয় আরও বেড়ে যায়।
এইসব ঘটনা প্রমাণ করে কীভাবে একটি দেশের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ হাজার হাজার এমনকি লক্ষ লক্ষ নিরীহ জীবন বাঁচাতে বাধা দিতে পারে।
৩. জবাবদিহিতা থেকে মুক্তি এবং আইনের শাসনকে দুর্বল করা
ভেটো ক্ষমতা পাঁচটি পারমাণবিক শক্তিকে কার্যকরভাবে প্রতিরোধ ক্ষমতা দেয়। তারা নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে কোনও আনুষ্ঠানিক আন্তর্জাতিক পদক্ষেপের ভয় ছাড়াই কাজ চালিয়ে যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন আক্রমণ। ব্যাপক আন্তর্জাতিক নিন্দা সত্ত্বেও, ভেটো ক্ষমতা ব্যবহারের সম্ভাব্যতার কারণে তারা কখনও নিরাপত্তা পরিষদের কাছ থেকে শক্তিশালী কোনো প্রস্তাবের মুখোমুখি হয় নি। এ বিষয়টি আইনের শাসনের নীতিকে ক্ষুণ্ন করে, যা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার ভিত্তিপ্রস্তর, এবং একটি স্পষ্ট বার্তা দেয়, তা হলো: ক্ষমতাবানরা আইনের উর্ধ্বে।
৪. ১৯৪৫ সালের বিশ্বশক্তি কাঠামোর প্রতিচ্ছবি, সমসাময়িক বিশ্বের নয়।
ভেটো হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ক্ষমতা ব্যবস্থার একটি প্রতীক। আজকের বিশ্ব এই প্রতিষ্ঠান গঠনের বছর ১৯৪৫ সালের বিশ্বের সাথে তুলনীয় নয়। ভারত, ব্রাজিল, জার্মানি, জাপান, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং নাইজেরিয়ার মতো নতুন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তির উত্থান, আফ্রিকান ইউনিয়নের মতো ইউনিয়নগুলোর ক্রমবর্ধমান ভূমিকার সাথে, নিরাপত্তা পরিষদের কাঠামোর সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা আগের চেয়ে আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পাঁচটি দেশের হাতে ক্ষমতার একচেটিয়া আধিপত্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রকৃত প্রতিনিধিত্বকে অস্বীকার করে এবং নিরাপত্তা পরিষদ ও জাতিসংঘের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে।
৫. সম্মিলিত স্বার্থের বিনিময়ে জাতীয় স্বার্থকে এগিয়ে নেওয়ার একটি হাতিয়ার
তত্ত্বগতভাবে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাধারণ স্বার্থ নিশ্চিত করার এবং একতরফা পদক্ষেপ রোধ করার জন্য ভেটো ক্ষমতা তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে, এটি প্রায় সবসময়ই ভেটো ক্ষমতাধারী দেশগুলির জাতীয় স্বার্থকে এগিয়ে নেওয়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি বহুপাক্ষিকতার প্রকৃতিকে ক্ষুণ্ন করে এবং নিরাপত্তা পরিষদকে বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধানের জায়গা না করে বৃহৎ শক্তির প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র হিসেবে পরিণত করেছে।
উপসংহার
নতুন আন্তর্জাতিক উন্নয়নের সাথে সামঞ্জস্য রেখে জাতিসংঘের কাঠামোগত পরিবর্তন আনা এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে পাঁচটি আন্তর্জাতিক শক্তির ভেটো ক্ষমতা বাতিল করার বিষয়টি এই বৃহত্তম আন্তর্জাতিক সংস্থাটির সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার ক্ষেত্রে উত্থাপিত সবচেয়ে গুরুতর বিষয়গুলোর একটি বলে বিবেচিত হয়। প্রকৃতপক্ষে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মৌলিক উন্নয়ন এবং উদীয়মান শক্তির উত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে, অনেক দেশ আঞ্চলিক ভিত্তিতে এবং অনুরূপভাবে নিরাপত্তা পরিষদে নতুন স্থায়ী সদস্যের প্রবেশের আহ্বান জানিয়েছে। অন্যদিকে, বর্তমান কাঠামোয় ভেটো ক্ষমতা অন্যায্য, অগণতান্ত্রিক এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপকে বাধাগ্রস্ত করে, সমতা, জবাবদিহিতা ও আইনের শাসনের নীতি লঙ্ঘন করে এবং অতীতের বিশ্বব্যবস্থার একটি পুরানো কাঠামো তুলে ধরে।
যদিও স্বল্পমেয়াদে ভেটো অধিকার সম্পূর্ণরূপে বাতিল করা অবাস্তব বলে মনে হচ্ছে, কারণ এর জন্য পাঁচটি দেশের নিজস্ব অনুমোদন প্রয়োজন হবে, তাই সংস্কারের জন্য নিম্নলিখিত উপায়গুলো অনুসরণ করা যেতে পারে:
- মানবিক বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে ভেটো ব্যবহারের স্বেচ্ছাসেবী সীমাবদ্ধতা: ভেটো ক্ষমতার অধিকারী দেশগুলো গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং জাতিগত নির্মূল অভিযানের মতো অপরাধের ক্ষেত্রে ভেটো ক্ষমতা ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে সম্মত হতে পারে।
- স্থায়ী সদস্যপদ বৃদ্ধি: নিরাপত্তা পরিষদে আরও প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য স্থায়ী সদস্যপদ বৃদ্ধি করা।
- সাধারণ পরিষদের ভূমিকা বৃদ্ধি: সাধারণ পরিষদের "শান্তির জন্য ঐক্য" প্রস্তাবগুলোকে শক্তিশালী করা, নিরাপত্তা পরিষদ অচল হয়ে পড়ার ক্ষেত্রে যেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করতে পারে।
পরিশেষে, যতক্ষণ পর্যন্ত ভেটো ক্ষমতা তার বর্তমান রূপে থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত জাতিসংঘ সকল জাতির সত্যিকার অর্থে প্রতিনিধিত্ব করার এবং বিশ্বস্তরে ন্যায়বিচার ও সমতা রক্ষা করার দাবি করতে পারবে না। এই বিশেষ অধিকার আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ওপর অবিচারের ছায়া ফেলে এবং জাতিসংঘ সনদে অন্তর্ভুক্ত উচ্চ আদর্শগুলোকে ক্ষুণ্ন করে।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে কাঠামোগত পরিবর্তন আনার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও, বিশেষ করে ভেটো ক্ষমতা বাতিল করে নতুন স্থায়ী সদস্য যুক্ত করার ক্ষেত্রে, বর্তমানে এ বিষয়ে কোনও আশাব্যঞ্জক সম্ভাবনা নেই। এই সমস্যার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে, প্রথমত, নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের এই পরিষদে তাদের ক্ষমতা সীমিত করার বিরোধিতা করা। দ্বিতীয়ত, নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হতে পারে এমন দেশগুলোর বিষয়ে ঐকমত্যের অভাব।#
পার্সটুডে/এনএম/২৯
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।