ভেনেজুয়েলায় ওয়াশিংটনের সামরিক অভিযানের হুঁশিয়ারি, ন্যামের সতর্কবার্তা
-
নিকোলাস মাদুরো ও ডোনাল্ড ট্রাম্প
পার্সটুডে: জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের (ন্যাম) সদস্য দেশগুলো ভেনেজুয়েলায় যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য আগ্রাসনের ব্যাপারে সতর্কতা জারি করেছে।
পার্সটুডের প্রতিবেদন অনুযায়ী, পেন্টাগন যখন ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে সামরিক বিকল্প প্রস্তুত করছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে, তখন ১২০টিরও বেশি দেশের সমন্বয়ে গঠিত ন্যাম জানিয়েছে, 'এ ধরনের যেকোনো হামলা জাতিসংঘ সনদের স্পষ্ট লঙ্ঘন হবে'।
উগান্ডার রাজধানী কাম্পালায় অনুষ্ঠিত ন্যাম–এর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের জরুরি বৈঠক শেষে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ক্যারিবীয় অঞ্চলে উত্তেজনা বৃদ্ধি ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য সামরিক হামলার বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে যেকোনো সামরিক পদক্ষেপ জাতিসংঘ সনদ ও রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং এটি ল্যাতিন আমেরিকা অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি তৈরি করবে।
ন্যাম–এর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা আরও বলেন, “স্বাধীন দেশগুলোর বিরুদ্ধে উসকানিমূলক আচরণ ও বলপ্রয়োগের হুমকি আন্তর্জাতিক সহযোগিতার চেতনার পরিপন্থী এবং এর ফলাফল হবে ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা বৃদ্ধি ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়া।”
তারা যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য সামরিক পদক্ষেপের পরিণতি নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে অবিলম্বে বৈঠক ডাকার আহ্বান জানান।
বিবৃতিতে আন্তর্জাতিক আইন, রাষ্ট্রগুলোর ভৌগোলিক অখণ্ডতা এবং জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রতি সম্মান দেখাতে এবং ভেনেজুয়েলার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলনভুক্ত দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের এই বৈঠক এমন সময় অনুষ্ঠিত হল যখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে উপস্থাপনের জন্য পেন্টাগনের সামরিক প্রস্তুতির প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও ভেনেজুয়েলার ভূখণ্ডে সামরিক হামলার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেননি এবং ভেনেজুয়েলার উপকূলের কাছে নৌকাগুলোর উপর সাম্প্রতিক মার্কিন হামলার কথা উল্লেখ করে বলেন, "আমরা এখন সিরিয়াসলি একটি স্থলভিত্তিক অভিযানের বিকল্পটি গুরুত্বসহ বিবেচনা করছি।"
গত কয়েক সপ্তাহে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক সামরিক হামলায় বেশ কয়েকটি জাহাজ ডুবে গেছে, যেগুলো ভেনেজুয়েলা থেকে মাদক বহন করছিল বলে হোয়াইট হাউস দাবি করেছে।
যখন ট্রাম্পকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে ভবিষ্যতে এই হামলাগুলো ভেনেজুয়েলার মূল ভূখণ্ডকেও লক্ষ্য করতে পারে কিনা, তিনি উত্তর দেন, "আমি আপনাকে ঠিক বলতে চাই না।" কিন্তু তিনি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, স্থলভিত্তিক হামলা একটি বিকল্প "কারণ আমরা সমুদ্র ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করছি।" মার্কিন প্রেসিডেন্ট আরও নিশ্চিত করেছেন যে, তিনি কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (সিআইএ)-কে ভেনেজুয়েলায় অপারেশন চালানোর অনুমতি দিয়েছেন।
ন্যাম ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর এই সতর্কবার্তা মূলত যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি গুরুতর আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের দিকে ইঙ্গিত করছে, বিশেষ করে ক্যারিবীয় সাগরে ভেনেজুয়েলীয় নৌযানগুলোর ওপর হামলার ক্ষেত্রে।
১. জাতীয় সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন
কোনো স্বাধীন দেশের ভূখণ্ডে বা জলসীমায় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন ছাড়া সামরিক অভিযান চালানো আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদের স্পষ্ট লঙ্ঘন।
ভেনেজুয়েলার ভেতরে সামরিক অভিযান পরিকল্পনা করা বা সিআইএ–কে গোপন কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি দেওয়া— উভয়ই আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত।
২. অপ্রয়োজনীয় ও অসম শক্তি প্রয়োগ
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, প্রাণঘাতী শক্তি ব্যবহার কেবল তখনই বৈধ যখন নিজস্ব বাহিনীর প্রতি তাৎক্ষণিক হুমকি থাকে। কিন্তু রিপোর্ট অনুযায়ী, কিছু হামলায় লক্ষ্যবস্তু নৌযান পিছু হটছিল এবং কোনো হুমকি তৈরি করছিল না। ফলে এই হামলা 'প্রয়োজনীয়তা' ও 'অনুপাতিকতা'-এর আন্তর্জাতিক মানদণ্ড লঙ্ঘন করে।
৩. অবৈধ আইনি যুক্তি
ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করছে যে, যুক্তরাষ্ট্র এখন মাদক কার্টেলগুলোর মতো 'অরাষ্ট্রীয় সশস্ত্র গোষ্ঠী'-এর সঙ্গে 'সশস্ত্র সংঘাতে' রয়েছে। এই যুক্তিকে আন্তর্জাতিক আইনের বিতর্কিত ব্যাখ্যা হিসেবে দেখা হচ্ছে, যা বহু আইনি বিশেষজ্ঞের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের হুমকির সম্ভাব্য উদ্দেশ্যসমূহ
১. জ্বালানি সম্পদের দখল: ভেনেজুয়েলা পৃথিবীর বৃহত্তম প্রমাণিত তেলের মজুদের দেশ। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের চূড়ান্ত লক্ষ্য এই সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেওয়া।
২. মনরো নীতির পুনরাবৃত্তি: এই সংকট যুক্তরাষ্ট্রের সেই পুরনো দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন, যা পশ্চিম গোলার্ধে মার্কিন প্রভাব ও হস্তক্ষেপের “অধিকার” দাবি করে।
৩. অভ্যন্তরীণ মনোযোগ সরানো: অনেক মার্কিন বিশ্লেষক মনে করেন, এই সামরিক হুমকি যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট ও বিতর্ক থেকে জনসাধারণের মনোযোগ সরানোর প্রচেষ্টা।
পরিশেষে, এটি বলা যেতে পারে যে, ভেনেজুয়েলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য হামলা সম্পর্কে জোট-নিরপেক্ষ দেশগুলোর সতর্কতা কেবল একটি নৈতিক ও রাজনৈতিক সতর্কতা নয়, বরং এটি আন্তর্জাতিক আইনের সুপ্রতিষ্ঠিত নীতির উপর ভিত্তি করে একটি সতর্কতা এবং একটি নতুন যুদ্ধের ভয়াবহ পরিণতির সঠিক উপলব্ধি। এই সংকট শুধুমাত্র ভেনেজুয়েলায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি সমস্ত উন্নয়নশীল দেশের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে চ্যালেঞ্জ করে। পরিস্থিতির শান্তিপূর্ণ সমাধান ও একতরফা মার্কিন পদক্ষেপ বন্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগ প্রয়োজন। ভেনেজুয়েলার লাখো মানুষের জীবন ও সমগ্র লাতিন আমেরিকা অঞ্চলের স্থিতিশীলতা এখন নির্ভর করছে—বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত ও আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধার ওপর।#
পার্সটুডে/এমএআর/১৬