নভেম্বর ২৭, ২০২১ ১৭:২৪ Asia/Dhaka

রংধনু আসরের কাছের ও দূরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছো তোমরা? আশা করি পরিবারের সবাইকে নিয়ে ভালো ও সুস্থ আছো। আজকের আসরে তোমাদের স্বাগত জানাচ্ছি আমি গাজী আব্দুর রশিদ এবং আমি আকতার জাহান।

আকতার জাহান: বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই বিচক্ষণতা শব্দটির সাথে পরিচিতি। এর অর্থ হচ্ছে- 'অভিজ্ঞ ও বুদ্ধিমান, দূরদর্শী বা কর্মকুশল'। বিচক্ষণ মানুষ যেকোনো পরিবেশে নিজেদের মেজাজ ঠাণ্ডা রাখেন এবং বলার চেয়ে শোনা ও জানার প্রতি  গুরুত্ব দেন। একজন বিচক্ষণ মানুষ যেসব কথা বলেন তা অন্য জনের দশ কথার চেয়েও ভারী হয়।

গাজী আব্দুর রশীদ: পবিত্র কুরআনের বহু স্থানেই বিচক্ষণ মানুষের প্রশংসা করা হয়েছে। যারা সৃষ্টির নিদর্শন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা-গবেষণা করে, পবিত্র কুরআনে তাদেরকেই 'বিচক্ষণ' হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সুরা হিজরের ৭৪-৭৫ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে: "আমি সেই জনপদটি ওলট পালট করে রেখে দিলাম আর তাদের ওপর পোড়া মাটির পাথর বর্ষণ করলাম। প্রজ্ঞাবান ও বিচক্ষণ লোকদের জন্য এ ঘটনার মধ্যে বিরাট নিদর্শন রয়েছে।"

আকতার জাহান: বিচক্ষণ মানুষ তার সতর্ক দৃষ্টির কারণে সহজে আক্রান্ত হয় না বরং শত্রুকেই তিনি নানা উপাদানে ব্যস্ত রাখতে পারেন! বিচক্ষণ মানুষ জানার ক্ষেত্রে শুধু নিজের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, প্রতিপক্ষ সম্পর্কে আরো বেশি সতর্ক থাকে। কারো কাছে যদি শুধু 'বিচক্ষণতা' নামক গুণটি থাকে, তাহলে তিনি পৃথিবীতে ভাগ্যবান ব্যক্তিদের অন্যতম!

গাজী আব্দুর রশীদ: বন্ধুরা, বিচক্ষণতা নিয়ে এত কথা বলার উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই ধরতে পেরেছো! হ্যাঁ, আজকের আসরে আমরা এক বিচক্ষণ বিচারকের গল্প শোনাব। আর গল্পের পর থাকবে একটি গান। আমাদের আজকের অনুষ্ঠানটিও গ্রন্থনা ও প্রযোজনা করেছেন আশরাফুর রহমান। তাহলে প্রথমেই গল্পটি শোনা যাক।

আকতার জাহান: অনেক দিন আগের কথা। এক ব্যক্তি একজনকে ১০০ স্বর্ণমুদ্রা ধার দিয়েছিল কিন্তু কোনো চুক্তিপত্র করেনি। যখন সে টাকা ফেরত চাইল তখন ঋণগ্রহীতা অস্বীকার করে বলল: 'কিসের টাকা? কোথায় লেখা আছে টাকার কথা?'

গাজী আব্দুর রশীদ: টাকা না পেয়ে অনেকটা নিরুপায় হয়ে পাওনাদার আদালতে গিয়ে গিয়ে অভিযোগ করল। বিচারক একটা দিন ধার্য করে ঋণগ্রহীতা ও বাদীকে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিলেন। তারা হাজির হলে বিচারক ঋণগ্রহীতাকে জিজ্ঞেস করলেন: 'এই লোকের কাছ থেকে যে টাকা নিয়েছো তা দিচ্ছো না কেন?

