লাওসে যুক্তরাষ্ট্রের গোপন যুদ্ধ: ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ বোমা হামলা
-
লাওসে মার্কিন ক্লাস্টার বোমার শিকারদের একজন
পার্সটুডে: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি ক্ষুদ্র স্থলবেষ্টিত দেশ লাওস, ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গোপন ও রক্তপাতপূর্ণ সামরিক অভিযানগুলোর একটির কেন্দ্রে পরিণত হয়।
পার্সটুডে জানিয়েছে, লাওসের অবস্থান ভিয়েতনামের পাশে হওয়ায় দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত “ডমিনো তত্ত্বে” কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কমিউনিজমের বিস্তার ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রকে সর্বাত্মকভাবে হস্তক্ষেপ করতে হতো।
ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লাওসে ইতিহাসের অন্যতম 'বৃহৎ গোপন সামরিক অভিযান' পরিচালনা করে, যা বিংশ শতাব্দীর অন্যতম বৃহৎ যুদ্ধাপরাধে পরিণত হয়। লক্ষ্য ছিল উত্তর ভিয়েতনামের সরবরাহপথ “হো চি মিন ট্রেইল” ধ্বংস করা এবং কমিউনিস্ট পাথেট লাও গোষ্ঠীকে দমন করা। কিন্তু বাস্তবে এই অভিযান পরিণত হয় ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ে—যেখানে অসংখ্য সাধারণ মানুষ প্রাণ হারান এবং গোটা দেশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।
সিআইএ'র গোপন অভিযান ও নজিরবিহীন বোমাবর্ষণ
১৯৬৪ থেকে ১৯৭৩ সালের মধ্যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লাওসের উপর ২.৫ মিলিয়ন টন বোমা নিক্ষেপ করে; অর্থাৎ প্রতি ৮ মিনিটে একবার, টানা ৯ বছর ধরে। এই পরিমাণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিক্ষিপ্ত মোট বোমার চেয়েও বেশি। সিআইএ'র দ্বারা পরিচালিত এই অভিযানটি 'গোপন যুদ্ধ' নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৭৫ সাল নাগাদ, লাওসের মোট জনসংখ্যার এক-দশমাংশ, অর্থাৎ প্রায় ২০০,০০০ বেসামরিক নাগরিক ও সামরিক বাহিনীর সদস্য তাদের জীবন হারায়। আহতের সংখ্যা ছিল এর দ্বিগুণ। প্রায় ৭৫০,০০০ মানুষ, যা দেশের মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ, বাস্তুচ্যুত হয়। এই অপরাধগুলোর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হল 'জিয়াংখুয়াং' এবং 'সাভানাখেট' প্রদেশে হামলা, যেখানে শত শত গ্রাম সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায় এবং হাজার হাজার মানুষ নিহত বা বাস্তুচ্যুত হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি অপরাধ ছিল আধা-সামরিক গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন এবং স্থল অভিযান পরিচালনার জন্য স্থানীয় বাহিনী ব্যবহার করা, যা জাতিগত নির্মূলকরণ এবং হমং জনগণের গণহত্যার দিকে নিয়ে যায়; একটি জাতিগোষ্ঠী যারা পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সহযোগিতার জন্য প্রতিশোধের শিকার হয় এবং তাদের হাজার হাজার মানুষকে দেশত্যাগে বাধ্য হয়।
ক্লাস্টার বোমা ও মৃত্যুর ভয়াবহ উত্তরাধিকার
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, লাওসের উপর নিক্ষিপ্ত মোট বোমার মধ্যে প্রায় ৮০ মিলিয়ন ক্লাস্টার বোমা (যা বিস্ফোরিত হয়নি) দেশটির মাটিতে থেকে গেছে। এই বোমাগুলো এখনও মানুষের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলছে এবং হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু বা পঙ্গুত্বের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে; বিশেষ করে শিশু এবং কৃষকরা যারা দূষিত জমিতে কাজ করে।
রিপোর্ট অনুযায়ী, লাওসের এক-তৃতীয়াংশ জমি এই বিস্ফোরিত হয়নি এমন গোলাবারুদের কারণে দূষিত এবং এটি সম্পূর্ণরূপে পরিষ্কার করতে দশক পেরিয়ে যেতে পারে। ১৯৭৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত, এই বোমার বিস্ফোরণে ২০,০০০-এরও বেশি মানুষ নিহত বা আহত হয়েছে, যাদের অনেকেই ছিল শিশু যারা খেলাধুলা বা কৃষিকাজের সময় এই গোলাবারুদের সংস্পর্শে এসেছে।
মানবিক ও সামাজিক প্রভাব
বোমা বর্ষণের পাশাপাশি ধ্বংস হয়েছে লাওসের অবকাঠামো। স্কুল, হাসপাতাল, সেতু, কৃষিজমি—সবকিছুই বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। হাজার হাজার পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়, গ্রামাঞ্চল হয়ে পড়ে অনুর্বর। এই মানবিক বিপর্যয় শুধু ইতিহাস নয়—এখনও প্রতিদিনের বাস্তবতা। যুদ্ধের শেষের অর্ধশতাব্দী পরও দেশটি লড়ছে তার মাটিতে পোঁতা বোমাগুলোর সঙ্গে।
অস্বীকার, নীরবতা ও অন্তর্নিহিত স্বীকৃতি
বছরের পর বছর ধরে, মার্কিন সরকার এই অপরাধগুলোর দায় স্বীকার করতে অস্বীকার করে। ২০১৬ সালে, বারাক ওবামা প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে লাওস সফর করেন এবং এই ট্র্যাজেডিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার প্রতি পরোক্ষভাবে ইঙ্গিত করেন, কিন্তু কোনো আনুষ্ঠানিক ক্ষমা বা পূর্ণ ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হয়নি। তিনি বিস্ফোরিত হয়নি এমন বোমা পরিষ্কারের জন্য অতিরিক্ত ৯০ মিলিয়ন ডলার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন; এই অর্থ আগের ১০০ মিলিয়ন ডলার সাহায্যের সাথে যুক্ত হয়। তা সত্ত্বেও, বোমাবর্ষণের তিক্ত উত্তরাধিকার থেকে লাওসের মাটি পরিষ্কারের কঠিন প্রক্রিয়া এখনও চলছে।
যে ক্ষত এখনও শুকায়নি
লাওসে যুক্তরাষ্ট্রের এই অভিযান যুদ্ধের ভয়াবহতা ও পরোক্ষ আগ্রাসনের এক জ্বলন্ত উদাহরণ। দেশটি আজও সেই “গোপন যুদ্ধ”-এর ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে—অবিস্ফোরিত বোমা, বাস্তুচ্যুত মানুষ ও অনিরাপদ জমি আজও প্রমাণ দিচ্ছে যে, গোপন যুদ্ধগুলো কখনও প্রকাশ্য যুদ্ধের চেয়ে কম বিধ্বংসী নয়।#
পার্সটুডে/এমএএআর/২৭