গাজায় ইউরোপের ভণ্ডামি: মানবাধিকার নাকি ইসরায়েলের সাথে বাণিজ্যই আসল?
-
কায়া কালাস
পার্সটুডে: গাজায় একটি ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতির অজুহাত দেখিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইসরায়েলের সাথে তাদের পছন্দসই বাণিজ্যিক সম্পর্ক পুনরায় শুরু করছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইতোপূর্বে জনগণের চাপের কারণে জায়নবাদী শাসনের সাথে তাদের পছন্দসই বাণিজ্য সীমিত করেছিল। এবার তারা গাজায় প্রতিষ্ঠিত ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতির অজুহাত দেখিয়ে তাদের পছন্দসই বাণিজ্যিক সম্পর্ক সম্পূর্ণরূপে পুনরায় শুরু করেছে।
পার্সটুডে জানিয়েছে, এ বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান "কায়া কালাস" ঘোষণা করেছেন, জায়নবাদী শাসনের সাথে পছন্দসই বাণিজ্য স্থগিত করা এবং গাজা সংঘাতে ইন্ধন দেয়ার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের নিষেধাজ্ঞার চেষ্টা বন্ধ করা হবে। এর ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আগে আরোপ করা ইসরায়েলবিরোধী নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত আবারও ব্রাসেলসকে কঠোর সমালোচনার মুখে ফেলেছে। অন্যদিকে, ইউরোপ-ভূমধ্যসাগরীয় মানবাধিকার সংস্থা ইউরোপীয় ইউনিয়নকে আহ্বান জানিয়েছে যেন তারা ইসরায়েলের ওপর চাপ বজায় রাখে, যাতে ফিলিস্তিনিদের মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ হয়। সংস্থাটি এক বিবৃতিতে বলেছে যে, “ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তি বাতিল ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা ফিলিস্তিনে চলমান গণহত্যা বন্ধের জন্য অপরিহার্য।”
তবে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি এমন নীতি গ্রহণ করেছে যা এই ইউনিয়নের বৈদেশিক নীতির গুরুতর বৈপরীত্য এবং তাদের স্লোগানের মিথ্যা হওয়া ক্রমশ আরও বেশি করে প্রকাশ পাচ্ছে, তারা ইসরায়েলের সাথে আগের মতো সম্পর্ক বজায় রাখার ওপর জোর দিচ্ছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন কয়েক দশক ধরে নিজেকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রধান শক্তি এবং মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার রক্ষক হিসেবে উপস্থাপন করে আসছে। কিন্তু সাম্প্রতিক মাসগুলোতে, গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন ও ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে সংঘটিত নৃশংসতার পর, ইউরোপীয় দেশগুলো জনমতের চাপে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দেয়।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যা গত কয়েক দশক ধরে নিজেকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির একটি প্রধান খেলোয়াড় এবং মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার মতো বিষয়গুলির প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হিসাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছে, গত কয়েক মাস ধরে গাজায় বসবাসরত ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে জায়নবাদী শাসনের বৈরী ও অমানবিক নীতি অবলম্বনের পরিপ্রেক্ষিতে, ইসরায়েলকে নিষেধাজ্ঞা এবং এই শাসনের সাথে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি করেছিল; একটি সিদ্ধান্ত যা ইউরোপীয় দেশগুলিতে জনমতের চাপে ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়েছিল।
গত কয়েক মাস ধরে, বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশের নাগরিকরা ইসরায়েলের প্রতি ইউরোপের সমর্থনমূলক নীতি এবং জায়নবাদী শাসনের জন্য ইউরোপের আর্থিক ও সামরিক সাহায্যের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সমাবেশ করে ইউরোপীয় সরকারগুলোর কাছে ইসরায়েলের সাথে তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার আহ্বান জানিয়েছে। এই চাপের ফল ছিল ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের পশ্চাদপসরণ; যার ফলে স্পেনের মতো কিছু ইউরোপীয় সরকার ঘোষণা করেছিল যে, তারা ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেবে এবং জায়নবাদী শাসনের সাথে তাদের অর্থনৈতিক সম্পর্কও ছিন্ন করবে। কিন্তু এতে যা উপেক্ষিত হয়েছে তা হল এই ইউনিয়নের দ্বিমুখী ও পরস্পরবিরোধী আচরণ; ইউরোপীয় ইউনিয়ন একদিকে মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারভিত্তিক নীতির স্লোগান দেয় এবং অন্যদিকে, কার্যত তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে, এখনও ইসরায়েলের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক অব্যাহত রাখার ইচ্ছা পোষণ করে।
অবশ্য, এই ধরনের বৈপরীত্য শুধুমাত্র ইউরোপের ইসরায়েলের সাথে সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। অনেক সময়, ইউরোপীয় ইউনিয়ন অন্যান্য দেশের মুখোমুখি হয়েও দ্বিমুখী নীতি গ্রহণ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, আফ্রিকার অনেক দেশের ক্ষেত্রে, ইউরোপীয়রা নিজেদের মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের রক্ষক হিসেবে উপস্থাপন করলেও সবচেয়ে খারাপ শোষণ ও গণহত্যা চালিয়েছে। এই দ্বিমুখী নীতি- মানবাধিকার কর্মী ও আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে সমালোচনা বাড়িয়েছে, বরং বিশ্ব অঙ্গনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বৈধতাকেও গুরুতরভাবে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।
এখনও, যখন ব্রাসেলস ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার এবং ইসরায়েলের প্রতি তাদের অবস্থান থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তখন ইউরোপ-ভূমধ্যসাগরীয় মানবাধিকার পর্যবেক্ষক সংস্থার ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিভাগের পরিচালক 'ক্লাউদিও ফ্রানকাভিলা' আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেছেন যে, এখন পর্যন্ত যা পরিবর্তন হয়েছে তা হল- গাজায় ইসরায়েলের জঘন্য অপরাধের মাত্রা ও তীব্রতা; কিন্তু অবৈধ দখল, বর্ণবৈষম্যমূলক অপরাধ, জবরদস্তিমূলক স্থানচ্যুতি, ফিলিস্তিনিদের নির্যাতন ও দমন-পীড়ন এখনও নিরবচ্ছিন্নভাবে অব্যাহত রয়েছে।
বাস্তবে, ইউরোপের নতুন অবস্থান, অর্থাৎ নীতি পরিবর্তন করে ইসরায়েলের সাথে পছন্দসই বাণিজ্যিক সম্পর্কে ফিরে যাওয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সততা ও প্রকৃত লক্ষ্য নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে এই অবস্থা বিশেষভাবে দেখায় যে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন মানবিক নীতি ও মানবাধিকারের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়ার চেয়ে বরং তাদের নিজস্ব স্বার্থের অনুসরণ করে; একটি পদ্ধতি যা মানবাধিকারের সমর্থনে ইউরোপের নীতিগত স্লোগানের সাথে মারাত্মক সাংঘর্ষিক এবং মানবিক ও রাজনৈতিক সংকট মোকাবেলায় এই ইউনিয়নের দুর্বলতাকে নির্দেশ করে। এই দ্বিমুখী ও পরস্পরবিরোধী নীতিসমূহ প্রকৃতপক্ষে ভণ্ডামি ও প্রতারণার পরিচয় দেয়, যা ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও পশ্চিমের আসল চেহারা প্রকাশ করে।#
পার্সটুডে/এমএআর/২২