আকতার জাহান: ঋণগ্রহীতা বলল: 'আমি কোনো টাকা নিইনি। সে মিথ্যা কথা বলে আমার সম্মান নষ্ট করতে চাইছে।'

গাজী আব্দুর রশীদ: কোনো সমাধান করতে না পেরে বিচারক তাদের দু'জনকে ঊর্ধ্বতন বিচারকের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। ওই বিচারক তাদের অভিযোগ জানতে চাইলে একজন তার পাওনা টাকার কথা বলল আর অন্যজন তা অস্বীকার করল।

আকতার জাহান: এসময় বিচারক বললেন: 'তোমাদের একজন পাওনাদার আর অন্যজন অস্বীকারকারী। শরীয়তের আদেশমতে পাওনাদারের অবশ্যই সাক্ষী থাকতে হবে আর যে অস্বীকার করবে তাকে কসম করতে হবে।'

এরপর পাওনাদারকে উদ্দেশ করে বিচারক বললেন: 'তোমার কোনো সাক্ষী আছে যে বলবেন এই লোক টাকা নিয়েছে?

গাজী আব্দুর রশীদ: পাওনাদার বলল: 'না, কোনো সাক্ষী নেই।'

আকতার জাহান: বিচারক বললেন: 'তাহলে কোনো উপায় নেই। অভিযুক্ত ব্যক্তি অবশ্যই কসম করবে। কিন্তু যদি কসম করে বলে টাকা নেয়নি তাহলে আর কিছুই করার থাকবে না। অপরাধীরা আল্লাহকে ভয় পায় এবং মিথ্যা কসম করে না। কারণ একদিন সত্য ফাঁস হলে অপমান ও শাস্তি তার ওপর বোঝা হয়ে আসবে।'

গাজী আব্দুর রশীদ: এসব কথা শুনে পাওনাদার বলল: 'জনাব, এই কাজ করবেন না। এই লোকের কসমের প্রতি কোনো বিশ্বাস নেই। সে মিথ্যা কসম করবে। এতে আমার অধিকার পদদলিত হবে। অন্য কোনো উপায় বের করে সমাধান করুন, জনাব।'

আকতার জাহান: বিচারক বললেন: 'তুমি বলছো তোমার কোনো সাক্ষী নেই আর আমিও তো গায়েব জানি না। কিন্তু টাকা ধার দেওয়ার ঘটনাটা তার সামনেই বলো। দেখি, সত্য ঘটনা বের হয় কিনা।'

গাজী আব্দুর রশীদ: পাওনাদার বলল: 'ঘটনা হলো- আমরা কয়েক বছর ধরে পরস্পরের বন্ধু ছিলাম। আমি তার মধ্যে কোনো অসততা দেখিনি এবং সে খুব গরিবও ছিল না। বাড়ি, বাগান ও জমানো টাকা ছিল। হঠাৎ বিয়ের প্রস্তাব পেয়ে একটি জায়গায় যায়। এক সপ্তাহ পরে তার বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হয়। মেয়েটির আরো বিয়ের প্রস্তাব ছিল। ওই দিনগুলোতে আমার বন্ধু অস্থির ও চিন্তিত হয়ে থাকত। আমরা একদিন এক বনে ঘুরতে যাই। আমরা এক জায়গায় বসার পর তার অবস্থা খুলে বলে। সে বলে, 'আমার কাছে নগদ টাকা নেই। গ্রামে এক টুকরা জমি আছে কিন্তু সেটা বিক্রি করে বিয়ের খরচ জোগাড় করব সেই সময়টুকুও নেই।'

আকতার জাহান: আমি এই কথাগুলো শুনে চিন্তায় পড়লাম, তার জন্য আমার কষ্ট লাগল। দুনিয়ার সম্পদ বলতে আমার সেই ১০০ স্বর্ণমুদ্রা। আমি কোনো কিছু না ভেবেই তাকে বললাম: 'হে বন্ধু, আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি। যদি তা তোমাকে দিই তাহলে কতদিন পর ফেরত দেবে?'

