ডিসেম্বর ০১, ২০২১ ১৭:৫৪ Asia/Dhaka

পাশ্চাত্যে পরিবার সংক্রান্ত সমস্যা ক্রমেই জটিল হচ্ছে। এর পেছনে মূল কারণ হচ্ছে পারিবারিক কাঠামোর পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের ফলে পারিবারিক মমত্ববোধ ও ভালোবাসার জায়গাতেও পরিবর্তন এসেছে। পাশ্চাত্যে একাকী বসবাসের প্রবণতা অনেক বেড়েছে।

স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তালাক বা বিচ্ছেদ স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এছাড়া সন্তান গ্রহণের ব্যাপারে ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। এসবই হতাশা ও অবসাদের ক্ষেত্রকে বিস্তৃত করে চলেছে প্রতিনিয়ত। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, এ ধরণের পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে অনেকেই পশুর সাথে বসবাসের পথ বেছে নিচ্ছে।

বাস্তবতা হলো পারিবারিক মায়া-মমতা ও ভালোবাসা মানুষের মনে প্রশান্তির জন্ম দেওয়ার পাশাপাশি জীবন সম্পর্কে মানুষকে আশাবাদী করে তোলে। সব মানুষই অন্যের কাছ থেকে ভালোবাসা ও মমতা আশা করে। বিশেষকরে পরিবারের সদস্যদের পক্ষ থেকে মমতা-প্রাপ্তি মানুষের স্বাভাবিক চাহিদাগুলোর একটি। পাশ্চাত্যের মানুষেরা ঘরে পশু রেখে এবং পশুর সঙ্গে বসবাস করে এই শূন্যতা পূরণের চেষ্টা করে।

সৃষ্টির শুরু থেকেই পশুদের সঙ্গে মানুষের পরিচয়। তবে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকেও পাশ্চাত্যের মানুষ পশুদের প্রতি ছিল অত্যন্ত নিষ্ঠুর। ঘরের ভেতর পশু পালনের প্রবণতা খুব একটা ছিল না বললেই চলে। কিন্তু মানুষের জীবন যতই যান্ত্রিক হচ্ছে এবং মানুষের পরস্পরের মধ্যে সম্পর্কের গভীরতা যতই কমছে ততই পশুর প্রতি আগ্রহ বেড়ে চলেছে। বর্তমানে পাশ্চাত্যে কুকুর-বিড়ালের সঙ্গে বসবাস বিনোদনের বড় মাধ্যমে হিসেবে দেখা দিয়েছে। আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই পাশ্চাত্যে কুকুরসহ পেট এনিমেল নিয়ে বসবাস ও তা নিয়ে সর্বত্র ঘুরাঘুরির প্রবণতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এর আগে গৃহপালিত পশুর ব্যাপারে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এমন ছিল না। এই প্রবণতা গত ৫০ বছরে ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। এর ফলে কুকুরসহ গৃহপালিত পশু উৎপাদন ও বেচা-কেনা বড় ধরণের লাভজনক ব্যবসাতেও পরিণত হয়েছে। ২০১৭ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী পেট এনিমেলের খাবার কেনা-বেচার ক্ষেত্রে প্রতি বছর অর্থ লেনদেন হয় প্রায় দুই হাজার কোটি ইউরো। 

ইউরোপের পশু খাদ্য সংক্রান্ত ফেডারেশন বা ফেডিআফ'র পরিচালক বলেছেন, ইউরোপে গৃহপালিত পশুর খাদ্য শিল্পে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় এক লাখ মানুষের। এছাড়া গৃহপালিত পশু সংক্রান্ত অন্যান্য খাতেও চাকরি করেন আরও প্রায় নয় লাখ মানুষ। কুকুর-বিড়ালসহ এসব পশুর প্রয়োজনীয় অন্যান্য পণ্য বিক্রির জন্য ইউরোপে রয়েছে অন্তত ৬০ হাজার বিশেষায়িত বিক্রয়কেন্দ্র। এর ফলে এ ধরণের পশুর সংখ্যা বৃদ্ধি পুঁজিবাদের জন্যও ইতিবাচক। বর্তমানে ইউরোপ ও আমেরিকার বেশিরভাগ সড়ক ও পার্কে ব্যাপক সংখ্যায় কুকুরের আনাগোনা চোখে পড়ে। এসব গৃহপালিত কুকুরের বৈচিত্রও বেড়েছে ব্যাপকভাবে।এমন বৈচিত্র অতীতে কখনোও দেখা যায়নি। ইউরোপ-আমেরিকায় সহজেই চোখে পড়ে একেবারে হাতের তালুর সাইজের ছোট্ট প্রজাতির কুকুর থেকে শুরু করে মানুষের সমান বিশাল আকৃতির কুকুর। আমেরিকার গৃহপালিত পশু সংক্রান্ত সংস্থা এপিপিএ প্রকাশিত ২০১৯-২০২০ সালের পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, আমেরিকার ৬৭ শতাংশ পরিবারের কুকুর-বিড়ালের মতো গৃহপালিত পশু রয়েছে। ২০১৭ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ঐ বছর আমেরিকায় শিশুর সংখ্যা ছিল সাত কোটি ৩০ লাখ।  অন্যদিকে, আমেরিকার পরিবারগুলোতে সে সময় বিড়ালের সংখ্যা ছিল নয় কোটি ৪০ লাখ এবং কুকুর ছিল আট কোটি ৯০ লাখ।