গাজী আব্দুর রশীদ: সে বলল: 'এক মাসের মধ্যে।' এরপর আমি তাকে বিশ্বাস করে টাকাটা দিলে সে তার বিয়ের কাজ সমাধান করল। বিয়ের পর এক মাস, দুই মাস করতে করতে একসময় দুই বছর চলে গেল। আমি আমার কাজ করতাম, টাকার ব্যাপারে কোনো কথা বলতাম না। সেও কিছু বলত না। আসলে তার কাছে কোনো টাকা ছিল না।

আকতার জাহান: কিন্তু একসময় আমি জানতে পারলাম যে, এক সপ্তাহ পূর্বে সে ওই জমিটি ভালো দামে বিক্রি করেছে, তার কাছে নগদ টাকা আছে। একদিন আমি তাকে ওই ১০০ স্বর্ণমুদ্রা ফেরত দিতে বললে সে অন্য কথা বলে কাটিয়ে দিল। এতে আমার সন্দেহ হলো। আমি টাকার নেওয়ার ঘটনা বিস্তারিত উল্লেখ করে বলার পর সে অস্বীকার করে বলল: কিসের টাকা, কোন্‌ বইয়ে লেখা আছে? যখন আমি দেখলাম তার সম্পর্কে ভালো ধারণা করাটা আমার ভুল ছিল নিরুপায় হয়ে বিচারকের কাছে অভিযোগ করলাম। এটাই ছিল আমার ঘটনা।

গাজী আব্দুর রশীদ: সব শুনে বিচারক বললেন: 'যেদিন তাকে ১০০ স্বর্ণমুদ্রা দিয়েছিলে সেদিন কোথায় বসেছিলে?

আকতার জাহান: লোকটি বলল: আমরা এক গাছের নিচে বসেছিলাম, সেখানে নদীভরা পানি ছিল আর জায়গাটিও ছিল খুব মনোরম।'

গাজী আব্দুর রশীদ: এ পর্যন্ত বলার পর বিচারক ঋণগ্রহীতাকে বললেন: 'এই ঘটনা কি সত্য?'

আকতার জাহান: লোকটি বলল: 'পুরোটাই মিথ্যা।'

গাজী আব্দুর রশীদ: বিচারক এবার ঋণদাতাকে বললেন: 'তুমি যখন বলছো গাছে নিচে বসে টাকা দিয়েছিলে তাহলে কেন বলছো সাক্ষী নেই? ওই গাছটাই তো সাক্ষ্য দেবে।'

আকতার জাহান: বাদী বলল: গাছ কিভাবে সাক্ষ্য দেবে?

গাজী আব্দুর রশীদ: বিচারক বললেন: 'আমি যেভাবে বলছি সেভাবে কাজ করো। এখানে আমি আসামিকে আটকে রাখছি। তুমি এখন ওই গাছের কাছে গিয়ে আমার দাও এবং বলো বিচারক বলেছেন এসে সাক্ষ্য প্রদান করতে।'

আকতার জাহান: এই সময় আসামি কথাগুলো শুনে উপহাস মনে করে মুচকি হাসি হাসলো। বিচারকও তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। বাদী বিচারককে বলল: 'আমার ভয় হচ্ছে, আমি গাছকে এ কথা বললে গাছ হয়তো বিশ্বাস করবে না।'

গাজী আব্দুর রশীদ: বিচারক বললেন: 'এসো, আমার লেখা এই সিলমোহর নাও এবং গাছকে দেখিয়ে বলো যেন তোমার সাথে চলে আসে।'

আকতার জাহান: বাদী বিচারকের সিলমোহর নিয়ে গাছের কাছে যাওয়ার জন্য ঘর থেকে বের হলো। বাদী বের হয়ে গেলে বিচারক বই পড়া শুরু করলেন। এরপর নরম স্বরে আসামির সাথে কথা বলা শুরু করলেন।

গাজী আব্দুর রশীদ: তিনি বললেন, 'বাজারের পরিস্থিতি ভালো নয়।'

আকতার জাহান: লোকটি বলল: 'হ্যাঁ কাজ-কর্মে মন্দা চলছে, জনাব।'

গাজী আব্দুর রশীদ: বিচারক বললেন: 'মানুষের ঝগড়া করার মেজাজ নেই। আমরাও প্রায়ই বেকার বসে থাকি, বই পড়ি। আসলে বলতে চাচ্ছি আমাদের কাজেও মন্দা।'