ঘরে পশুর সঙ্গে বসবাসের প্রবণতার বাড়ার কিছু কারণ রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, অনেকেই একাকীত্বে ভুগেনে। তাদের সঙ্গে কেউ বসবাস করেন না। এ ধরণের একাকী মানুষের মধ্যে অনেকেই আবার বৃদ্ধ। এ ছাড়া কোনো কোনো পরিবার তাদের সন্তানের খেলার সাথী হিসেবে পশুকে বেছে নেন। পাশ্চাত্য সমাজে এখন অনেকের  জীবনসঙ্গী, সন্তান, ভাই ও বোনের শূন্যতা পূরণ করছে এসব পশু। পাশ্চাত্যে বিশেষকরে আমেরিকায় পশুকে পরিবারের সদস্য হিসেবে গ্রহণ করাটা তাদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণে আমেরিকার প্রেসিডেন্টেরও একটি কুকুর থাকে। প্রযুক্তি ও ডিজিটাল নির্ভর সমাজ ব্যবস্থার নানা ইতিবাচক দিক থাকার পরও রয়েছে কিছু নেতিবাচক প্রভাব। এর একটি হলো, মানুষের পরস্পরের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি বিশেষকরে পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের মধ্যে আন্তরিকতা হ্রাস। বর্তমানে নানা ধরণের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার বাড়লেও বাস্তবে পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে আন্তরিক যোগাযোগ কমে যাচ্ছে। এই যোগাযোগ ও বন্ধনটা কৃত্রিমতায় ভরে যাচ্ছে। পারিবারিক বন্ধন যা হৃদয় ও আত্মার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তা ক্রমেই দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে প্রতিনিয়তই সৃষ্টি হচ্ছে বড় ধরণের শূন্যতা। আর এই শূন্যতা পূরণ করতেই পাশ্চাত্যের মানুষ পশুর দিকে ঝুঁকছে।

ব্রিটেনের অধিকাংশ মানুষের কাছে তাদের কুকুর-বিড়াল তথা গৃহপালিত পশু নিজের পরিবারের সদস্যদের চেয়েও বেশি গুরুত্ব পায়। তারা নিজেরাই বলে, ছুটির দিনটি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কাটানোর চেয়ে পশুর সঙ্গে কাটানো বেশি আনন্দদায়ক। ব্রিটেনে গৃহপালিত পশুর মালিকদের ওপর চালানো এক জরিপের ফলাফল নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ইউনাইটেড প্রেস। তাতে দেখা যাচ্ছে, ঘরে পশুর রাখেন এমন ব্যক্তিদের ৪৭ শতাংশই দূরে কোথাও বেড়াতে গেলে যার জন্য সবচেয়ে বেশি টান অনুভব করেন তাহলো তার কুকুর, বিড়াল বা এ ধরণের কোনো পশু। অন্যভাবে বলা যায়, পরিবারের সদস্যদের চেয়ে পশুর প্রতিই তার টান বেশি। এ ছাড়া ১৩ শতাংশ বলেছেন, যদি নির্বাচনের সুযোগ থাকে তাহলে ছুটি কাটানোর জন্য তারা পরিবারের সদস্যদের তুলনায় পশুকেই প্রাধান্য দেবেন।

পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, পাশ্চাত্যে অনেকেই তাদের পশুকে উত্তরাধিকার হিসেবেও ঘোষণা করে যাচ্ছে। কেউ কেউ কোটি কোটি ডলারের সম্পত্তি তার পশুর নামে লিখে দিয়ে যাচ্ছে। এ সংক্রান্ত খবর পাশ্চাত্যের গণমাধ্যমে মাঝে মধ্যেই প্রকাশিত হয়।  কুকুর-বিড়ালের সঙ্গে বসবাসের প্রবণতার সঙ্গে নিঃসন্তান বা কম সন্তান থাকারও একটা সম্পর্ক রয়েছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ঘরে কুকুর-বিড়ালের সঙ্গে যাদের বসবাস, পশুদের প্রতি তাদের আচরণটা সন্তানের সঙ্গে বাবা-মায়ের আচরণের মতো। হয়তো তারা মনে করেন, সন্তানের চেয়ে পশু কম সমস্যার জন্ম দেয় এবং এটি লালনপালনের খরচও তুলনামূলক কম। যেসব মানুষ বিয়ে করতে ভয় পায় এবং সন্তান গ্রহণকে ঝামেলা মনে করে তাদের মধ্যে পশু-প্রীতি বেশি লক্ষ্য করা যায় বলে গবেষণায় ফলাফলে উল্লেখ করা হয়েছে।#

পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ০১

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