আকতার জাহান: বিচারকের কথা শুনে আসামি মনে মনে ভাবল- তিনি হয়তো ঘুষ নিয়ে তাকে কসম করিয়ে বিষয়টি ফায়সালা দেবেন। সে আরও ভাবল- বিচারক নিশ্চয়ই বাদীর সাথে উপহাস করেছেন। আস্তে আস্তে তার ভয়ও কেটে গেল।

গাজী আব্দুর রশীদ: বিচারক আরও কয়েক পৃষ্ঠা বই পড়ে ফিসফিস করে বললেন: 'আজকে বিচারের মানসিকতাই নষ্ট হয়ে গেল, লোকটি গেল আর ফিরেও এলো না। আমার মনে হয় অনেক দূর তাই সে নিরুপায় হয়ে রাগ করেছে।'

তারপর আসামির দিকে তাকিয়ে বললেন: 'তোমার বন্ধু কি এতক্ষণে ওই গাছের কাছে পৌঁছে গেছে? তোমার কী মনে হয়?'

আকতার জাহান: লোকটি দ্রুত জবাব দিলো: এখনো না, জনাব।

গাজী আব্দুর রশীদ: বিচারক কোনো কথা না বলে আবার বই পড়ায় ব্যস্ত হয়ে গেলেন। ঘণ্টাখানেক পর বাদী মন খারাপ করে ফিরে এসে বলল: 'জনাব, সেখানে গিয়েছিলাম, আপনার সালাম দিলাম, আপনার সিলমোহর দেখালাম, আপনার কথাও গাছকে বললাম কিন্তু গাছ কোনো উত্তর দিল না। আমি অনেকক্ষণ ধৈর্য ধরে বসেছিলাম কিন্তু সে তার জায়গা থেকে নড়ল না। তাই ফিরে এলাম। এই নিন আপনার মোহর। এখন কী করব তাই বলুন।'

আকতার জাহান: বিচারক বললেন, 'তুমি যাওয়ার পর হঠাৎ গাছ এসে তার সাক্ষ্য দিয়ে চলে গেছে।' তারপর আসামির দিকে তাকিয়ে বললেন: 'হে মিথ্যাবাদী-প্রতারক, নিজের বন্ধুর কাছ থেকে যে টাকা ধার নিয়েছিলে তা দিয়ে দাও নতুবা আমি তোমাকে প্রধান বিচারকের কাছে পাঠাবো। কীভাবে টাকা আদায় করতে হয় তা তিনি ভালো করেই জানেন।'

গাজী আব্দুর রশীদ: ঋণগ্রহীতা বলল: 'হে বিচারক, আপনি কেন আমার প্রতি অবিচার করছেন? আমি তো এখানেই বসে আছি, কোনো গাছ এসে তো সাক্ষ্য দিতে আসেনি!'

আকতার জাহান: বিচারক বললেন: 'যখন আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করলাম, লোকটি গাছের কাছে পৌঁছেছে কিনা তখন তুমি বলেছিলে যে, সে এখনো পৌঁছেনি। যদি গাছ ও বাদীর ব্যাপারে তুমি কিছু না জানতে তাহলে হয়তো বলতে 'কোন্‌ গাছ? বাদী কোথায় গেছে জানি না।' তুমি আগে বলেছিলে যে, বাদীর সব কথাই মিথ্যা। তাহলে কিভাবে ওই গাছ চিনলে? '

গাজী আব্দুর রশীদ: বিচারকের বিক্ষণতা দেখে আসামি লজ্জিত হলো। সে নিরুপায় হয়ে বিচারকের কথা মেনে নিল এবং ঋণের টাকা পরিশোধ করল।

আকতার জাহান: বন্ধুরা, অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে রয়েছে একটি শিক্ষামূলক গান। 'মিথ্যা বলা ভালো নয়' শিরোনামের গানটির গীতিকার ও সুরকার আতিকুল ইসলাম। আর গেয়েছে বাংলাদেশের শিশুশিল্পী হুমায়রা আফরিন ইরা ও তার সঙ্গীরা।

গাজী আব্দুর রশীদ:  বন্ধুরা, তোমরা গানটি শুনতে থাকো আর আমরা বিদায় নিই রংধনুর আজকের আসর থেকে। 

পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/২৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।